গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে উন্নত ও বাসযোগ্য রাষ্ট্র নির্মাণের সুযোগ এসেছে
Share on:
দেশ স্বাধীনের আগে যে কয়টা আন্দোলন হয়েছে, বয়সে ছোট হলেও অনেকগুলোয় আমার অংশগ্রহণ ছিল। দশম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন ১৯৬২ সালে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই।
হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন প্রণীত রিপোর্টের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করেছিলাম। এরপর ছয় দফা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে মোটামুটি আমার ভালোই ভূমিকা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক (পূর্বে ইকবাল হল) হলের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলাম।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সূত্রপাত হয় আমাদের হল থেকেই। সেই আন্দোলনে আমার সামান্য ভূমিকা ছিল। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কোনো তুলনা হয় না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আর কোনো আন্দোলনে এত নৃশংসতা, বর্বরতা ও প্রাণহানি ঘটেনি। মুক্তিযুদ্ধে আমরা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার চেয়েছিলাম। ১৯৭১ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। সবাই চেয়েছিল যে বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করবেন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে সরকার গঠন করতে দেয়নি। আমাদের বঞ্চিত করে। শুধু বঞ্চিত করাই নয়, তারা সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছিল।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ২০২৪ সালে এসেও মানুষকে তার অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে হয়েছে। শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার নিয়ে যে আন্দোলন শুরু করেছিল, তা রোগের উপসর্গ। আর রোগ হলো মানুষের বঞ্চনা, অধিকারহীনতা, ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া, নগ্নভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের বর্বরতা। আওয়ামী সরকারের শাসনামলে আবরার হত্যাসহ বিভিন্ন অন্যায়, অবিচার, বঞ্চনা, নিপীড়ন, নির্যাতন, অধিকারহীনতা দিন দিন বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। মূলত এগুলোই রোগ। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
আমি জুলাই ও আগস্টের সহিংসতার সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কোনো তফাত দেখি না। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল। আমরা অধিকার চেয়েছিলাম, তারা অধিকার দিতে চায়নি। কারণ তাদের স্বার্থ জড়িত ছিল। কিন্তু আমরা এখন একই দেশের নাগরিক। আমাদের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। দেশের ছাত্রসমাজ অধিকারের জন্য লড়াই করেছে, সে অধিকার তো আমাদের সবার এবং সবার স্বার্থে। উন্নত সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যেই করেছে। সরকার ইতিহাসের নৃশংসতম বর্বরতার মাধ্যমে চার শতাধিক শিক্ষার্থী, শিশু ও কিশোরসহ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে।
আহত করেছে কয়েক হাজার ব্যক্তিকে। গ্রেফতার করেছে হাজার হাজার ব্যক্তিকে। তারা শুধু যে খুনখারাবি করেছে তা-ই নয়, পুরো দেশটাকেই কারাগারে পরিণত করেছে। তাই আমি মনে করি, এসব কর্মকাণ্ড যারা করছেন তাদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কোনো তফাত নেই, যা আমাকে ব্যথিত করে, আমাকে ক্ষুব্ধ করে, প্রতিবাদী হতে আমাকে উৎসাহিত করেছে। এসব হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই কাম্য নয়। ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতন ঘটেছে। পতনের পর দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। দেশের বিভিন্ন স্থানে থানা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পুলিশকে হত্যা করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এখন প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারাই দায়ী তাদের শাস্তির আওতায় আনা জরুরি।
বর্তমানে দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৃত ছাত্ররাজনীতি নেই। প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের ছাত্র সংগঠনকে লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত করেছে। আমি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম, কিন্তু ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের কারণে সেই পরিচয় দিতে এখন আমার লজ্জা লাগে। বর্তমানে ছাত্র সংগঠনগুলোর কোনো নীতি কিংবা আদর্শ নেই। রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে ছাত্র সংগঠনগুলোকে অপব্যবহার করছে।
তাদের দিয়ে অন্যায়, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করানো হয় এবং তারা নিজেরাও এর থেকে লাভবান হয়। আগের ও বর্তমানের ছাত্ররাজনীতি এক নয়। আমাদের সময়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো। এর মাধ্যমে নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ হতো। ছাত্রনেতারা শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে কাজ করত। আমরাও ছাত্রদের সুযোগ-সুবিধা ও কল্যাণে কাজ করেছি।
