মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: বৃহস্পতিবার ১৯, সেপ্টেম্বর ২০২৪

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব অর্জনে সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

Share on:

আমরা যখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের (ফোর আইআর) যুগে প্রবেশ করছি, তখন আমরা শিল্প, সমাজ এবং দৈনন্দিন জীবনে উন্নত প্রযুক্তিগুলো ক্রমশ সংহত করছি। যদিও ফোর আইআর উদ্ভাবন, দক্ষতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়; এটি এর অবক্ষয়মূলক (ডিজেনারেটিভ) বিকাশ এবং সংহতিনাশক (ডিসরাপটিভ) প্রকৃতিজনিত উদ্বেগ নিয়েও কাজ করে।


এ খাতের নেতাদের জন্য তাদের কর্মকাণ্ডের বৃহত্তর প্রভাবগুলো সম্পর্কে সাবধান থাকা জরুরি, যাতে এ অগ্রগতি সামগ্রিকভাবে সমাজকে উপকৃত করে এবং সমাজে অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম পূর্বাভাস দিয়েছে যে, ২০২৫ সালের মধ্যে প্রায় সাড়ে আট কোটি চাকরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-সক্ষম মেশিন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে পারে, যা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে চাকরিচ্যুতি এবং ভবিষ্যতে কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশে শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ অদক্ষ, জনসংখ্যার ২৮ শতাংশের প্রতিনিধিত্বকারী তরুণদের মধ্যে ১৪ শতাংশেরও কম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন করেছে এবং তারা ফোর আইআর সম্পর্কিত দক্ষতা অর্জন করেনি। ফলে ফোর আইআর প্রযুক্তির অপরিপক্ব প্রয়োগ সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। এই প্রযুক্তিগুলো প্রয়োগের আগে পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন এবং সতর্ক পরিকল্পনা করা অত্যন্ত জরুরি। উৎপাদন, সেবা, শিক্ষা এবং সমাজের ওপর ফোর আইআরের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা গঠন দরকার, যা একটি সুষম ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি বিকাশের জন্য অপরিহার্য।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), রোবটিক্স, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), ব্লকচেইন এবং বায়োটেকনোলজির মতো উন্নত প্রযুক্তিগুলোর সমন্বয় ঘটিয়ে আমাদের জীবনযাত্রা, কাজ করার পদ্ধতি এবং পারস্পরিক যোগাযোগের ধরনকে রূপান্তর করছে। উন্নত দেশগুলো এ শিল্পযুগের চাহিদার সঙ্গে তাদের শিক্ষার মডেল মানিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ফোর আইআর প্রযুক্তি এবং বর্তমান সময়ের চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা প্রদান করে না কিংবা এ শিল্পযুগের কর্মশক্তির জন্য প্রয়োজনীয় সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা বাড়ায় না। এমনকি এ লক্ষ্যে শিগগিরই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন শুরু হলেও যুগের চাহিদা অনুসারে কর্মশক্তি পেতে কয়েক দশক লেগে যাবে। প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে আমরা কী করব? আমরা যেসব খাত দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা উৎপাদন করে সেগুলোতে অগ্রাধিকার দিয়ে অটোমেশন শুরু করতে পারি। অন্যান্য খাতকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে অটোমেশন করা যেতে পারে।

