মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: মঙ্গলবার ১০, সেপ্টেম্বর ২০২৪

খেলাপি ঋণ আদায়ে বাংলাদেশের সামনে যত চ্যালেঞ্জ!

Share on:

ইদানীং মন্দ ঋণ ও সেগুলো আদায় নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ আদায় নিয়ে কথা বলার আগে বলতে হয়, আমাদের দেশে ব্যাংক ঋণ মন্দ হয় কেন বা কীভাবে?


দীর্ঘদিন দেশে-বিদেশে একজন ঋণ পরিদর্শক বা ঝুঁকি ব্যবস্থাপকের কাজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, ঋণ প্রধানত মন্দ হয় ঋণঝুঁকি পর্যালোচনার (গ্রাহক বা প্রতিষ্ঠান তার ব্যবসায়ের আকার ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় কত ঋণ পাবে, অন্য ব্যাংকে তার কত ঋণ আছে কিংবা এ ধরনের ব্যবসায়ের ট্রেড সাইকেল বা বাণিজ্যচক্র কী অথবা এ ধরনের ঋণের বিপরীতে জামানত বা সহজামানত কী হতে পারে) দুর্বলতায়, সঠিক কাঠামো মেনে ঋণ প্রদানে অক্ষমতা, ঋণের বিপরীতে সঠিক ও কার্যকর জামানতের অভাব, ব্যবসায়টির অভ্যন্তরীণ নগদ সঞ্চালন (ইন্টারনাল ক্যাশ জেনারেশন হিসেবে পরিচিত) পর্যাপ্ত না হলে এমনকি বিভিন্নমুখী প্রতিযোগিতার মুখে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার সক্ষমতার অভাব বা প্রতিযোগীদের অন্যায্য বাণিজ্য–সুবিধা দেওয়া হলে।

সেই সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিবেচনায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঋণ বিতরণ এবং ব্যবসায়ের সঠিক উত্তরাধিকারের অভাবকে যোগ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ঋণঝুঁকির পাশাপাশি প্রচুর জালিয়াতি ও ফটকাবাজির আলোকে ব্যবসায়ের পরিচালন ঝুঁকি এবং বাজারে মূল্যের উত্থান-পতনের আলোকে বাজারঝুঁকিকেও বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।

আমাদের দেশে অবশ্য রাজনৈতিক আনুকূল্যে প্রদত্ত ঋণ বা ওপর থেকে আদিষ্ট হয়ে অনেকটা চোখ বন্ধ রেখে ঋণ প্রদানের পরিমাণটাও বিগত সরকারের আমলে অনেক বেড়ে যেতে দেখেছি। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত কিংবা সরকারঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয়। সাম্প্রতিক কালে বেসিক ব্যাংক, জনতা ও সোনালী ব্যাংকের বিরাট অঙ্কের খেলাপি ঋণ তার প্রমাণ। অন্যদিকে আবার বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে ঋণঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বা ঋণ নজরদারি বিভাগের দুর্বলতায়ও অনেক সময় মন্দ ঋণের পাহাড় গড়ে ওঠে। কী কী শর্তে বা জামানত বিবেচনায় ঋণ দেওয়া হয়েছিল, তা পরবর্তী অনেক সময়েই ঋণ প্রশাসন বা ক্রেডিট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের নজরদারিতে আসে না। সে কারণে বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ কোটি টাকা মোট ব্যাংকঋণের মধ্যে শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ সরকারিভাবে ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। অপর দিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অনুরোধে দুর্বল জামানত এবং ঋণের ব্যবহার বিবেচনায় ফেরত আসার সম্ভাবনা কম, এমন ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকা বলে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্ট্রেস টেস্টে বেরিয়ে এসেছিল।

আইএমএফ অনেক দিন ধরেই সংখ্যাটি ২০ শতাংশের ওপর, এমনকি ২৫ শতাংশ বলে অনুমান করে আসছিল। বারবার কোভিড, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ব্যবসায়ের মন্দাবস্থা বিবেচনায় ঋণ পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন ছাড়ে পরিমাণটা অনেক বড় আকার ধারণ করেছে বলে অনেকের ধারণা।

খেলাপি ঋণ আদায়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলে সম্প্রতি আবারও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন নতুন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। তাঁরা জানিয়েছেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, তিনি বা তাঁর গ্রুপভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে ঋণ–সুবিধা পাবে না। পাশাপাশি জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া কোনো ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণও হবে না। তবে এসব কথা আমরা আগেও অনেকের কাছে শুনেছি। এমনকি সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের কাছ থেকেও। ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে বর্তমান আইনানুযায়ী অর্থ আদায়ের বিকল্প নেই এটি যেমন সত্যি, তেমনটি শর্ষের মধ্যেই ভূত রয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণের পথ বন্ধের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তা প্রশংসাযোগ্য হলেও কার্যকর করতে এখনো অনেক দ্বিধা রয়েছে।

