ক্ষমতা ও সম্মান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত
Share on:
পৃথিবীর সর্বময় ক্ষমতা, সম্মান ও কর্তৃত্বের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা, সম্মান দান করেন আবার যার থেকে ইচ্ছা এসব কেড়ে নেন। ক্ষমতা ও সম্মান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত বিশেষ অনুগ্রহ। অনুগ্রহ পেয়ে কখনো অহংকার করতে হয় না।
আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও সৃষ্টিজীবের ওপর সদয় থাকতে হয়। অন্যথায় আল্লাহ তায়ালা তা কেড়ে নেন।তাই সকল ক্ষমতা ও আধিপত্যের প্রকৃত মালিক আল্লাহতায়ালা। পবিত্র কুরআনের বিভিন্নস্থানে মহান আল্লাহর অসংখ্য গুণবাচক নাম বর্ণনার মধ্যমে তার পরিচিতি, শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব, মাহাত্ম্য, কর্তৃত্ব ও বিশেষত্ব প্রমাণিত ও প্রকাশিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তিনি জীবিত, সবকিছুর ধারক। তাকে তন্দ্রাও স্পর্শ করতে পারে না এবং নিদ্রাও নয়। আসমান ও জমিনে যাকিছু রয়েছে, সবই তার। কে আছে এমন, যে সুপারিশ করবে তার কাছে তার অনুমতি ছাড়া? দৃষ্টির সামনে কিংবা পিছনে যাকিছু রয়েছে সে সবই তিনি জানেন। তার জ্ঞানসীমা থেকে তারা কোনো কিছুকেই পরিবেষ্টিত করতে পারবে না, কিন্তু যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন। তার সিংহাসন সমস্ত আসমান ও জমিনকে পরিবেষ্টিত করে আছে। আর সেগুলোকে ধারণ করা তার পক্ষে কঠিন নয়। তিনিই সর্বোচ্চ এবং সর্বপেক্ষা মহান।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৫৫)
আরো এরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তিনি দৃশ্য ও অদৃশ্যকে জানেন। তিনি পরম দয়ালু, অসীম দাতা। তিনিই আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তিনিই একমাত্র মালিক, পবিত্র, শান্তি ও নিরাপত্তাদাতা, আশ্রয়দাতা, পরাক্রান্ত, প্রতাপান্বিত, মাহাত্ম্যশীল। তারা যাকে অংশীদার করে আল্লাহ তা থেকে পবিত্র। তিনিই আল্লাহ, স্রষ্টা, উদ্ভাবক, রূপদাতা, উত্তম নামসমূহ তারই। নভোম-ল ও ভূম-লে যা কিছু আছে, সবই তার পবিত্রতা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা হাশর : ২২-২৪)
মানুষ আল্লাহতায়ালার নগণ্য এক সৃষ্টি। তবে সৃষ্টিকুলের মাঝে সবার থেকে আলাদা ও অনন্য। আল্লাহতায়ালা মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি ও সম্মান দান করেছেন এবং সুন্দর অবয়ব-আকৃতি দিয়ে জগতের সবকিছুকে তাদের কল্যাণেই নিয়োজিত রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ পৃথিবীকে করেছেন তোমাদের জন্য বাসস্থান, আকাশকে করেছেন ছাদ এবং তিনি তোমাদেরকে আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর তোমাদের আকৃতি সুন্দর করেছেন এবং তিনি তোমাদেরকে দান করেছেন পরিচ্ছন্ন রিযিক। তিনি আল্লাহ, তোমাদের পালনকর্তা। বিশ্বজগতের পালনকর্তা, বরকতময়।’ (সুরা আল-মুমিন : ৬৪)
