চুক্তির আলোচনা স্থগিত ইইউর, দেশের অর্থনীতির চাকা অচল
Share on:
দেশের রফতানি আয়ের অর্ধেকেরও বেশি আসে মূলত পশ্চিমা বিশ্বের পাঁচটি দেশ—যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন ও ফ্রান্স থেকে। দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে পণ্য রফতানি থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কেননা পণ্য আমদানি, ঋণ পরিশোধসহ বৈদেশিক লেনদেনে বৈদেশিক মুদ্রাই ব্যবহার হয়।
সরকারের নানা উদ্যোগের পরও দেশের রফতানি বাজার উন্নত বিশ্বের গুটিকয়েক বাজারের ওপর নির্ভরশীল।
গত এক দশকে রফতানি বাজার ও পণ্যের বহুমুখীকরণে দেশের প্রচেষ্টা প্রত্যাশিত সুফল বয়ে আনতে পারেনি। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইন্টারনেট বন্ধ ও কারফিউর কারণে আমদানি-রফতানিসহ সব ধরনের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে প্রভাব পড়েছে। কয়েক দিনে যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তা পুনরুদ্ধার করাও কঠিন হবে।
দেশে রিজার্ভ সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির বিভিন্ন খাত নানা সংকট রয়েছে। এর মধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সহিংসতার ঘটনাগুলো নিয়ে প্রথম প্রতিক্রিয়া জানায় যুক্তরাষ্ট্র। এরপর জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করতে শুরু করে। এরপর সর্বশেষ বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে নতুন অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে আগামী সেপ্টেম্বরে যে আলোচনা শুরু হওয়ার কথা ছিল তা স্থগিত করেছে ইউরোপিয়ান কমিশন (ইসি)। দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে ইইউর এ অবস্থান এবং আলোচনা স্থগিতের সিদ্ধান্তকে পশ্চিমা বিশ্বের চাপের অংশ হিসেবেই দেখছেন নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্টরা। তাদের এ অবস্থানের কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, বাজার সুবিধা থেকে শুরু করে সব ধরনের সম্পর্কে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকবে। বর্তমানে দেশের অর্থনীতি এমনিতেই দুর্বল। এর মধ্যে তাদের এসব বার্তা অর্থনীতির জন্য খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে। সে বিষয়ে সরকারের সতর্ক হওয়া দরকার।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন ও ফ্রান্স বাংলাদেশ থেকে ২৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য কিনেছে। এটি দেশের মোট বার্ষিক ৫৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের ৫২ শতাংশেরও বেশি। এর মধ্যে রফতানির শীর্ষ গন্তব্য দেশ যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি থেকে রফতানি আয় আসে ১৭ শতাংশ। গত অর্থবছর জার্মানি থেকে রফতানি আয় হয়েছে ১২ দশমিক ৭৪ শতাংশ ও যুক্তরাজ্য থেকে ৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এছাড়া স্পেন ও ফ্রান্স থেকে রফতানি আয় হয়েছে যথাক্রমে ৬ দশমিক ৬২ ও ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ।
বাংলাদেশের রফতানিযোগ্য পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধার (জিএসপি) আওতায় ইইউতে শুল্কমুক্ত পণ্য প্রবেশাধিকার পায় দেশটি। এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে অর্থমূল্য বিবেচনায় বাংলাদেশের মোট পণ্য রফতানির ৪৫ শতাংশের বেশি যায় ইইউভুক্ত দেশগুলোয়। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর ২০২৬ সাল নাগাদ অঞ্চলটিতে জিএসপি প্লাস সুবিধা নিয়ে দরকষাকষি শুরু করবে বাংলাদেশ।
গত বছরের অক্টোবরে ব্রাসেলসে ইইউর গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরাম অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাংলাদেশ ও ইইউর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে নতুন অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরুর ঘোষণা দেয় ইসি। আগামী সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্ভাব্য এ চুক্তি নিয়ে প্রথম আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে এ আলোচনা স্থগিত করে ইইউ। এ আলোচনার অধীনে বহুমাত্রিক সুবিধার আশ্বাস ছিল। কিন্তু এমন একটা অবস্থায় ইইউর মতো বন্ধুপ্রতিম সংঘ আলোচনা স্থগিত করে, যা বাংলাদেশের জন্য খুবই নেতিবাচক আভাস। স্থগিতের এ ঘটনা দেশের অন্য সহযোগীরাও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে ও দেখবে। এর সম্ভাব্য অভিঘাত অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের ওপরও পড়বে। সুতরাং যেসব কারণে তারা আলোচনা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেসব বিষয় সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া উচিত হবে। যেসব কারণ তারা উল্লেখ করেছে সেগুলো সম্পর্কে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
দেশের বর্তমান সংকটের বিষয়ে বহির্বিশ্ব সবই জানে। তারা নিজেদের দূতাবাসের পাশাপাশি গণমাধ্যমসহ ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনেক তথ্য পাচ্ছে। দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু ও ধরপাকড়ের খবরে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইইউ উদ্বিগ্ন। তাই তারা এসব বিষয়ে স্বচ্ছ, পূর্ণাঙ্গ ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত চেয়েছে। পাশাপাশি ধরপাকড় যাতে প্রমাণভিত্তিক হয় ও হয়রানিমূলক না হয় সে বিষয়েও তারা জোর দিয়েছে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তারা পর্যবেক্ষণ করছে। এসব পরিস্থিতি বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি বিশালভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলবে। দেশে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি যেসব ঘটনা ঘটেছে সেসবের গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আস্থা ও বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করা। আশা করি, সরকার এসব বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।