গণপিটুনির মতো ‘ভয়ংকর বর্বরতায়’ জড়িতদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করুন
Share on:
বিদেশি ভাষা থেকে ধার করে যাকে ‘মব ট্রায়াল’ বলছি, তাকে বাংলায় বোধ হয় ‘উত্তেজিত জনতার বিচার’ বলা যায়, যদিও এটাকে পত্রপত্রিকা বা পুলিশি ভাষায় ‘গণপিটুনি’ বলেই উল্লেখ করা হতো।
সাম্প্রতিক কিছু নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কারণে এটি এখন ব্যাপকভাবে আলোচিত, যা সংঘটিত হয়েছে দেশের দুটি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে, সেখানকার শিক্ষার্থীদের দ্বারা, যাদের আমরা মাসখানেক আগেই জাতীয় বীরের আসনে বসিয়েছি। এ ঘটনায় চারদিকে সমালোচনা, নিন্দার ঢল নেমেছে। ব্যাপক উদ্বেগও দেখা যাচ্ছে, যা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এমন ঘটনা রোমহর্ষক হলেও একেবারে নতুন নয়, বরং প্রায় নিয়মিত। চুরির অভিযোগে এটা সবচেয়ে বেশি ঘটে; অন্যান্য কারণেও হয়। বিষয়টা এতই সচরাচর ঘটে যে, মৃত্যুর মতো চরম কিছু না ঘটলে তা খবর বলেই গণ্য হয় না।
এ দেশে চুরির আইনি প্রতিকার প্রায় অনুপস্থিত। অভিজ্ঞতা থেকে জানি, একজন আইনজীবীর বাসায় চুরি করতে এসে ধরা পড়ার পর তাদের বিরুদ্ধে তিনি মামলা করতে রাজি হননি ‘হয়রানির’ ভয়ে। পুলিশে ফোন করলে তারা বলেছে পিটুনি দিয়ে ছেড়ে দিতে। এমনও দেখেছি, মামলা ছাড়া পিটুনি দেওয়ার পরও অনুরোধ করে পুলিশ আনতে হয়েছে, যেন চোর ছেড়ে দেওয়ার পর চলে যাওয়ার সময় এলাকার অন্যদের পিটুনিতে মারা না যায়। কাজেই চুরির অপরাধে মারধর, গণপিটুনি এখানে আকসার ঘটে প্রধানত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার ব্যবস্থার অক্ষমতা, অবহেলার কারণে। এমনকি এটা বলাও অমূলক হবে না, এ ‘প্রথা’ তৈরি হওয়ার পেছনে তাদের সক্রিয় উৎসাহ রয়েছে।
পরিচিত একজনের আত্মীয় ছিল পুলিশের এসপি। তাঁর বাসা থেকে একবার গহনাগাঁটি, টাকা চুরি হয়; যার মধ্যে এসপির স্ত্রীর গহনাও ছিল। বেচারা কিছুদিন থানায় ঘুরে, তদবির করিয়ে ব্যর্থ হয়ে রণে ভঙ্গ দেন। এটা যদি পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পরিবার ও আত্মীয়দের অভিজ্ঞতা হয়, তাহলে অন্যদের কী অবস্থা? পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থা এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত– গুন্ডামি, চাঁদাবাজি, দখল, নারী নির্যাতনসহ সব ধরনের অপরাধ-অপকর্ম করে পার পাওয়া যায় অর্থ আর ক্ষমতা থাকলে। পাশাপাশি রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব। বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যা, নির্যাতন, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় করা কোনো অপকর্মের বিচার হয় না। এমনকি চাঞ্চল্যকর, জাতীয় পর্যায়ে আলোচিত, খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীকেও (লক্ষ্মীপুরের আওয়ামী লীগ নেতা তাহেরের ছেলে) রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদান করা হয়েছে (রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ) রাজনৈতিক কারণে। আদালত অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েও একজন বহাল তবিয়তে মন্ত্রিত্ব করে গেছেন বছরের পর বছর। আর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মন রক্ষা করেননি বলে একজন প্রধান বিচারপতিকে দেশ ছেড়ে নির্বাসনে যেতে হয়েছে। তার আগে গোয়েন্দা সংস্থার হাতে হেনস্তা হয়েছেন; দেশ ছাড়ার পর অভিযুক্ত ও দণ্ডিত হয়েছেন দুর্নীতির মামলায়।