আল্লাহতায়ালা মানুষের প্রকৃতি তুলে ধরে বলেন, ‘আল্লাহ, তিনি দুর্বল অবস্থায় তোমাদের সৃষ্টি করেন এবং দুর্বলতার পর শক্তি দান করেন। অতঃপর শক্তির পর দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনিই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।’ (সুরা আররূম : ৫৪) যেহেতু পার্থিব এই জীবন ক্ষণস্থায়ী, তাই এ জীবনের অর্থ-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, বিত্ত-বৈভব, শাসন-ক্ষমতা ও প্রতিনিধিত্ব; সবই স্বল্প মেয়াদি এবং অসাড়। পার্থিব এ জীবনের মোহে পড়ে মানুষ অনেক সময় আল্লাহকে ভুলে যায়। জাগতিক উপায়-উপকরণ ও মাধ্যমকে সব সমস্যার সমাধান মেনে- ‘ধরাকে সরা জ্ঞান করে’। তারা একদমই ভুলে যায়- আল্লাহতায়ালার হুকুম ছাড়া কেউই কোনোকিছু করার সক্ষমতা রাখে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে লোক সকল, একটি উপমা বর্ণনা করা হলো- অতএব, তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোন। তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা কর, তারা কখনও একটি মাছি সৃষ্টি করতে পারবে না। যদিও তারা সকলে একত্রিত হয়, আর মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কোনোকিছু ছিনিয়ে নেয়, তবে তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না। প্রার্থনাকারী ও যার কাছে প্রার্থনা করা হয়, উভয়েই শক্তিহীন।’ (সুরা হজ : ৭৩)
মানুষ সৃষ্টির প্রথম থেকে এ পর্যন্ত অনেক ক্ষমতাধর, প্রতাপশালী, অত্যাচারী ও অহংকারী অসংখ্য রাজা-বাদশা ও শাসকের দেখা পেয়েছে পৃথিবী। কিন্তু কারও শাসন-ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি এখানে স্থায়িত্ব পায়নি। একদিন দুনিয়ার চিরাচরিত নিয়মে কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে তারা, তাদের সব খ্যাতি ও অর্জন। তাদের ভয়াবহ ও করুণ পরিণতির কথা পবিত্র কুরআনে বেশ কয়েক স্থানে বর্ণিত হয়েছে।
চরম অত্যাচারী ও ঔদ্ধত্য প্রদর্শনকারী শাসক নমরুদ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি কি সে লোককে দেখনি, যে পালনকর্তার ব্যাপারে বাদানুবাদ করেছিল ইবরাহিমের সঙ্গে এ কারণে যে, আল্লাহ সে ব্যক্তিকে রাজ্য দান করেছিলেন? ইবরাহিম যখন বললেন, আমার পালনকর্তা হলেন তিনি, যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। সে বলল, আমিও জীবন দান করি এবং মৃত্যু ঘটিয়ে থাকি। ইবরাহিম বললেন, নিশ্চয় তিনি সূর্যকে উদিত করেন পূর্ব দিক থেকে, এবার তুমি তাকে পশ্চিম দিক থেকে উদিত কর। তখন সে কাফের হতভম্ব হয়ে গেল। আর আল্লাহ সীমালংঘণকারী সম্প্রদায়কে সরল পথ প্রদর্শন করেন।’ (সুরা বাকারা : ২৫৮)
নিজেকে প্রভু দাবি করার মতো ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারী শাসক ফেরাউন সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ফেরাউন ও তার বাহিনী অন্যায়ভাবে পৃথিবীতে অহংকার করতে লাগল এবং তারা মনে করল যে, তারা আমার কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে না। অতঃপর আমি তাকে ও তার বাহিনীকে পাকড়াও করলাম, তারপর তাদেরকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করলাম। অতএব দেখ, জালেমদের পরিণাম কী হয়েছে।’ (সুরা কাসাস : ৩৯-৪০) ফেরাউন সম্পর্কে অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, ‘এবং বলল, আমিই তোমাদের সেরা পালনকর্তা। অতঃপর আল্লাহ তাকে পরকালের ও ইহকালের শাস্তি দিলেন। যে ভয় করে তার জন্য অবশ্যই এতে শিক্ষা রয়েছে।’ (সুরা নাজিয়াত : ২৪-২৬) অহংকারী ও দাম্ভিক শাসক কারুনের পরিণতি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘অতঃপর আমি কারুনকে ও তার প্রসাদকে ভূগর্ভে বিলীন করে দিলাম। তার পক্ষে আল্লাহ ব্যতীত এমন কোনো দল ছিল না, যারা তাকে সাহায্য করতে পারে এবং সে নিজেও আত্মরক্ষা করতে পারল না।’ (সুরা কাসাস : ৭৬-৮৩)
