চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিতের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ‘বিনিয়োগ’
Share on:
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় যে পরিমাণ শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে সে পরিমাণে শ্রমবাজারে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। এ বাস্তবতায় ১৫-২৯ বছর বয়সী যুবারা যারা টারশিয়ারি পর্যায়ে (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর) শিক্ষা পেয়েছে তাদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন গত এক-দুই বছরের বেশি সময় ধরে বেকার রয়েছে।
পরিমাণ বা সংখ্যার বিচারে ১৫-২৯ বছর বয়সী যুবারা ২০২২-এর জনশুমারির তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ (৪ কোটি ৫৮ লাখ ৪১ হাজার)। এটি একটি বড় সংখ্যা, বড় চ্যালেঞ্জ ও একই সঙ্গে বড় সম্ভাবনা। সাধারণত ১৫-৬৪ বছর বয়সীরা কর্মক্ষম বা উৎপাদনক্ষম জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত। এদের পরিমাণ বর্তমানে ৬৫ দশমিক ১৩ শতাংশ, যা মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ। এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হলো তরুণ বা যুবা, যারা একদিকে বর্তমান একই সঙ্গে ভবিষ্যৎও। এ প্রেক্ষাপটে এখন তাদের জন্য সুশিক্ষা বা গুণগত শিক্ষা- দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা, পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি এবং তাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে না পারা যায় তাহলে বাংলাদেশের জন্য জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জন দুরূহ ও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ এ সমগ্র প্রক্রিয়ার মধ্যে সঠিক পরিকল্পনা-নীতি-কৌশল গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন জড়িত। এগুলো সামগ্রিক পরিসরে কাজ না করলে অর্থাৎ সুশাসন নিশ্চিত না করা গেলে, দুর্নীতি নির্মূল না করতে পারলে, স্বচ্ছতার অভাব থাকলে, জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করলে, সর্বোপরি ন্যায় ও অধিকারভিত্তিক সমাজ তৈরি না হলে বা অসমর্থ হলে আমরা জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনের সুফলও ভোগ করতে পারব না। পৃথিবীতে এমন অনেক দেশও রয়েছে যাদের এমন সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যথাযথ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অভাবে সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেনি।
কিন্তু আমাদের ব্যর্থ হলে চলবে না, কারণ আমাদের তরুণ-যুবার এ প্রজন্ম সৃজনশীল, উন্মুক্তমনা ও সংবেদনশীল। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নীতি-কৌশল প্রণয়ন করতে হবে এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। শ্রমবাজারে চাকরি বা কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে এবং শ্রমবাজারের চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা অর্জন নিশ্চিত করতে হবে। বাজারের চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো বিনিয়োগ, অর্থাৎ দেশের অর্থনীতিতে স্থানীয় বা জাতীয় পর্যায়ে বিনিয়োগের পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই।
আমরা বর্তমানে শিল্পায়ন ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে ভাবছি কিন্তু দেখতে পাচ্ছি দেশের শিল্প খাতে কাজের জায়গা তেমন বাড়ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ ও ২০২২-এর শ্রম জরিপেই সেই তথ্য উঠে এসেছে। এখানে দেখা যাচ্ছে যে শিল্পভিত্তিক ও সেবাভিত্তিক খাতগুলোয় কর্মসংস্থান কমছে। বরং কৃষিতে কিছুটা বাড়ছে।
শিল্প খাতভিত্তিক জায়গাগুলোয় কর্মসংস্থান তখনই বাড়বে যখন সেখানে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ আসবে এবং বিনিয়োগের জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে এসব খাতে নিয়োজিত ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। বিগত সরকারের সময় দেখা গেছে এসব প্রতিষ্ঠান কাঠামোগতভাবে ও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে পারেনি। তাছাড়া সরকার নিজেও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। আবার ব্যাংক খাত ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পূর্বকালে চরম নৈরাজ্যের মধ্য দিয়ে গেছে। ব্যাংক থেকে সাধারণত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ নেয়ার কথা। কিন্তু সরকার ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়েছে, যা বড় চ্যালেঞ্জ বা বাধা হিসেবে বেসরকারি খাতে কাজ করেছে।
