মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: বুধবার ২৫, সেপ্টেম্বর ২০২৪

খেলাপি ঋণের সংকট মোকাবিলায় ট্রাইব্যুনাল গঠন করুন

Share on:

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার উৎখাত হওয়ার পর গত দেড় মাসে খেলাপি ব্যাংক ঋণ ও পুঁজি পাচার সম্পর্কে যেসব তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ হচ্ছে, সেগুলো পুরো জাতিকে স্তম্ভিত করে দিচ্ছে।


মার্কিন গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির তথ্য উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের নবনিযুক্ত গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দাবি করেছেন, গত সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে ১৫০ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। কেবল একটি শিল্পগোষ্ঠীই দেশের অন্তত সাতটি ব্যাংকের মালিকানা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ বা পাচার করেছে। আমি অনেকবারই বলেছি, এক ব্যক্তি বা শিল্পগোষ্ঠী দেশের সাতটি ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করছে– এমন নজির বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্প উপদেষ্টার মালিকানাধীন একটি শিল্প গ্রুপের নামেও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৩৬ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। এর বড় অংশই খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা। হাইকোর্ট ইতোমধ্যে গ্রুপটির সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানায় ‘রিসিভার’ নিয়োগের আদেশ জারি করেছেন, যাতে ব্যাংকের ঋণ যদ্দূর সম্ভব ফেরত আনা যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানিয়েছেন, ব্যাংক খাত সংস্কারে কমিশন গঠনের পরিবর্তে দ্রুত তিনটি টাস্কফোর্স হবে। এগুলোর একটি খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনা; বাংলাদেশ ব্যাংক শক্তিশালীকরণ; অপরটি পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার বিষয়ে কাজ করবে। আমি মনে করি, সব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে অচিরেই একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হোক।

১৯৯৮ সালে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদও এমন ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কারণ দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যায় না। তাই রায় বাস্তবায়নে বিলম্ব হয় না। যদিও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের রাষ্ট্রপতির পরামর্শে কর্ণপাত করেননি।

গত ২৬ বছর ধরে আমিও খেলাপি ঋণ সংকট মোকাবিলায় ট্রাইব্যুনাল স্থাপনে জোরালো আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু বিএনপি বা আওয়ামী লীগ; কোনো সরকারই তাতে সাড়া দেয়নি। অথচ ক্রমশ খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে পুরো ব্যাংকিং সিস্টেমই ধসে যাওয়ার উপক্রম। পুঁজি পাচারও ক্রমশ অর্থনীতিকে ফোকলা করে দিচ্ছে। এখন যখন অপশাসন উৎখাত হয়ে গেছে এবং রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি ও পুঁজি পাচারকারীরা পালিয়ে গেছে কিংবা গ্রেপ্তার হয়েছে, তাই খেলাপি ঋণ ও পুঁজি পাচার মোকাবিলায় ট্রাইব্যুনাল গঠনে আর বিলম্ব সমীচীন হবে না।

গত ৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক ক্লাসিফায়েড লোনের সর্বশেষ হিসাব প্রকাশ করেছে। এ হিসাবে ক্লাসিফায়েড লোনের পরিমাণ ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি। কিন্তু এটা খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ নয়। কারণ অর্থঋণ আদালত, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে খেলাপি ঋণের যেসব মামলা বছরের পর বছর বিচারাধীন, সেগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত ক্লাসিফায়েড লোনের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। এ রকম খেলাপি ঋণের পরিমাণ ইতোমধ্যে আড়াই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

অন্যদিকে যে পুরোনো মন্দ ঋণগুলোকে ‘রাইট অফ’ বা অবলোপন করা হয়, সেগুলোকেও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত ক্লাসিফায়েড লোনের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। আমরা জানি, রাইট অফ করা মন্দ ঋণের পরিমাণও কয়েক মাস আগেই ৬৫ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। এই দুটো ক্যাটেগরির খেলাপি ঋণ বিবেচনায় নিলে এর প্রকৃত পরিমাণ ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