পোশাক খাত বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী খাত, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪২.৬ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে এবং প্রায় ৪২ লাখ লোককে কর্মসংস্থান দিয়েছে, যা জিডিপিতে একটি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। এই খাতে ৪.৩ শতাংশ কর্মীর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, ২২.৮ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করেছেন, ৩৫.১ শতাংশ জুনিয়র স্কুল শেষ করেছেন এবং ১৩.১ শতাংশ হাইস্কুল শেষ করেছেন। লেদার ফুটওয়্যার, কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, পাটজাত পণ্য, ওষুধশিল্প, ইস্পাত নির্মাণ, জাহাজ নির্মাণ, হালকা প্রকৌশল ইত্যাদির মতো অন্যান্য প্রধান খাতও অনুরূপ শিক্ষাগত যোগ্যতার কর্মীদেরই নিয়োগ দেয়। যেহেতু এই শিল্পগুলোর বেশির ভাগ কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করতে হয়, তাই এদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অটোমেশনের মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তবে এই রূপান্তর ধীরে ধীরে করতে হবে, যাতে ঐতিহ্যবাহী এবং উদ্ভাবনী উৎপাদন পদ্ধতি কিছু সময়ের জন্য সহাবস্থান করতে পারে। এর ফলে মানসম্মত কাজের পাশাপাশি নিরাপদ জীবিকার বিষয়টিও নিশ্চিত করা যেতে পারে। গণবেকারত্ব এবং সম্ভাব্য সামাজিক অস্থিরতা প্রতিরোধ করতে এই শিল্পগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় যে কর্মীদের পুনঃদক্ষতা বা উন্নত দক্ষতা প্রয়োজন, তাদের চিহ্নিত করা এবং তাদের অন্যান্য উৎপাদনশীল ভূমিকা দেওয়া অত্যাবশ্যক।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শ্রমিক অভিবাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, প্রায় ৮০ লাখ বাংলাদেশি এখন বিদেশে কাজ করছেন। এই অভিবাসীর মধ্যে প্রায় ৫৭ শতাংশ অদক্ষ, ৩৪.৯৫ শতাংশ দক্ষ কর্মী এবং মাত্র ০.৪১ শতাংশ পেশাজীবী। ২০২৩ সালে তারা প্রায় ২১.৯ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে, যা বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। এই রেমিট্যান্স গৃহস্থালির আয় বাড়ায় এবং প্রয়োজনীয় আমদানি অর্থায়ন করতে সহায়তা করে। এই সুবিধাগুলো সর্বাধিক করতে বাংলাদেশ সরকারকে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত, যাতে আরও বেশি অভিবাসী উচ্চ বেতনের চাকরির সুযোগ পেতে পারে এবং অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং দক্ষতা দিয়ে কর্মীদের প্রস্তুত করা একটি অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে আরেকটি উদ্বেগ হলো এটি ‘অবক্ষয়মূলক বিকাশ’ বাড়িয়ে তুলতে পারে; যা পরিবেশের ক্ষতি, সম্পদের হ্রাস এবং অসমতা বাড়ানোর সঙ্গে সম্পর্কিত। ডিজিটাল প্রযুক্তির বৃদ্ধি ইলেকট্রনিক বর্জ্য, উচ্চশক্তি খরচ এবং সম্পদ আহরণের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতিতে অবদান রাখে। ডেটা সেন্টার এবং ডিজিটাল অবকাঠামো অ-নবায়নযোগ্য শক্তির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে, যা কার্বন নিঃসরণ বা ফুটপ্রিন্ট বাড়ায়। এ ছাড়া এআইচালিত কৃষি উচ্চ ফলনের দিকে মনোযোগ দিতে পারে, যার ফলে বাসস্থান ধ্বংস এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হতে পারে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার ডেটা গোপনীয়তা ভঙ্গের উদ্বেগ বাড়ায়, যা শোষণের ঝুঁকি এবং ব্যক্তিগত অধিকারগুলোর ক্ষয় ঘটায়। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো (এইচইআইএস) ‘পুনরুজ্জীবনমূলক (রিজেনারেটিভ) উন্নয়ন’ প্রচার করে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারে, যা ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার, সামাজিক সমতা উন্নীতকরণ এবং স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দেয়। সার্কুলার ইকোনমি, টেকসই নকশা এবং নৈতিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে শিক্ষা দিয়ে এইআইএস শিক্ষার্থীদের পরিবেশগত এবং সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল সমাধান তৈরি করতে প্রস্তুত করতে পারে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি, টেকসই কৃষি এবং সবুজ প্রযুক্তির মতো ক্ষেত্রগুলোর প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে এইচইআইএস পরিবেশগত প্রভাব কমানোর সমাধান বাতলাতে পারে। আজকের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে রপ্তানিমুখী শিল্পগুলো কেবল এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত উচ্চমানের পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে টিকে থাকতে পারে। তাই স্নাতকদের যেমন প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকা জরুরি, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তেমনি স্নাতকদের কর্মসংস্থানের উপযোগী এবং প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ করার ওপর মনোযোগ দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের কীভাবে বিপর্যয় মোকাবিলা করতে হয় এবং নেতিবাচক উন্নয়নমূলক প্রভাব এড়াতে হয় তা শেখানোও জরুরি। এটি অর্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের পাঠ্যক্রম এবং শিক্ষাদান পদ্ধতি সময়োপযোগী করতে হবে।

মোদ্দা কথা, বর্তমান সমস্যাগুলোর সমাধান এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি সুশিক্ষিত কর্মশক্তি নিশ্চিত করতে নীতিনির্ধারক, শিল্প নেতৃবৃন্দ, শিক্ষাবিদ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসক এবং সরকারের মধ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং উদ্ভাবনী কৌশল গড়ে তোলা প্রয়োজন। তবে একই সঙ্গে বিপুলসংখ্যক অদক্ষ শ্রমিকের কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। হয় তাদের দক্ষতা অর্জনের ব্যবস্থা করতে হবে, নতুবা তাদের এমন কোনো সেক্টরে কাজ করতে দিতে হবে, যেখানে অটোমেশনের প্রয়োজন কয়েক দশকে নেই।

দৈনিক সমকাল