কী কী সংস্কার করলে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ হবে?
Share on:
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ট্রেন গত ১৫ বছর ধরেই লাইনচ্যুত হয়ে চলছিল। কিন্তু সর্বশেষ এক দশকে লাইনচ্যুত হয়ে যতদূর গিয়েছে, শুধু ধ্বংসই করেছে। ট্রেনটা থামানো দরকার ছিল। সেই কাজে সব বগির যাত্রীই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাত লাগিয়েছিল।
এতে সব বগির যাত্রীর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত থামানো গেছে ট্রেনকে। এটা ছিল গণঅভ্যুত্থানের প্রথম ধাপ, যা শেষ হয়েছে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে।
এখন ট্রেনকে এমনভাবে লাইনে ফিরিয়ে আনা দরকার, যাতে ভবিষ্যতে আবারও লাইনচ্যুত হওয়ার সুযোগ না পায়। ছাত্র-জনতার অভাবনীয় এবং প্রায় অবিশ্বাস্য লড়াইয়ের মাধ্যমে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশের জনগণের সামনে আকাঙ্ক্ষা হিসেবে হাজির হয়েছে রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে ফ্যসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরির মধ্য দিয়ে নতুন যাত্রা। এ আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নই গণঅভ্যুত্থানের দ্বিতীয় ধাপ।
পরপর তিনটি নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে যারা ‘ভোটাধিকারের’ জন্য আন্দোলন করছিলেন, তারা এখন দ্রুত ভোটের দাবি জানাচ্ছেন। অন্যদিকে জনগণের বিরাট অংশের মধ্যে পরিষ্কার আকাঙ্ক্ষা– আগে রাষ্ট্র সংস্কার, তারপর নির্বাচন। কারণ দীর্ঘদিনের বঞ্চনা-বৈষম্যের অভিজ্ঞতায় জনগণ জানে, বিদ্যমান ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রেখে যাকেই ক্ষমতা দেওয়া হোক, দিন শেষে সে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠবেই। বাংলাদেশের রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামোর বর্তমান বিন্যাস যে কোনো রাজনৈতিক শক্তিকেই ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়।
ফলে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের সামনে এখন প্রধান রাজনৈতিক প্রশ্ন হচ্ছে, পরবর্তী নির্বাচন হবে কি ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা কাঠামোর অধীনে, নাকি বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সংবিধানের অধীনে?
সত্য, অবশ্যই নির্বাচন হতে হবে। তবে সেটা সংস্কারকৃত কাঠামোর অধীনে। সেখানে বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের প্রধান তিন বিভাগ একে অন্যের ওপর খবরদারি করতে পারবে না; ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র জনগণের সেবাদানের উপযোগী আমলাতন্ত্র হবে; রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গণতান্ত্রিকভাবে দাঁড়িয়ে যাবে; নির্বাচন কমিশন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই সুষ্ঠু নির্বাচনের সক্ষমতা অর্জন করবে; পুলিশ সত্যিকারের জনগণের বাহিনী হিসেবে ভূমিকা রাখবে; লুটপাট ও পাচারবান্ধব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বদলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানমুখী ব্যবস্থার পথে যাত্রা শুরু করবে; ঔপনিবেশিক আইনকানুন স্বাধীন দেশের উপযোগী হয়ে উঠবে; মৌলিক অধিকার সুরক্ষায় ‘যদি-কিন্তু-তবে’র বেড়াজাল উঠিয়ে দেওয়া হবে। এসব সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ হবে। এসব সংস্কার কার্যক্রমের সঙ্গে জনগণের বিভিন্ন অংশের সরাসরি সংযোগ ও অংশগ্রহণ গড়ে উঠবে, যার মধ্য দিয়ে নতুন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার প্রায়োগিক শর্ত ও সাংগঠনিক শক্তির নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি হবে।
এসব সংস্কার ছাড়া নির্বাচন দেওয়া হলে বর্তমান বাস্তবতায় এটা পরিষ্কার– রাষ্ট্রক্ষমতায় আসবে বিএনপি। কিন্তু তারা কি এসব সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ? কিংবা এসব সংস্কার কার্যক্রমের নৈতিক ও রাজনৈতিক বৈধতা কি তাদের থাকবে? অথবা তারা যদি করতেও যায়, সেটা কি সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হবে? সব প্রশ্নের উত্তরই হচ্ছে– না।
প্রথমত, বিএনপির ২৭ দফা আমূল পরিবর্তনের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। তাদের আন্দোলন ছিল প্রধানত ‘ভোটাধিকারের’ আন্দোলন। পরে তারা যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা করে ৩১ দফা দিয়ে। সেটাও ২৭ দফার সঙ্গে চরিত্রগত দিক দিয়ে আলাদা নয়। তাদের ভোটাধিকারের আন্দোলনে রাস্তায় না নামলেও মাত্র কয়েক মাস পরেই মানুষ ছাত্রদের আহ্বানে রাস্তায় নেমে আসে। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের বন্দুকের সামনে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা বুক পেতে দাঁড়িয়ে যায়। সেই আন্দোলনের রাস্তাতেই তৈরি হয় নতুন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে বিএনপি কতটা অঙ্গীকারবদ্ধ?
