চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিতে ‘রাষ্ট্র’ ব্যর্থ, জলজ্যান্ত প্রমাণ দিনমজুর রশিদ
Share on:
গত ৪ আগস্ট দুপুরে অন্তঃসত্ত্বা রোকেয়াকে নিয়ে দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতালে চেকআপ করতে গিয়েছিলেন দিনমজুর আবদুর রশিদ। স্ত্রীকে গাইনি ওয়ার্ডে রেখে নিচে টিকিট কেনার সময় হাসপাতাল কম্পাউন্ডের ভেতরে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। একদিকে দারিদ্র্য আরেকদিকে পরিবারপ্রধানের আকস্মিক এ গুরুতর আহতাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই দিশেহারা হয়ে পড়েন স্ত্রী।
উপায়ান্তর না পেয়ে তাই স্বামীর চিকিৎসার খরচ মেটাতে ২৫ হাজার টাকায় তিন দিনের শিশুটি বিক্রি করে দেন তিনি। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যে নাগরিকের চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ, তা বোঝার জন্য কোনো গবেষণার প্রয়োজন হয় না। মঙ্গলবার সমকালে প্রকাশিত আলোচ্য ঘটনা সংক্রান্ত প্রতিবেদনই যথেষ্ট।
শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আজ অবধি প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে শহীদ হয়েছেন ৬৩১ জন, আহত ২০ হাজার লোক। গুলিবিদ্ধ হয়ে চোখ হারিয়েছেন ৪০১ জন। হতভাগ্য আবদুর রশিদ সেই আহতদেরই একজন। এ আন্দোলনে কোনো কোনো পরিবার সর্বশেষ উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে সর্বস্বান্ত। সেদিক থেকে আবদুর রশীদ একটু হলেও ভাগ্যবান, তিনি অন্তত প্রাণে বেঁচে আছেন। কিন্তু বাংলাদেশ একটি ভয়াবহভাবে বৈষম্যভিত্তিক রাষ্ট্র। এটি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার মতো নাগরিকদের মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ। ফলে আবদুর রশীদ প্রাণে বাঁচলেও তাঁর এ বাঁচা এক প্রকার মরারই সমতুল্য। কারণ যে সন্তানকে ভূমিষ্ঠ করার আয়োজন করতে গিয়ে তিনি গুলি খেলেন, সে সন্তানকেই হারাতে হয়েছে তাঁকে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য অসংখ্য মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন। কিন্তু ৫৩ বছর পরেও কেন আমাদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতো এক রক্তাক্ত ইতিহাসের মুখোমুখি হতে হলো? এসব ঘটনা আসলে কী বার্তা দেয়? মূলত আমরা যে ভয়াবহভাবে পাশবিক, নিষ্ঠুর ও কদর্য রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে বসবাস করি, সে চিত্রই এসব ঘটনা তুলে ধরে। আরও বড় সত্য হলো, আন্দোলনে বিজয়ের ফলস্বরূপ নতুন এক সরকার গঠিত হলেও, আবদুর রশিদদের ভাগ্যের পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায় না।
আমাদের রাষ্ট্র স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠেছে বলে বিগত সরকার দাবি করেছিল। বাস্তবে আমরা নাগরিকদের জন্য চিকিৎসার মতো অত্যাবশ্যক প্রয়োজনটুকু এখনও মেটাতে পারছি না। এটি যে কোনো রাষ্ট্রের ব্যর্থতার মাপকাঠি হিসেবে দেখা যেতে পারে।বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে শহীদদের তালিকা প্রকাশ করেছে। ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, আন্দোলনে আহতরা বিনা পয়সায় শুধু চিকিৎসা নয়, উন্নতমানের চিকিৎসা পাবেন। কিন্তু আবদুর রশিদের ঘটনায় প্রমাণ হয়, বাস্তবতা ভিন্ন। দেশের কোনো কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন উদ্যোগ চলছে, এটা ঠিক। কিন্তু এসব উদ্যোগ কতটা শুধু রাজধানীতে সীমাবদ্ধ কিংবা কতটা আবদুর রশিদের মতো হতদরিদ্রদের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে– সে প্রশ্নও তোলা যায়।
আজ ১৪ সেপ্টেম্বর গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবারগুলো নিয়ে সরকার এক স্মরণসভা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যদিও ইতোমধ্যে তা স্থগিত করা হয়েছে। এতে খরচ ধরা হয়েছিল ৫ কোটি টাকা। কিন্তু এটা এমন সময়ে ঘটছে যখন ভুক্তভোগী অনেকেই টাকার অভাবে সুচিকিৎসা পাচ্ছে না।
সর্বশেষ খবর হলো, স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে ইতোমধ্যে রোকেয়া-রশিদ দম্পতির শিশুসন্তান মায়ের কোলে ফিরে এসেছে। প্রশাসন রশিদের চিকিৎসার ব্যাপারেও আশ্বাস দিয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে আনন্দের খবর। তবে বিষয়টা আরও আনন্দদায়ক হয়ে উঠবে যদি উপযুক্ত কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সরকার রশিদকে সপরিবারে একটা মানসম্মত জীবন যাপনের ব্যবস্থা করে দেয়।