আমরা জানি, দুর্বল ভিত্তির ওপর বিতরণকৃত বা প্রদত্ত অনেক ঋণের অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। তাই দেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনা গেলে মন্দ হয়ে যাওয়া ঋণ পরিশোধে যেমন কাজে লাগানো যেত, তেমনই দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলেও অনেকেই বলেছেন ও বলছেন। তবে সুকঠিন কাজটি কীভাবে শুরু করব আর কীভাবে শেষ করব, তার তরিকা এখনো কারও কাছে স্পষ্ট নয়। সেই সঙ্গে দুর্বল নীতি পরিবেশ এবং রাজনৈতিকভাবে আনুকূল্যপ্রাপ্ত বড় ও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান না নিয়ে একে কীভাবে কার্যকর করা হবে, সেটা নিয়েও কোনো পরিষ্কার ধারণা এখনো নেই।

অন্যদিকে আবার আইনি জটিলতা এড়িয়ে শক্ত অবস্থান নিলেও মন্দ ঋণ আদায় হবে, এমন গ্যারান্টি নেই। যেকোনো ঋণ আদায় মামলা গঠন করতেই অনেক সময় লেগে যায়। অনেক দেশেই ধমক বা শাসানি কোনো কাজ দেয়নি। উপরন্তু অভিযোগ রয়েছে, মন্দ ঋণ সৃষ্টিতে ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের আঁতাত।

অন্যদিকে আইনি লড়াইয়ে গিয়ে কোনো দেশেই মন্দ ঋণ পুরো আদায়ের নজির নেই। কিছু কিছু দেশে এটা সম্ভব হলেও তা অনেক অনেক দিনের আইনি লড়াই ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংস্কার কার্যক্রমের ফল। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পদ ব্যবস্থাপক, হিসাব বা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পৃক্ততাও গণচীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতে অনেক কাজ দিয়েছে। ভারতে আইবিসি (ইনসলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাংক্রাপসি কোড), দক্ষিণ কোরিয়া ও গণচীনে যুক্তরাষ্ট্রের কার্লাইল নামের সম্পদ ব্যবস্থাপকের কাজের মাধ্যমে অনেক মন্দ ঋণ পুনর্গঠন করে লাভজনকভাবে বিক্রি করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। শ্রীলঙ্কা ও গ্রিসেও অর্থনৈতিক সংকটে ঋণ পুনর্গঠনে বিশেষ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আলভারেজ অ্যান্ড মার্শাল ভালো কাজ করেছে। ইন্দোনেশিয়ায় বিশ্বব্যাংক নিজেই এ ক্ষেত্রে অনেক ভালো কাজ করেছে। ভারত এ ক্ষেত্রে বড় হিসাব প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৃহৎ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত করেছে। এতে ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকেরও ব্যাপক উৎসাহ ছিল।

তাই আমাদের এখন প্রয়োজন ঋণ আদায়ের প্রচলিত চৌহদ্দির বাইরে গিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ, আর্থিক খাতের সংস্কার, ব্যবসায় খাতে অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিতকরণ আর নীতি প্রশাসনের রাজনীতি থেকে দূরে থেকে কাজের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি।

অনেকের মতো আমারও ধারণা, মন্দ ঋণ আদায় ও ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ব্যাংক তথা বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রচলিত নীতিমালাগুলো অনুসরণ করেই খেলাপি ঋণ আদায়ে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। তবে সে ক্ষেত্রে অহেতুক হস্তক্ষেপ বন্ধেরও নিশ্চয়তা প্রয়োজন। বিষয়টি অনেক অনেক কঠিন হয়ে যায়, যখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দ্বারা অনেক বেশি প্রভাবিত হয়ে পড়ে কিংবা উৎকোচ সংস্কৃতিতে জড়িয়ে যায়। বাংলাদেশে ব্যাংক পরিচালকেরাও রাজনীতিবিদের মতো আচরণ করেন কিংবা স্থূল গোষ্ঠীস্বার্থের বাইরে যেতে পারেন না।

নতুন শাসন বা নীতি পরিবেশে আমরা অবশ্য আশায় বুক বেঁধে আছি। এ ছাড়া আর কোনো উপায় আছে বলেও মনে হয় না। আর্থিক খাতে দুষ্ট পুঁজির দোর্দণ্ড প্রতাপ হ্রাস না করতে পারলে অর্থনীতিতে সামগ্রিক জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার কাজেও আমরা পিছিয়ে পড়ব। আবারও ব্যর্থতার গ্লানি আমাদের পেয়ে বসবে।

প্রথম আলো