দ্বিতীয়ত, অতীতে বিএনপি একাধিকবার জনগণকে দেওয়া ওয়াদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর তিন জোটের রূপরেখা ভঙ্গ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে অস্বীকার করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিনাভোটের নির্বাচন করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে চূড়ান্ত ম্যানিপুলেশনের অপচেষ্টায় নির্বাচন কমিশনে নিজেদের লোক বসানো এবং বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে কার্যত দলীয় লোককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানাতে গিয়েই এক-এগারোর প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। বিএনপি যে ‘পার্লামেন্টে’ গিয়ে অন্তত তাদের ঘোষিত ২৭ বা ৩১ দফাই বাস্তবায়ন করবে– সেই আস্থা রাখাও ইতিহাস বিবেচনায় কঠিন।
তৃতীয়ত, বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে পার্লামেন্টের মাধ্যমে যতটুকু সংস্কার করবে তা কোনোভাবেই দেশের সব বা বেশির ভাগ মানুষের মতামতের ভিত্তিতে হবে না। যত ভালো সংস্কারই করুক, দিন শেষে সেটা দলীয় স্বার্থের দোষে দুষ্ট হতে বাধ্য। আর ২৭ বা ৩১ দফার কোনোটাই জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে ধারণ করার সামর্থ্য রাখে না। গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ৭০ অনুচ্ছেদের অধীনে বন্দি পার্লামেন্টের ‘দুই-তৃতীয়াংশ’ হ্যাঁ ভোটের সংশোধনীর মাধ্যমে সম্ভব নয়। সে জন্য প্রথমে দরকার জাতীয় ঐকমত্য, তারপর সংবিধান সভা গঠন এবং সব শেষে গণভোট। বিএনপিকে গণঅভ্যুত্থান ধারণ করতে হলে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ করে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের রোডম্যাপ হাজির করতে হবে।
যদি বিএনপি সত্যিই রোডম্যাপ দেয়; জনগণকে সঙ্গে নিয়েই সেই রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করতে চায়, তাহলে তারা বর্তমান সরকারের অধীনে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট সংস্কারের জন্য উদ্যোগ নিক। সরকারের সংস্কার কার্যক্রমকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করুক। কারণ কোনো দলীয় সরকারের পক্ষেই জাতীয় ঐকমত্য তৈরি সম্ভব নয়। আর জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া সংস্কার করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্র সংস্কারের আগে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে যারাই ক্ষমতায় আসুক; ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা কাঠামোর অধীনে কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না।
বস্তুত গণঅভ্যুত্থানের শক্তির বাইরে আর কারও ওপরেই আপাতত রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে আস্থা রাখা যাচ্ছে না। তবে গণঅভ্যুত্থানের শক্তি অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের যেসব উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নিয়েছে, সেগুলো এগিয়ে নিতে আরও বেশি দায়িত্বশীলতা ও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এবং ঠিক কী কী সংস্কার করলে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ হবে, তা পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করতে হবে। সংস্কারে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি, সংস্কারের পথ নির্ধারণ এবং সংস্কার কার্যক্রম শেষে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন আয়োজনের সব কাজ একসঙ্গেই এগিয়ে নিতে হবে।