মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: বৃহস্পতিবার ৮, অগাস্ট ২০২৪

চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য শেখ হাসিনা যুগের অবসান

Share on:

শেখ হাসিনা যুগের অবসান হয়েছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। মনে রাখতে হবে তার বয়স ৭৬ পেরিয়েছে। নির্বাসনে বসে কোনো প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা করবেন, এটি বোকামি হবে। স্বাধীনতা-পরবর্তী অর্ধশতকে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে।


ভারত বাংলাদেশের বেশির ভাগ সরকারের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করেছে। যদিও বাংলাদেশের সব সরকার ভারতের প্রতি অতটা বন্ধুত্বপরায়ণ ছিল না। আমি মনে করি, সামনের সরকারগুলোর সঙ্গেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চালিয়ে যেতে হবে আমাদের।

শেখ হাসিনা যুগের অবসানে তার একটা নির্মোহ মূল্যায়নের সময় এসেছে। তার আমলে অবশ্যই বিভিন্ন ক্ষেত্রে লক্ষণীয় উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু উন্নয়নের সুবিধা সবার কাছে সমভাবে পৌঁছায়নি, বিশেষ করে যারা নিচের তলায় আছেন। এ কারণেই বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। কারণ তাদের হারানোর আর কিছু ছিল না। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৫-২৪ বছর বয়সী যুবকদের ৪০ শতাংশই শিক্ষা বা কর্মসংস্থানে নেই। এটাই শেখ হাসিনা গল্পের সবচেয়ে নেতিবাচক দিক। এ কারণেই সর্বস্তর থেকে সংস্কারের দাবি উঠেছিল। সামষ্টিক অর্থনীতিতে যদিও দীর্ঘদিন স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পেরেছিল তারা। হাসিনার পলায়ন থেকে আমাদের মতো দেশও শিক্ষা নিতে পারে। সরকার যতই প্রবৃদ্ধির গল্প বলুক না কেন তার সুবিধা যদি সাধারণ মানুষের কাছে না পৌঁছে তাহলে সে গল্প ধোপে টেকে না। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির ওই গল্প হয়তো ব্যর্থ হয়েছে।

শেখ হাসিনার পলায়নে অবশ্যই প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপির পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সুযোগ সামনে আসছে। গত দুই নির্বাচন বয়কট করার কারণে সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল না। নতুন প্রেক্ষাপটে তাদের সামনে সুযোগ উন্মোচিত হলো। তবে এটা মনে রাখতে হবে এ গণ-অভ্যুত্থানে দেশের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এখানে বিএনপি সমর্থক যেমন ছিল, তেমনি জামায়াতও ছিল। সাধারণ ছাত্র যেমন ছিল, তেমনি বাম প্রতিনিধিত্বও ছিল। আমরা সামনে যা দেখছি—একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হচ্ছে। তাদের অগ্রাধিকার হবে দেশজুড়ে স্থিতিশীলতা আনা। তারপর তাদের প্রধান দায়িত্ব হবে নির্বাচন দেয়া। এটা যেহেতু সর্বস্তরের মানুষের উদ্যোগে একটি অভ্যুত্থান তবে এটা নিশ্চিত নয় পরবর্তী সময়ে কোন সরকার ক্ষমতায় আসছে। এটা হতে পারে বিএনপি কিংবা অন্য কোনো দল। সামনে যেকোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক আমাদের কাজ হওয়া উচিত দেখা ও অপেক্ষা করা। অবশ্যই স্বাধীনতার সময় থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের ভালো একটা সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য সরকার গঠিত হলে যেন আমাদের সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমাদের নীতি হওয়া উচিত—যেকোনো সরকারের সঙ্গে কাজ করা। বিশেষ করে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে। তবে নতুন সৃষ্ট পরিস্থিতিতে আমাদের সীমান্তে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। যতটুকু দেখা যাচ্ছে আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ খুবই সতর্ক অবস্থায় আছে। মনে রাখতে হবে প্রতিবেশী দেশে সৃষ্ট অস্থিরতার প্রভাব পড়তে পারে আমাদের সীমান্তেও। অনিরাপদ বোধ করা অনেকেই হয়তো ভারতে আসতে চেষ্টা করবেন। অস্থির পরিবেশে যেন কোনো নেতিবাচক শক্তি সুবিধা নিতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। তবে আমাদের এটা মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ ও প্রতিনিধি নির্ধারণের কাজ তাদের জনগণেরই। ভারত অবশ্যই একটি অস্থিতিশীল বা বান্ধবহীন প্রতিবেশী চায় না। কিছু বিশ্বস্ত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, হিন্দুদের বাড়ি, মন্দির এবং ব্যক্তিদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। আমরা সবাই লুটপাটের ছবি দেখেছি। যেকোনো গণ-অভ্যুত্থান শেষেই কয়েক দিনের জন্য অস্থিরতা দেখা যায়। আশা করছি, দু-একদিনের মধ্যে পরিস্থিতি শান্ত হতে পারে এবং স্থিতিশীল হতে পারে। যদি সেটা না হয়, তাহলে আমাদের দেশে পালিয়ে আসা শরণার্থীদেরও ঝুঁকি রয়েছে। এটি একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হবে। আমি আশা করি আমাদের হাইকমিশনার এবং সেখানে আমাদের কর্মীরা নিরাপদ আছেন এবং পরিস্থিতি সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। আশা করছি তারা নতুন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কাজ করছেন।

আমাদের উদ্বেগের বিষয় হতে পারে সেখানে জামায়াতের উত্থান, যারা ভারত সম্পর্কে নেতিবাচক অবস্থান রাখে। এছাড়া পাকিস্তান ও চীনের হস্তক্ষেপের ব্যাপারেও আমাদের সতর্ক হতে হবে। আমি মনে করি নতুন পরিস্থিতিতে নেতিবাচক অবস্থান নেয়া আমাদের জন্য ঠিক হবে না। ভারত সরকার অবশ্যই সেটা করবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে আমাদের চলতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে শান্তি-সমৃদ্ধি কেবল বাংলাদেশের স্বার্থেই নয় আমাদের স্বার্থেও জরুরি।

বাংলাদেশের সবাইকে আশ্বস্ত করা উচিত, আমরা অবন্ধুসুলভ দেশ নই। আমাদের তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার বা নিয়ন্ত্রণের অভিলাষ নেই, আমরা যথাসম্ভব সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চাই। এ ধরনের বার্তা আমাদের প্রকাশ্যে ও ব্যক্তিগতভাবে প্রেরণ করা উচিত বলে আমি বিশ্বাস করি।

দৈনিক বণিকবার্তা