আর এখন চলছে দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি, অধিকার হরণ, বিভিন্নভাবে নিগ্রহ ও নিপীড়ন। বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার একজন মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। তার প্রাণহানি ঘটল কেন? লেজুড়বৃত্তি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে তা হয়েছে। ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ নেতা জসিম উদ্দিন মানিক উরফে সেঞ্চুরিয়ান মানিক শততম ধর্ষণ প্রকাশ্যে উদযাপন করে।
তার কোনো বিচার হয়নি, বরং তাকে নিরাপদে পালাতে (সেফ এক্সিট) সাহায্য করা হয়েছে। তথাকথিত ছাত্ররাজনীতির নামে একের পর এক অন্যায়গুলোই এখন মহীরুহে পরিণত হয়েছে। এগুলোই হলো রোগ। আর কোটা সংস্কারের দাবিতে হওয়া আন্দোলন রোগের উপসর্গ। যেমন কারো যদি জ্বর কিংবা ম্যালেরিয়া হয়, তখন প্যারাসিটামল খেলে জ্বর কমে যাবে। কিন্তু আবার ফিরে আসবে। কারণ রোগ নির্মূলের চিকিৎসা হচ্ছে না, বরং ওষুধ খেয়ে রোগকে থামিয়ে রাখা হচ্ছে।
তেমনি তারা ধারালো অস্ত্র ও বল প্রয়োগ করে মানুষের অধিকার আদায়ের দাবিকে থামিয়ে রাখার চেষ্টা করছে না বরং ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। এর পরিণতি ভয়াবহ। আর তারা যা করেছে, তা সম্পূর্ণ বেআইনি। ছাত্ররাজনীতির নামে যে গুণ্ডামি, মানুষের অধিকার হরণ, বাকস্বাধীনতা হরণ, মানবাধিকার হরণ তথা অপরাজনীতি করছে—এগুলো তো দণ্ডনীয় অপরাধ। শুধু তা-ই নয়, গণপ্রতিনিধিত্ব আইন (আরপিও) অনুযায়ী, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সহযোগী সংগঠন থাকা কিন্তু বেআইনি। দেশের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেছে ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিকের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি। ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির কারণেই শিক্ষার মানে বড় ধরনের ধস নেমেছে।
এসব বিবেচনায় ২০০৭ সালে যখন আরপিও সংশোধন করা হয়, তখন অঙ্গ সহযোগী সংগঠন বিলুপ্ত করার একটা বিধান তাতে যুক্ত করা হয়। আরপিওর ৯০-বি ধারায় বলা আছে, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের বিধান থাকতে পারবে না। আমাদের এ দেউলিয়াপনার রাজনীতি তাদের গঠনতন্ত্র থেকে বাদ দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাদের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নামে সেই লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি অব্যাহত রেখেছে।
ফলে নির্বিচারে ও বিনা দ্বিধায় আইন লঙ্ঘন করে যাচ্ছে তারা। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন (ইসি) নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। আরপিও লঙ্ঘনের দায়ে ইসি চাইলেই নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করতে পারত। এ সংগঠনগুলো বিলুপ্ত না করলে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনই বাতিল করা উচিত। জুলাই ও আগস্টে দেশে যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে তা হতে পারে না।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিন বদলের সনদে’ দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন, সম্পদের হিসাব দেয়া, দলীয়করণমুক্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু অঙ্গীকার ভঙ্গ করে তারা চরম দলীয়করণ করেছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী এখন দলীয় বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। তাদের মাধ্যমে মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। তারা জনগণের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলীয় লাঠিয়াল বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। যেকোনো যৌক্তিক প্রতিবাদ ও অসন্তোষ দমন করা হয়েছে। তারা পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচনে মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে ক্ষমতায় এসেছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন এবং ইসির সহযোগিতায় ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ মধ্যরাতের ভোটে ও আঁতাতের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। ২০২৪ সালের নির্বাচনটিও একইভাবে করেছিল। ফলে জনগণের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। জনগণেরও তাদের প্রতি আস্থা নেই। অনিয়ম ও পেশিশক্তি ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকার কারণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা কমেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনে মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা দুই ধরনের—সমান্তরাল ও নিম্নমুখী। নিম্নমুখী দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হয় ভোটের মাধ্যমে। প্রতি পাঁচ বছর পর জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার ও প্রত্যাখ্যানের সুযোগ থাকলে সেটা নিম্নমুখী দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
আরেকটি হলো সমান্তরাল দায়বদ্ধতা। সেখানে জনগণের স্বার্থ ও কল্যাণের পরিবর্তে যারা তাদের ক্ষমতায় এনেছে ও ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে তাদের স্বার্থই গুরুত্ব পায়। সেখানে জনগণের স্বার্থ মুখ্য নয়। এ কারণে বেনজীর আহমেদ ও মতিউর রহমানের মতো ব্যক্তিরা অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন এসব করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। ফলে আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোই ভেঙে গেছে। তাই ২০১৮ সালের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনে তরুণদের স্লোগান ছিল রাষ্ট্র মেরামতের।