এ মুহূর্তে আমাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্থানীয় বাজারে বৈশ্বিক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। যথাযথ অর্থনৈতিক সংস্কার করলে ভালো ফলাফল আসবে। আমাদের শ্রমবাজারের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। স্বল্প ব্যয়ে শ্রমিকদের অধিকতর উৎপাদন করার সক্ষমতা রয়েছে। আগেই আমি বলেছি, আমাদের তরুণরা সৃজনশীল ও উন্মুক্তমনা, একই সঙ্গে তারা কর্মঠও বটে। সুতরাং তাদের কাজে লাগাতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে জ্ঞান অর্জনের পাসাপাশি বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা হতে হবে পেশাগত বা বাজারের চাহিদা ও দক্ষতানির্ভর। শিক্ষার পেশাগত ও গুণগত উভয় মানেরই সমন্বয় করতে হবে। এর জন্য অধিক গবেষণা প্রয়োজন। ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমিয়ার মধ্যে এক ধরনের যোগসূত্র স্থাপন করতে হবে। যে জায়গাগুলোয় আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছি। গণহারে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগ খোলা হয়েছে তা পর্যালোচনা করা দরকার—নতুন করে পরিকল্পনা করতে হবে। বিগত সরকারের পঞ্চবার্ষিক ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকৌশলের নির্মোহ বিশ্লেষণ দরকার। নতুন পরিকল্পনায় যুবদের অগ্রাধিকার দিয়ে বৈষম্য নিরসনসহ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।
আমাদের তরুণ-যুব প্রজন্ম এরই মধ্যে একটি বড় পরিবর্তন এনেছে, চব্বিশের আন্দোলনকে সফল গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত করেছে। তাদের আন্দোলনকালীন কর্মসূচি ছিল বিচিত্র, যা জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণে ও আন্দোলনে যুক্ত হতে তাড়না দিয়েছে। যেমন ‘মার্চ ফর জাস্টিস’, ‘কমপ্লিট শাটডাউন’, ‘রিমেম্বারিং দ্য হিরোজ’। বিভিন্ন নতুন নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে তারা সাধারণ জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। এসব তাদের সৃজনশীল মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। তারা সমাজ ও দেশের দায়বদ্ধতাকেও গুরুত্বসহ গ্রহণ করেছে। এ তরুণ-যুবারা প্রয়োজনে রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়েছে, বৃক্ষ রোপণ করছে, রংতুলি দিয়ে দেয়াল লিখন করেছে—তাদের ভাবনা ও চিন্তার বহিঃপ্রকাশ করেছে যা দেখে বেশ আশাবাদী হতে চাই। পাশাপাশি বিপ্লবোত্তর কিছু কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও উদ্বেগের কারণ হিসেবে হাজির হয়েছে। আমাদের সামনে এখন তরুণ-যুবারাই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। সুতরাং আমাদের এখন উচিত তাদের নেতৃত্ব প্রদানের সুযোগ করে দেয়া। তাদের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ ও সমৃদ্ধি বাড়বে—একটি সমৃদ্ধ দেশ গঠনে আরো জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারবে।
তবে মোটাদাগে বিদ্যমান যে নীতি-পরিকল্পনাগুলো বিগত রাজনৈতিক সরকার করে গেছে সেগুলোর নির্মোহ পর্যালোচনা ও পরিমার্জন অতিদ্রুত করতে হবে এবং এ পরিমার্জনে বা পরিবর্তনে বর্তমান তরুণ-যুব প্রজন্মকেই দাবি তুলতে হবে। যেমন আমাদের বিদ্যমান শিক্ষানীতি, জনসংখ্যা নীতি, স্বাস্থ্যনীতি, নারী নীতিসহ অনেক নীতিই ২০১৫ সালের আগে প্রণয়ন করা হয়েছে, যা হালনাগাদ বা সময়োপযোগী নয় । বর্তমান টেকসই উন্নয়নের যে অভীষ্ট লক্ষ্য রয়েছে সেগুলোকে কেন্দ্র করে এসব নীতি হালনাগাদ করা হয়নি। একইভাবে পঞ্চবার্ষিক ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা একটা ভ্রম উন্নয়নের প্রপাগান্ডার মধ্যে ছিলাম—যে উন্নয়ন আমাদের মানবিকতাগুলোকে স্পর্শ করেনি। বরং মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। অথচ দরকার ছিল গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করা।
এখন এ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের উন্নয়ন হতে হবে গুণগত ও পরিমাণগত উভয়ের মেলবন্ধনের মাধ্যমে। গুণগত ক্ষেত্রগুলোয় মানুষের অধিকার থাকবে, নিজস্ব পছন্দ-মতামত বেছে নেয়ার স্বাধীনতা থাকবে এবং কেউ নিগৃহীত হবে না, বৈষম্যের শিকার হবে না, জনসংখ্যা ও জনসংখ্যার বিভিন্ন উপগোষ্ঠীর চাহিদা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে জনসংখ্যাকে রাখতে হবে।