মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: মঙ্গলবার ৩, সেপ্টেম্বর ২০২৪

ক্ষমতাচ্যুতদের জুজুর ভয় এবং বিএনপির সৌহার্দ্যপূর্ণ বার্তা

Share on:

বক্তব্যটি ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের আগের। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ দলীয় নেতাকর্মীকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘ক্ষমতাচ্যুত হলে প্রথম দিনেই আওয়ামী লীগের এক লাখ লোক মারা যাবে।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বিভিন্ন সময়ে অনুরূপ বক্তব্যে দলীয় নেতাকর্মীকে জুজুর ভয় দেখিয়েছেন।


প্রসঙ্গের অবতারণা করলাম মূলত ৫ আগস্টের বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে যে আওয়ামী লীগের ‘এক লাখ লোক হত্যার শিকার’ হয়নি– তা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য। এটা বহুলচর্চিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন, যা খুবই স্বস্তির। বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বড় দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রকট আকারে দেখা গেছে সময়ে সময়ে। দুটি দলই পরস্পরকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর পরিবর্তে চরম শত্রু মনে করে। ফলে এই হিংসা-বিদ্বেষ উচ্চ পর্যায় থেকে দলের নিম্ন পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। কর্মীদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়। তারা এই বিদ্বেষ ও বৈরিতাকে এগিয়ে নিয়ে যান। এটা কোনো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য ভালো কথা নয়।

ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দলীয় লোকদের জুজুর ভয় দেখিয়ে প্রকারান্তরে তাদের সঙ্গেও যে প্রতারণা করেছেন, তা এরই মধ্যে প্রমাণিত। কেবল দলীয় লোকদের নয়; দেশের সনাতন ধর্ম, বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে– আওয়ামী লীগ না থাকলে এ দেশে তারা নিরাপদে বসবাস করতে পারবে না।

স্বাভাবিকভাবেই দেড় দশকজুড়ে প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও প্রতিপক্ষ নির্মূলের যে ভয়াবহ নজির আওয়ামী লীগ স্থাপন করে গেছে, তাতে অনেকেরই আশঙ্কা ছিল– রাজনৈতিক পালাবদলের পর বড় ধরনের রক্তপাত হবে দেশজুড়ে। কিন্তু সে আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু সহিংস ঘটনা ঘটলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কঠোর অবস্থান এবং বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বের দায়িত্বশীল ভূমিকায় সংঘাত-সহিংসতার ব্যাপকতা এড়ানো গেছে।

শীর্ষস্থানীয় একটি ইংরেজি দৈনিকে কয়েক দিন আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। সাক্ষাৎকারের একটি প্রশ্ন ছিল এ রকম– ‘শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে প্রায় সাড়ে পাঁচশ মানুষ মারা গেছে এবং যার অধিকাংশই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। কিন্তু শেখ হাসিনা পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার পরও প্রায় ২০০ মানুষ মারা গেছে এবং যেগুলোকে বলা হচ্ছে প্রতিহিংসার বলি, এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?’ পত্রিকাটি কীসের ভিত্তিতে এ ধরনের পরিসংখ্যান দিল, তা বোঝা গেল না। তবে প্রশ্নোত্তরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যথার্থভাবেই বলেছেন, ‘যা হয়েছে, সেটিকে বিপ্লব-পরবর্তী বলা ঠিক হবে না। এগুলো হয়েছে বিপ্লবের মুহূর্তে। বিপ্লব-পরবর্তী যখন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, তারপর একটিও এমন ঘটনা ঘটেনি।’

বিএনপি মহাসচিব আলোচ্য সাক্ষাৎকারে প্রতিশোধ, প্রতিহিংসার রাজনীতির পরিবর্তে সৌহার্দ্য, ভালোবাসা ও সুসম্পর্কের বার্তা দেন। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করার পক্ষে দলীয় অবস্থানও স্পষ্ট করেন। দখল, দলীয়করণ, হাওয়া ভবনের সঙ্গে আয়নাঘরের তুলনাসহ বিএনপিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তুলনা করাটা ‘ইনজাস্টিস’ বলে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি মনে করেন, বিএনপিকে হেয় করার জন্যই কতিপয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ‘নেগেটিভ ন্যারেশন’ দিয়ে থাকে।

সংস্কারের প্রশ্নে যথার্থভাবেই মির্জা ফখরুল রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে সংলাপের ওপর জোর দিয়েছেন। দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের অঙ্গীকার ও প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেছেন, একটি সিস্টেম অবশ্যই দাঁড় করাতে হবে, যেখানে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে।

গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর পলায়নের পর বিএনপি নেতাকর্মী সব দখল করে নিচ্ছেন বলে যে ঢালাও অভিযোগ করা হচ্ছে, তা নাকচ করেন মির্জা ফখরুল। এ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা দুঃখজনক। একজন ব্যক্তি হয়তো বিএনপির সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু সে যখন এগুলো করে তখন দল থেকে কোনো সমর্থন পায় না। কিছু ঘটনায় আমরা ইতোমধ্যে দলীয় ব্যবস্থা নিয়েছি, দল থেকে বহিষ্কার করেছি।’ ‘বিএনপির দখলদারিত্ব’ হিসেবে যে প্রচারণা, এটাতে তাঁর আপত্তির কথাও জানান।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানও খুব তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। আগামী নির্বাচন ইতিহাসের অন্যতম কঠিন পরীক্ষার নির্বাচন হবে বলে নেতাকর্মীকে সতর্ক করেছেন। এ জন্য নেতাকর্মীকে সব প্রশ্ন ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে বলেছেন। বিএনপির নাম ভাঙিয়ে অপকর্মে লিপ্ত দুষ্কৃতকারীদের দলে ঠাঁই হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। এই বার্তা তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দিতে মাঠের নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক মতবিনিময় করছেন। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের এ কঠোর অবস্থান আশাব্যঞ্জক।

সংস্কার কার্যক্রম প্রলম্বিত হয়ে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত হলে পুরো সময়ে বিএনপি নেতাকর্মীর তীক্ষ্ণ নজরদারি ও গভীর পর্যবেক্ষণ থাকতে হবে। এ নজরদারি যেমন দেশি-বিদেশি মিডিয়া করবে, তেমনি নাগরিক সমাজ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এবং ক্ষমতার নিয়ামক শক্তিগুলোর পক্ষ থেকেও হবে। ক্ষমতার প্রধান দাবিদার হিসেবে বিএনপির ছোট ভুলও বড় করে সামনে আনা হতে পারে, যা আগামী নির্বাচনে সাধারণ ভোটারদের মনোজগৎকে প্রভাবিত করবে। এসব মাথায় রেখেই বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে তৃণমূলের কর্মী পর্যন্ত সবাইকে সাবধানে পা ফেলতে হবে। শীর্ষ পর্যায় থেকে শান্তি, সৌহার্দ্য ও সহিষ্ণুতার যে বার্তা দেওয়া হচ্ছে, তা আমলে নিয়ে নেতাকর্মীকে সংযমী আচরণ করতে হবে। তা না হলে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে।

দৈনিক সমকাল