ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও গণঅভ্যুত্থান
Share on:
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার আপাত অবিশ্বাস্য ঘটনার পরপর দেশে তিন দিন সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনী কার্যত অনুপস্থিত ছিল।
যে অসীম কর্তৃত্বপরায়ণতায় শেখ হাসিনা একটানা ১৫ বছর ৭ মাস দেশ শাসন করেছেন, জনতার প্রতিরোধের সামনে তা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ার পর জনবিচ্ছিন্ন সরকার ও প্রশাসনের হাড় কঙ্কাল বেরিয়ে আসে। ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর প্রশাসন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সব গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের শীর্ষপদে স্বাভাবিকভাবেই রদবদল হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে গোষ্ঠীকেন্দ্রিকতা রাষ্ট্র ও রাজনীতির প্রতিটি রন্ধ্রে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে ছিল। এলাকার বাজার বা মোড়ের রিকশা স্ট্যান্ড থেকে আদালত, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, নির্বাচন কমিশন, সরকারি-বেসরকারি প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী, সংবাদমাধ্যম সর্বত্র আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন; অপরাপর সব মত ও দলের মানুষকে অগ্রাহ্য করে। এই স্বেচ্ছাচারিতার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে গড়ে ওঠে ভোট ও ভোটারদের প্রতি আওয়ামী লীগের অপরিসীম ভীতি। এ কারণেই পরপর তিনবার নানা কৌশলে আওয়ামী লীগ ভোটারবিহীন নির্বাচনে নিজেরাই নিজেদের জয়ী ঘোষণা করে সংসদে বসে এবং ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী সম্পত্তি ভাবতে শুরু করে। অপশাসনের ফলে পিষ্ট সাধারণ মানুষ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের চাকরির কোটা সংস্কারের মতো সাধারণ দাবির ওপর গড়ে ওঠা আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্ততা খুঁজে নেয়। জনগণের মধ্যে জমা হতে থাকা দীর্ঘদিনের অসন্তোষ গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হয়।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিগত অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর কাঠামোগত ও উদ্দেশ্যগত পার্থক্য স্পষ্ট। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো ছিল তিন মাস সময়সীমার। ২০০৭ সালে ক্ষমতায় আসে সেনা-সমর্থিত অনির্বাচিত সরকার। সাধারণ মানুষ সেনা-সমর্থিত শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হতে শুরু করে। ২০০৮ সালে নির্বাচন দিয়ে সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ আর তত্ত্বাবধায়ক প্রধান ফখরুদ্দীন আহমদের সেই সরকার বিদায় নেয়।
প্রায় এক হাজার মানুষের আত্মত্যাগ আর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব প্রতিরোধে এবারের গণঅভ্যুত্থানে সরকারের বিদায়। রক্তক্ষয়ী পরিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পটভূমি তাই একেবারে আলাদা। ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা ও স্বপ্নও এবার আকাশছোঁয়া। এই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্ররা রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশী হয়েছেন, এটা যেমন ইতিবাচক একটি দিক; আবার নোবেলজয়ী বিশ্বব্যাপী পরিচিত অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিত্ব ও কর্মকুশলতা নিশ্চয়ই এ সরকারের সবচেয়ে বড় শক্তি। দীর্ঘকাল একদলীয় কর্তৃত্ববাদিতা ও গোষ্ঠীবদ্ধতায় আবর্তিত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নানা দাবিদাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
২.
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমি এমন একটি সময়ে দেশের দায়িত্বভার নিয়েছি, যখন অনেক দিক থেকে পুরোপুরি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ক্ষমতায় থাকার চেষ্টায় শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকার দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে।’ রোববার ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতসহ কূটনীতিকদের তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক লুট হয়েছে।’ নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী ও সংবাদমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের পর একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন বলে তিনি অনুষ্ঠানে বলেন (সমকাল, ১৯ আগস্ট ২০২৪)।
পুরোনো স্বৈরাচারী সরকারের প্রশাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের মূল কর্তা সবাইকে রেখে নতুন সরকারের চিন্তা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অবশ্যই সম্ভব নয়। তাই প্রতিদিনই আমরা নানা প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে বদল দেখছি। এটিও জরুরি বটে– এই বদলগুলো কোন বিবেচনায় হচ্ছে সেদিকে জোর দৃষ্টি রাখা। আওয়ামী লীগ কর্মীর বদলে কি বিএনপি কর্মী প্রতিস্থাপিত হচ্ছেন! এই সংশয় সত্য হতে শুরু করলে মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিশ্রুত ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ সম্ভব হবে না। আর দক্ষিণপন্থি, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত? তাদের নেতাকর্মী বেশ আনন্দে আহ্লাদে আওয়ামী লীগকে ‘গণহত্যাকারী’ বলতে শুরু করেছেন। চালনি বলে, সুঁই তোর পেছনে ফুটো। রক্তাক্ত জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতা হত্যার দায় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব অবশ্যই এড়াতে পারবেন না; এ জন্য তারা নিশ্চিতভাবে শাস্তির মুখোমুখি হবেন, হচ্ছেনও; তাই বলে মুক্তিযুদ্ধে নৃশংস গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত রাজনৈতিক দল জামায়াত কী করে সদর্পে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে অপরকে গণহত্যাকারী বলে?
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলেও অভিহিত করছেন অনেকে। কোনো কিছুরই অতিশয়োক্তি, প্রগলভতা যুক্তিসংগত নয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হিসেবে রক্তাক্ত জুলাই এরই মধ্যে ইতিহাসে অমোচনীয় দাগ বসিয়ে দিয়েছে, একে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে মহান করার আদৌ প্রয়োজন নেই। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এর সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক পরম্পরা আছে। নানা উত্থান-পতনে প্রিয় মাতৃভূমি ৫৩ বছর পেরিয়ে বেদনা ও গর্বের ২০২৪-এ গণঅভ্যুত্থানের সাক্ষী হলো। এই অভ্যুত্থানের মর্মে যে অতুল বৈষম্যবিরোধী বার্তা আছে, তা জাতি প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারলেই শত শত ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ এবং অভূতপূর্ব লড়াই ও বীরত্বের প্রাপ্য কিছুটা হলেও দিতে সক্ষম হবে।
৩.
মুহাম্মদ ইউনূস যে কয়েকটি খাতে সংস্কারের কথা বলেছেন, তার প্রথম দুটি– নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগ। তিনি যথার্থ বলেছেন, সঙ্গে আরও একটু বিশদ করা প্রয়োজন– বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে সর্বময় ক্ষমতা; এই অবিসংবাদিত একক ক্ষমতা নিশ্চিতভাবে গণতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো নির্মাণে প্রতিবন্ধক। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার সঙ্গে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য আনা প্রয়োজন। এই বিধি যুক্ত করা প্রয়োজন যে, এক ব্যক্তি দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না এবং দলের সভাপতি ও সংসদ নেতা একই ব্যক্তি হতে পারবেন না। গত ৫০ বছরে বিভিন্ন কারণে দেশের সংবিধান ১৭ বার সংশোধন করা হলেও ক্ষমতাসীন কোনো দলই একক নেতৃত্বের চিন্তা থেকে বের হয়ে আসেনি বলেই একক স্বৈরাচার গড়ে ওঠার বিধি তারা সংস্কার করেনি। নিজেদের সুবিধামতো সাংবিধানিক সহায়তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠেছেন শাসনতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রী; অধ্যাপক ইউনূস নিশ্চয়ই সংস্কারের ক্ষেত্রে আগামীতে যাতে স্বৈরশাসক তৈরি না হতে পারেন, সে রকম বিধি সংবিধানে সন্নিবেশ করবেন। নাগরিকদের ব্যক্তি ও বাক্স্বাধীনতা হরণকারী বেশ কিছু কালাকানুন সংবিধানে আছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা হরণকারী এসব আইন বাতিল করে সংবিধানকে মানবিক করতে হবে। বাক্ ও ব্যক্তিস্বাধীনতাসহ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামোর সংস্কার ও আধুনিকায়নে উপযুক্ত বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে অনতিবিলম্বে সুপারিশ কমিটি তৈরি করে তাদের কাজের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া প্রয়োজন।
পাড়া-মহল্লায় আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ড নামিয়ে সেখানে বিএনপির সাইনবোর্ড ঝোলানো হচ্ছে। পিজি হাসপাতাল থেকে শুরু করে দেশের বড় বড় সরকারি হাসপাতালে আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের কক্ষ ভাঙচুর করছেন বিএনপিপন্থি চিকিৎসকরা।
একইভাবে আইনজীবী-ব্যাংকার-সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর-দখলের অভিযোগ উঠছে। দেড় দশকের একদলীয় শাসনে অতিষ্ঠ ছিল, এই যুক্তিতে অপরপক্ষ এখন পাল্টা নিজেদের একদলীয় প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করে নেবে? ভুলে গেলে চলবে না, এই আযৌক্তিক পেশিশক্তি ব্যবহারের কারণেই জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আয়ুক্ষয়ী সংগ্রামের সূচনা। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক মানবিক সমাজ গঠনই গণঅভ্যুত্থানের মূল বার্তা।