আল্লাহতায়ালা একমাত্র রাজাধিরাজ। তার শক্তি ও ক্ষমতার সামনে দুনিয়ার কোনো পরাশক্তি ও শাসন-ক্ষমতা টিকে থাকার সাহস করতে পারে না। তবে সাময়িক সময়ের জন্য আল্লাহ বান্দাকে সুযোগ দেন- ‘নিজেকে শুধরে নেওয়ার’, কিন্তু ছেড়ে দেন না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলুন- হে আল্লাহ, তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত কর। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয় তুমি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল।’ (সুরা আল-ইমরান : ২৬)
দুনিয়ায় মানুষকে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। তারা শুধু সৎকর্ম দ্বারা এ পরীক্ষায় সফলতা লাভ করতে সক্ষম। সুরার শুরুতে বলা হয়েছে, ‘পুণ্যময় তিনি, যার হাতে রাজত্ব, তিনি সবকিছুর ওপর শক্তিমান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদের পরীক্ষা করেন তোমাদের মধ্যে কর্মে কে শ্রেষ্ঠ? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাময়।’ (সুরা মুলক : ১-২) কুরআনে কারিমের বর্ণনা মতে, এই দুনিয়া হলো মানুষের জন্য পরীক্ষার জায়গা। তাই চলমান করোনা মহামারিসহ বিভিন্ন দুর্যোগে ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে, মনোবল দৃঢ় রেখে, শান্তভাবে পরিস্থিতি উত্তরণ করতে হবে। এটাই মুমিনের কাজ ও কুরআনের শিক্ষা এবং আল্লাহর আদেশ।
দুনিয়া মানুষের পরীক্ষাগার। এখানে প্রতিটি মুহূর্তে তাকে পরীক্ষার মুখোমুখী হতে হয়। কাউকে নিঃস্ব ও অসহায় করে আবার কাউকে শাসন-ক্ষমতা ও অর্থ-সম্পদ দিয়ে আল্লাহতায়ালা মানুষকে পরীক্ষা করেন। সর্বাবস্থায় মানুষের উচিত- আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকা, তার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া। অহংকার ও দাম্ভিকতা পরিহার করে চলা। একনিষ্ঠচিত্তে তার ইবাদত ও আনুগত্য করে যাওয়া। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি চিরঞ্জীব, তিনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। অতএব, তাকে ডাক তার খাঁটি ইবাদতের মাধ্যমে। সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের পালনকর্তা আল্লাহর।’ (সুরা আল-মুমিন : ৬৫
পরিশেষে বলতে চাই, মানবসমাজের ভারসাম্য রক্ষায় মহান আল্লাহ মানবজাতিকে নানা শ্রেণি ও গোষ্ঠীতে বিন্যস্ত করেছেন। তিনি কাউকে জ্ঞানী করেছেন আর কাউকে মূর্খ, কাউকে ধনী করেছেন আর কাউকে দরিদ্র, কাউকে শাসক করেছেন আর কাউকে জনতা। পার্থিব জীবনে আল্লাহ যাঁদের সম্মানিত করেছেন তিনি তাঁদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং তিনি অপরপক্ষের প্রতি সুবিচার করেছেন। এভাবেই তিনি শ্রেণিবদ্ধ মানবসমাজের ভারসাম্য রক্ষা করেছেন। আর শাসকরা যখন আল্লাহর অনুগ্রহ ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করতে না পারে, তারা অত্যাচারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন আল্লাহ মানবজাতির স্বার্থে ক্ষমতার পালাবদল ঘটান। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ যদি মানবজাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তা হলে বিধ্বস্ত হয়ে যেত খ্রিস্টান সংসারবিরাগীদের উপাসনাস্থান, গির্জা, ইহুদিদের উপাসনালয় এবং মসজিদগুলো-যাতে অধিক স্মরণ করা হয় আল্লাহর নাম।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৪০) হে সীমাহীন শক্তিধর।