গাজায় গণহত্যায় মার্কিনিদের জবাবদিহিতার এখনই সময়
Share on:
প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে তার নিচের ১০টি দেশের সম্মিলিত ব্যয়ের চেয়েও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় বেশি। স্বাভাবিক কারণেই আন্তর্জাতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র আধিপত্য বিস্তার করে আছে। কিন্তু দেশটি কোনো কল্যাণকর সাম্রাজ্য নয়। এমনকি নিজেকে বিক্রি করতেও দেশটি কুণ্ঠিত নয়।
৯/১১-এর পর দেশটি যে অন্তহীন যুদ্ধের জগতে প্রবেশ করেছে, এখনও তা অব্যাহত আছে। গণহত্যা সংঘটনে অর্থায়ন ও অস্ত্র তৈরি করছে দেশটি। এর মাধ্যমে গত কয়েক দশকব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক অধঃপতন এখন একেবারে তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে।
সম্প্রতি একটি বক্তৃতার শেষে একজন আমাকে প্রশ্ন করেন, গাজা কেন ভিন্ন? তিনি গাজায় দখলদারিত্বের বর্বরতা বিষয়ে আন্তর্জাতিক মনোযোগ ও নিষ্ক্রিয়তার কথাও বলছিলেন। নিশ্চয় সেখানে ধর্মীয় বিষয় আছে। মুসলমানরা স্বাভাবিকভাবেই ফিলিস্তিনকে পবিত্র ভূমি হিসেবে সম্মান করে; একইভাবে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের কাছেও এটি পবিত্র।
এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতও রয়েছে। সাত দশকেরও অধিক সময় ধরে ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরায়েল দখল কায়েম করে চলেছে। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি অবৈধ বসতি স্থাপন অব্যাহত আছে। একই সঙ্গে দেশটি ফিলিস্তিনে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করছে, তার তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে এর মাত্রা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে অন্য জেনোসাইডের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো, ইসরায়েল সংঘটিত জেনোসাইডের সবকিছুই প্রচার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের একজন পরামর্শক নি ঘ্রালাই যেমনটা উল্লেখ করেছিলেন, এটি ‘লাইভ সম্প্রচারিত জেনোসাইড’। তিনি বলেছিলেন, ইতিহাসে এটিই প্রথম জেনোসাইড, যেখানে এর ধ্বংসযজ্ঞ প্রতিনিয়ত প্রচারিত হচ্ছে।’ আপনার মোবাইল ফোন, কম্পিউটার স্ক্রিন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনি এই হত্যাযজ্ঞ দেখছেন। সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষ হাজার হাজার মৃত ফিলিস্তিনি শিশুর বিকৃত লাশের দৃশ্য উপেক্ষা করতে পারে না।
হাজার হাজার নিরীহ বেসামরিক মানুষ হত্যায় যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার ঘটনা এই প্রথম নয়। আমেরিকার সমরযন্ত্র প্রথমে আফগানিস্তান, এর পর ইরাকে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। এ দু’দেশে তারা কতটা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তা কখনোই বলা হবে না। ২০২০ সালে ‘ফ্রিডম অব ইনফরমেশন অ্যাক্ট’-এর অধীনে নিউইয়র্কার ম্যাগাজিন ২০০৫ সালে সংঘটিত ইরাকের হাদিথা গণহত্যার ছবি পেতে অভিযুক্ত নৌবাহিনী, মেরিন সৈন্য ও ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ডের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। ওই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের নৌ সেনারা ২৪ ইরাকি পুরুষ, নারী ও শিশুকে হত্যা করে। সেখানে অল্প বয়সীদের মধ্যে ৩ বছরের মেয়েও ছিল। তা ছাড়া আব্দুল্লাহ নামে ৪ বছরের এক শিশুও ছিল; ছয় ফুট দূর থেকে মাথায় গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। চার বছর আইনি লড়াইয়ের পর মার্চ মাসে মার্কিন কর্তৃপক্ষ সেই হত্যাকাণ্ডের ছবি প্রকাশ করে। কিন্তু অপরাধীরা শাস্তির বাইরেই আছে। হাদিথা গণহত্যা কেবল আমেরিকার দখলদারিত্বের ছোট্ট উদাহরণই নয়, বরং পশ্চিমাদের নৃশংসতারও নজির। তারা জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এবং মুসলিম বিশ্বে তার ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে এসব করেছিল।
গত সপ্তাহে আলজাজিরার সেন্টার স্টেজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মিডলইস্ট আইর প্রধান সম্পাদক ডেভিড হার্স্ট পশ্চিমা বিশ্ব সম্পর্কে এমন সময়ে এক বোমা ফাটিয়েছেন, যখন তারা গাজা হামলার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। তিনি বলেছিলেন, ‘গত তিন দশকে পশ্চিমা (উদার) জোটের কিছুই পরিবর্তন হয়নি। আফগানিস্তান ও ইরাকের অন্তহীন যুদ্ধ থেকে শুরু করে বারাক ওবামার ‘নোট বুটস অন দ্য গ্রাউন্ড’ তথা সরাসরি সৈন্যদের দ্বারা যুদ্ধ না করেও ইয়েমেন, পাকিস্তান ও সোমালিয়ায় ড্রোন হামলা চালিয়েছিল। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের চেতনার মৃত্যু আগেই হয়ে গিয়েছিল। এখানে কেবল হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞই হয়নি, বরং এটা ছিল ঔদ্ধত্য ও ভন্ডামি।
মোট কথা, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের ব্যাপারে আমেরিকা কোনো মধ্যস্থতাকারী বা সালিশদার হতে পারে না। আমেরিকা বরং ইসরায়েলকে সমর্থনকারী। আমেরিকা ঐতিহাসিক আধিপত্যবাদ থেকে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে প্রায়ই যুদ্ধাপরাধে জড়িত হচ্ছে। তাই নিজের সরকারকে আমেরিকানদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করার এখনই সময়।