আরও অনেক মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ (ওভারডিও লোন) বারবার অবৈধভাবে রিশিডিউলিং করে লুকিয়ে ফেলার ‘কালচার’ ব্যাংকিং সিস্টেমে বহু বছর ধরে গেড়ে বসে রয়েছে, যেগুলোর পরিমাণ জানা প্রায় অসম্ভব বলা চলে। এসব ব্যাপার বিবেচনা করে ‘দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকা সম্প্রতি দাবি করেছে, ব্যাংকিং সিস্টেমের খেলাপি ঋণের আসল পরিমাণ ৭ লাখ কোটি টাকারও বেশি। এর মানে, দেশের ১৮ লাখ কোটি টাকা মোট ব্যাংক ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশই এখন প্রকৃতপক্ষে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। এর সিংহভাগ যে বিদেশে পাচার হয়ে যেতে পারে, সেটা সহজেই অনুমিত।

২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই আ হ ম মুস্তফা কামাল একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে খেলাপি ব্যাংক ঋণ সমস্যাকে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলার প্রয়াস শুরু করেছিলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর পদক্ষেপ ছিল খেলাপি ঋণের মাত্র ২ শতাংশ ফেরত দিলে পরবর্তী ১০ বছরে আর ঋণগ্রহীতাকে ঋণখেলাপির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না মর্মে সিদ্ধান্ত। এই অভূতপূর্ব পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশের রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের বাঁচিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এর পর পাঁচ বছর ধরে আরও অনেক পদক্ষেপ নিয়ে খেলাপি ঋণ লুকানোর ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও তা ভয়াবহভাবে বেড়ে চলেছে।

মাঠ পর্যায়ের গবেষণা থেকে জানতে পেরেছি, ঋণখেলাপিদের ৮২ শতাংশই ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি’। এর মানে, ৮২ শতাংশ ঋণখেলাপি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে– তারা তাদের আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে এই ঋণ ফেরত না দিয়ে আত্মসাৎ করে ফেলতে পারবে।

আমি বেশ কয়েক বছর ধরে সরকারকে সাবধান করে চলেছি, আমদানি বাণিজ্যের ওভার ইনভয়েসিং, রপ্তানি বাণিজ্যের আন্ডার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না এনে বিদেশে রেখে দেওয়ার মতো পুঁজি পাচার পদ্ধতিও বিদ্যমান। সেটাকে টেক্কা দিয়ে হুন্ডি পদ্ধতিতে অর্থ পাচার চলেছে দেদার। খেলাপি ঋণ সমস্যার প্রধান কারণও হুন্ডি পদ্ধতিতে ক্রমবর্ধমান ব্যাংক ঋণ ও পাচার। বহুদিন থেকেই আমি বলে চলেছি, হুন্ডি ব্যবস্থাকে কঠোরভাবে দমন না করলে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো কঠিন হয়ে যাবে।

খেলাপি ঋণ ও পুঁজি পাচার দমনে আমি বিভিন্ন সময়ে নানা ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছি। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এ ব্যাপারে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অথচ ২০২১ সালের আগস্ট মাসের ৪৮.০৬ বিলিয়ন ডলার থেকে বিপজ্জনকভাবে কমতে কমতে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ‘গ্রস রিজার্ভ’ ২০ বিলিয়ন ডলার এবং নিট রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশের রিজার্ভ প্রকৃতপক্ষে মাত্র তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত। ভারত ও শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব হলেও বাংলাদেশে এখনও লাগামহীন রয়ে গেছে।

অবশ্য গত এক মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থেমে গেছে। ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণেও উল্লেখযোগ্য উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু খেলাপি ঋণ সমস্যা মোকাবিলায় অবিলম্বে ট্রাইব্যুনাল গঠন না হলে কার্যকর পন্থা খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।

প্রথম আলো