এ দেশে গণপিটুনিতে নিহত কেউ বিচার পেয়েছেন– অন্তত আমি এমন কোনো নজির মনে করতে পারছি না। আইন-আদালতের ওপর অনাস্থার কারণে ভুক্তভোগীদের মধ্যে অপরাধীকে বাগে পেলে আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা প্রবল। দুর্বল কাউকে হেনস্তা করার সুযোগও আমরা ছাড়ি না। যদি কেউ জেলা-বিভাগীয় পর্যায়ের আদালতের সঙ্গে পরিচিত হন, তবে জানেন আদালতের বিচারপ্রার্থীদের বসার স্থানে কেউ বসে থাকাকালীন কোনো বিচারপ্রার্থী যদি কোনো ‘উকিলকে’ জায়গা ছেড়ে না দেন, তবে তারা কীভাবে সদলবলে ঝাঁপিয়ে পড়েন আর কী নির্মমভাবে তাঁকে হেনস্তা করেন (যা নিশ্চিতভাবে বেআইনি ও সম্ভবত শাস্তিযোগ্য অপরাধ)। যদি এ দেশের আইন, অধিকার সম্পর্কে অবহিত পেশাদারগোষ্ঠীর সদস্যরাই এমন আচরণ করেন, তবে অন্যদের অবস্থা তো সহজেই অনুমেয়।
বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থাহীনতা, গণপিটুনিতে অংশ নেওয়ায় শাস্তির ভয় না থাকা– এ দুটোর সঙ্গে মানুষের অন্তর্নিহিত প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা, বঞ্চনাপ্রসূত প্রতিহিংসা, সহিংসতা, নিষ্ঠুরতা ও সামষ্টিক আচরণ বা চরিত্র যোগ করলে তৈরি হয় এক ভয়ংকর সংমিশ্রণ, যা জনতাকে প্ররোচিত করে নিজের হাতে ‘বিচার’-এর দায়িত্ব তুলে নিতে; ‘ন্যায়বিচার’, জয় অথবা ক্ষমতার স্বাদ অনুভব করতে। যা মানুষ একা করতে অক্ষম, তা তার পক্ষে সম্ভব হয় দল বেঁধে। তার শিকার হয় অনেক দুর্ভাগা নিরপরাধ মানুষ।
এর অবসানের উপায় কী? যেহেতু এর মূল কারণ বিচারহীনতার সংস্কৃতি; ন্যায়বিচার বঞ্চনা-উদ্ভূত প্রতিকার পাওয়ার ইচ্ছা, তাই এর সমাধানে এটা নিশ্চিত করতে হবে– কেউ যেন অপরাধ করে পার পেয়ে না যায়। সেটা যে কোনো ধরনের অপরাধ, যে-ই করুক না কেন। অর্থাৎ আমাদের মনোযোগ দিতে হবে চুরি বা কাউকে হেনস্তাসহ ছোট-বড় সব অপরাধের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী যাতে প্রতিকার পায়, সেদিকে। পুলিশ যেন যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন এবং বিচার বিভাগ সব ধরনের প্রভাবমুক্ত হয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে, যা তাদের করার কথা। এ জন্য বিভাগ দুটোকে যেমন দুর্নীতিমুক্ত, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতিরও পরিবর্তন করতে হবে। তাদের দক্ষতা, জ্ঞান ও সচেতনতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি অধিকতর পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণের আওতায় আনতে হবে। মানুষের মনে যদি এ আস্থা আনা যায়– তারা বিচার ব্যবস্থার দ্বারস্থ হলে সুবিচার পাবে, তবে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়া, প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতা কমবে। পাশাপাশি গণপিটুনির মতো ভয়ংকর বর্বরতায় লিপ্ত তাদেরও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে সমাজের শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সব ধরনের মানুষের মধ্যে মানবাধিকার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।