আওয়ামী সরকারের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ব্যাপকভাবে দলীয়করণ ও পক্ষপাতদুষ্ট করা হয়েছে। আদালত থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান ক্ষমতাসীনদের স্বার্থেই কাজ করে। তারা সাধারণ মানুষের স্বার্থে কাজ করে না। সাধারণ মানুষ যেখানেই যায়, সেখানেই প্রতি পদে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথাই বলা যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল একটি রাজনৈতিক সমঝোতা। আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেছিল, ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছিল। বিএনপি বাধ্য হয়ে এটি ১৯৯৬ সালে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। বিএনপি এটি নিয়ে খেলার চেষ্টা করেছে, এটিকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করেছে। তাতে তারা সফল হয়নি। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই বাতিল করে দিয়েছে। ফলে যেই রাজনৈতিক সমঝোতা হয়েছিল, সেটিই আওয়ামী লীগ ভেঙে দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বিএনপি প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। তারা বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়েছে।
বিএনপির পছন্দসই বিচারপতি পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারে পদায়ন হবেন—এ রকম আকাঙ্ক্ষা থেকেই বিএনপি সেটি করে। এটা ঘৃণিত ও অগ্রহণযোগ্য কাজ ছিল। এর মাশুল শুধু তারাই দেয়নি বরং পুরো জাতি দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে পুরো তত্ত্বাবধায়ক সরকারই বাতিল করে দিল।
অথচ আওয়ামী লীগের ইশতেহারে ছিল এ ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করা। অসাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের জন্য ১৯৯১ সালের সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতে গণভোটের বিধান ছিল। সেটিও মানা হয়নি।
আইনে আছে রাজনৈতিক বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়, আদালতের বিষয় নয়। কোটা সংস্কার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আদালতের বিষয় নয়, এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় ছিল। অথচ এসব বিষয়ে আদালতের হস্তক্ষেপ করার কথাই ছিল না। কিন্তু তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে যে রায় দিলেন, সেটি পুরো ইতিহাসকে বদলে দিল। বাংলাদেশের এ বিপদের জন্য যদি কাউকে দায়ী করতে হয়, তাহলে খায়রুল হকের সেই কলঙ্কিত রায়ের জন্য দায়ী করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিষয়টি পাতানো খেলা ছিল।
বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা, সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, ভোটাধিকারসহ রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা এবং কতগুলো নাগরিক অধিকার সমুন্নত রাখার জন্য ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ দিয়েছেন। আওয়ামী শাসনে রাষ্ট্রের পুরো কাঠামো ভেঙে পড়েছে। রাষ্ট্রকে মেরামত করতে হবে।
আমরা একটি পথ হারানো জাতি। আমাদের সামাজিক চুক্তি নেই। সামাজিক চুক্তি অর্থ সমাঝোতা ও সকল অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে ঐকমত্যে পৌঁছি, সেটা সকলের জন্য কল্যাণকর। রাষ্ট্র মেরামতের জন্যই সামাজিক চুক্তি দরকার। এটা সুস্পষ্ট যে মানুষের যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ দিনে দিনে বাড়িয়েছে দেনা, শোধিতে হইবে দেনা। এখন আওয়ামী সরকারের পতন ঋণ শোধ করার সুযোগ করে দিয়েছে।
সামাজিক চুক্তির কতগুলো সুনির্দিষ্ট সংস্কারের জন্য ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। আমরা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর পক্ষ থেকে একটি জাতীয় সনদ প্রণয়ন করেছিলাম। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগেও আমরা চেয়েছিলাম রাজনৈতিক দলগুলো ও সারা দেশের সব অংশীজনের মধ্যে সংলাপ ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কতগুলো বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাক। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ তাতে কর্ণপাত করেনি। জাতীয় সনদে কী কী বিষয় আলোচনা হওয়া ও সামাজিক চুক্তির অংশ হওয়া দরকার—সেই আলোচ্যসূচিগুলো সেখানে আলোচনা করেছি। কেউ চাইলে যুক্ত-বিযুক্তও করতে পারে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর একটি অভূতপূর্ব, অভাবনীয় ও অকল্পনীয় বিজয় অর্জন হয়েছে। অনেকের মতে, এটি আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। গত ১৫ বছর আমরা অনেকটা কারাগারের মধ্যে ছিলাম। এ সময় আমরা আমাদের বাকস্বাধীনতা ও অন্যান্য নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলাম। আমাদের তরুণরা মুক্তিযোদ্ধাদের যোগ্য উত্তরসূরি। এ বিজয়ের মাধ্যমে একটি নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রকে নতুন করে মেরামতের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, উন্নত ও বাসযোগ্য রাষ্ট্র নির্মাণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। জনগণ দায়িত্বশীলতার পরিচয় না দিলে এ সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে।