মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: মঙ্গলবার ২৪, সেপ্টেম্বর ২০২৪

ক্ষমতার অন্ধ চর্চা যেভাবে অপশক্তিতে পরিণত

Share on:

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ছাত্ররাই অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়োগকর্তা। বক্তব্যের যথার্থতা নিয়ে তর্ক আছে।


বিশেষত ১৫ বছরের আওয়ামী কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন কেবল জুলাই-আগস্ট মাসের ৩৬ দিনে সম্পন্ন হয়ে গেছে, এ ধারণার সঙ্গে একমত পোষণ করা কঠিন। বরং পরপর তিনটি একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে দুঃশাসন জাতির ঘাড়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো চেপে বসেছিল; তার বিরুদ্ধে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো দিনের পর দিন আন্দোলন চালিয়ে গেছে। একক দল হিসেবে বিএনপির প্রায় ৫০ লাখ কর্মীর নামে মামলা হয়েছে; মাসের পর মাস এসব কর্মী বাড়িছাড়া হয়ে থেকেছেন, অনেকেরই অধিকাংশ দিন কেটেছে আদালতের বারান্দায় ঘুরে ঘুরে।

আওয়ামী লীগ আয়োজিত একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে টানা প্রায় দেড় বছর আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর পুলিশি হামলায় বিএনপির মহাসমাবেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং শীর্ষ নেতৃত্বের প্রায় সবাই কারান্তরীণ হন। এরপর আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থীর একক নির্বাচন এবং ছয় মাসের মধ্যে রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানে সরকারের পতন। সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন ১৬ জুলাই সারাদেশে ছয়জন নিহতের ঘটনায় বৃহত্তর পরিসরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পরিণত হয়। পরবর্তী ১৯ দিনে সরকারের বেপরোয়া আচরণ ও নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার প্রবল প্রতিরোধ সত্যিকার অর্থে গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি করে; শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।

আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধে দলমত, পেশা নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণ থাকলেও এই ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিল ছাত্রছাত্রীরা। কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যানারে আন্দোলন সংঘটিত না হওয়ায় সকলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এটি ব্যাপকতা পায়।

আন্দোলনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও অন্যান্য কার্যক্রম বন্ধ থাকবার ১১২ দিন পর ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় ক্লাস চালু হয়েছে। তবে ক্লাস শুরুর আগেই একই দিন–১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে দুই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড ঘটে; তা হাসিনা সরকারের আমলে নির্মম হত্যাকাণ্ডগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। আওয়ামী লীগের উন্মত্ত নেতাকর্মীর হাতে বুয়েটের আবরার ফাহাদ, পুরান ঢাকার হতদরিদ্র দর্জি বিশ্বজিৎ দাস, এফ রহমান হলের আবু বকরসহ অনেকের মর্মান্তিক মৃত্যু আমাদের স্মৃতিতে অমলিন। বুয়েটের আবরারকে শিবিরকর্মী সন্দেহে সারারাত ধরে নৃশংসভাবে পিটিয়ে মেরেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। এবার ঢাবির ফজলুল হক হলে মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জলকে যেভাবে ক্যান্টিনে খাবার খাইয়ে ছাত্ররা দলেবলে পিটিয়ে মেরেছে, তার বিবরণ জেনে শিউরে উঠতে হয়। ঘটনাটিকে অনেকে ‘মব জাস্টিস’ বললেও কার্যত এই ঘটনা ‘জাস্টিস’-এর পর্যায়ে পড়ে না। এটি ক্ষমতা চর্চার একটি অংশ, যেমনটি ছিল আওয়ামী লীগ আমলে আবরার হত্যাকাণ্ড। যুক্তি আসতে পারে, আবরারের ঘটনায় সরাসরি রাজনীতি ছিল; তাকে শিবির সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়! ক্ষমতা যুক্তিহীন অন্ধত্বের পর্যায়ে পৌঁছলেই কেবল কাউকে বিপরীত মতাদর্শের কারণে মেরে ফেলা যায়। তোফাজ্জলের ক্ষেত্রেও তাই হলো, মানসিক ভারসাম্যহীন তরুণটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত; তাকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো! চুরিও যদি করে কেউ, তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে? তখনই পারে, যখন নিজেদের অতিরিক্ত ক্ষমতাবান মনে করে। যেমন ওই একই দিন নিজেদের অতিরিক্ত ক্ষমতাবান মনে করেছে জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্ররা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম মোল্লাকে তারা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। দুই ক্ষেত্রেই উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা হবে বলে সরকার জানিয়েছে, অপরাধীদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে।

আমাদের মনে আছে, আবরার হত্যার বিচার হয়েছিল, ছাত্রলীগের কর্মীরা দণ্ডিত হয়েছিল। তাতে কি ক্ষমতার স্পর্ধা ম্লান হয়েছিল? হয়নি। তোফাজ্জল ও শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে মারল যে অভ্যুত্থান-বিজয়ী ছাত্ররা, তাদের অবদমিত ক্ষমতা চর্চার স্পৃহা কি কয়েকজনকে বিচারের আওতায় আনবার পর কমে যাবে? অপরিমিত ক্ষমতার বোধ মানুষকে অযৌক্তিক আচরণের দিকে নিয়ে যায়। জবাবদিহিহীন সমাজে তাই আববার থেকে তোফাজ্জল, সকলের পরিণতি হয় একই। জবাবদিহিহীন সমাজের অযৌক্তিক স্পর্ধাকে ‘মব জাস্টিস’ বা ‘মব ট্রায়াল’ বলে অপরাধকে হালকা করা হয়। দায় এড়িয়ে আরও অপরাধীর পথ প্রশস্ত করা হয়। কাজেই প্রত্যেককে জবাবদিহির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব শৃঙ্খলা রক্ষা। সে ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্টকে শাস্তি পেতে হবে। যারা দায়িত্বে আছেন, অপরাধীদের তারা পূর্বাহ্ণে চিহ্নিত করবার কৌশল প্রণয়ন করবেন; ঘটনা ঘটে যাবার পর কয়েকজনকে সিসিটিভি দেখে গ্রেপ্তার করে শাস্তি প্রদান অপরাধের সংখ্যা যেমন কমাবে না; একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাদর্পী পরিবেশেরও বদল ঘটাতে পারবে না।

২.

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন শিক্ষকরাই পরিচালনা করেন। শিক্ষকদের নীল-সাদা রাজনীতিতে বিভক্তির খবর অনেক দিনের। বিশ্ববিদ্যালয়কে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতিমুক্ত করার দাবি ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৯ দফা দাবির অন্যতম। গণঅভ্যুত্থানের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে আমরা কী দেখছি? আওয়ামী প্রশাসনের শূন্য পদে যে পদ্ধতিতে শিক্ষক বাছাই করা হচ্ছে, তার সঙ্গে গত সরকারের বাছাই পদ্ধতির পার্থক্য চোখে পড়ে না। কেবল আওয়ামী লীগের বদলে দায়িত্বে আসছেন বিএনপি বা জামায়াতপন্থি শিক্ষকবৃন্দ। দেশে আওয়ামী লীগের বিপরীতে বামপন্থি সমাজতান্ত্রিক বা উদার প্রগতিবাদী শিক্ষকবৃন্দ নেই? তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো পর্যায়েই দায়িত্ব পান না। কেন?

এদিকে প্রকাশ্যে এসেছে– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের কমিটি আছে এবং সেই কমিটির সভাপতি মো. আবু সাদিক বা সাদিক কায়েম। জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের পর ১৯৯০ সালে শিবির ও জাতীয় পার্টির ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রসমাজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল সব ছাত্র সংগঠন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে শনিবার আলোচনায় অংশ নিয়ে শিবির সভাপতি সাদিক প্রশাসনকে সব সংগঠন নিয়ে সংলাপ আয়োজনের আহ্বান করেন। তিনি বলেছেন, ‘যেখানে ফ্যাসিবাদের দোসর ছাড়া সব ছাত্র সংগঠন আসবে’ (প্রথম আলো, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনকে ফ্যাসিবাদের দোসর উল্লেখ করে সাদিক বলেন, তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই।

জুলাই গণআন্দোলনে ছাত্রলীগের ন্যক্কারজনক ভূমিকার কথা সকলেরই জানা। সে জন্য সংগঠনটির অনেককে আইনের মুখোমুখি হতে হবে, নিশ্চিত শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু ছাত্রশিবির নিজেরা কী করে উচ্চকণ্ঠে ছাত্রলীগকে ফ্যাসিবাদের দোসর বলে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করবার দাবি উত্থাপন করে? তারা নিজেরা কী? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা সঙ্গে নিয়েই কি তারা এই কথা বলছে? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই বা কোন বিবেচনায় শিবিরকে এ ধরনের দাবি উত্থাপনের পথ তৈরি করে দিচ্ছে? শিবির বা জামায়াতের যুদ্ধাপরাধকে আড়াল করে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তাদের সমাজে প্রকাশ্য করবার মধ্য দিয়ে যে বার্তাই দেবার চেষ্টা করা হোক না কেন, ন্যায়-অন্যায়ের তুল্যমূল্যে তা কখনই টিকবে না। লাখো প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া এই দেশ কখনই যুদ্ধাপরাধীদের অভয়ারণ্য হতে পারে না।

দৈনিক সমকাল