ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পে কর্মসংস্থান সৃষ্টির চ্যালেঞ্জ
Share on:
গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত নতুন সরকারের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ এখন চারটি: আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি।
এর বাইরে গত ১৫ বছরে সংঘটিত নানা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও নির্বাচনী ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর মতো বিষয়গুলো তো রয়েছেই। তো এত এত চ্যালেঞ্জ একসঙ্গে মোকাবেলা করার বিষয়টি নিঃসন্দেহে অনেক জটিল ও পরিশ্রম সাপেক্ষও।
কিন্তু তা সত্ত্বেও অন্য যেকোনো সরকারের তুলনায় এ সরকারের পক্ষে এ কাজগুলো করা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সহজ ও অনায়াসসাধ্য বলে মনে করি। কারণ: এক. নির্বাচিত না হওয়া সত্ত্বেও এ সরকারের পক্ষে ছাত্র-জনতার ব্যাপক সমর্থন রয়েছে এবং দুই. লোভ-লালসার পরিবর্তে অঙ্গীকারবদ্ধতাই এর সদস্যদের মূল পুঁজি।
সেক্ষেত্রে কাজগুলো যত দ্রুত শুরু করা যাবে, জনগণের সমর্থনও ততটাই চাঙ্গা থাকবে। কিন্তু অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে সেসব দ্রুত শুরু করতে গিয়ে কোনো অবস্থাতেই যেন পরিকল্পনা-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত না হয়।
কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন যে শেষ পর্যন্ত প্রথমে সরকার পতনের ও পরে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে রূপান্তরিত হলো, কী ছিল সেটির অন্তর্গত প্রেরণা? আসলে ওই অনুপ্রেরণার মূলে ছিল এ উপলব্ধি যে দেড় দশকের একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকেই শুধু হরণ করেনি, রাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের ভবিষ্যৎকেও চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল এবং সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে ফেলেছিল তরুণ সমাজের ক্যারিয়ার ও কর্মসংস্থানের বিষয়টিকে।
আর এ রকম একটি জনহতাশার প্রেক্ষাপটে ও তার বিপরীতে একটি গণমুখী রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষাকে চেতনায় ধারণ করে দায়িত্ব গ্রহণকারী নতুন সরকারের জন্য এ মুহূর্তের একটি অন্যতম কাজ হবে দেশের তরুণ-যুবাদের জন্য ব্যাপক সংখ্যায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। কাজটি করার জন্য খাতভিত্তিক নানা পথ, উপায় ও কৌশল অবশ্যই রয়েছে এবং সেগুলোর সঙ্গে জড়িত বিপুলসংখ্যক রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা ও সামর্থ্যকে সমন্বয়ের ভিত্তিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে এক্ষেত্রে স্বল্প সময়ের মধ্যেই লক্ষ্যযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব বলেও মনে করি। তবে তা করতে হলে যে খাতগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে তার মধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পের (এমএসএমই) উন্নয়ন।
এমএসএমই উন্নয়নে দেশের রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি খাতের আওতায় বর্তমানে যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বিদ্যমান রয়েছে তা এতটাই বিশাল যে সে-সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ তথ্য সামনে আনলে তা দেখে বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই রীতিমতো বিস্মিত হবেন। কিন্তু সে তুলনায় এদের সম্মিলিত ফলাফল মোটেও তেমন একটা আশাব্যঞ্জক নয়। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য জানাচ্ছে যে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ছোট, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে প্রবৃদ্ধির হার যেখানে ছিল ১৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ, সেখানে পরবর্তী বছরগুলোয় তা কমতে কমতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৮৪ শতাংশে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ খাতের উন্নয়নে সারা দেশে এত বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও এ খাতে প্রবৃদ্ধির হার ক্রমেই নিচের দিকে নামছে কেন? এর কারণ বহুবিধ এবং সেসব নিয়ে সরকার পরিবর্তনের এ সম্ভাবনাময় ক্ষণে বিস্তারিত আলোচনা হওয়াটাও জরুরি। তবে সেটি এ স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয় বিধায় এখানে সারাংশের মতো করে কতিপয় নির্বাচিত বিষয় তুলে ধরা হলো মাত্র। উল্লেখ্য, এ খাতের উন্নয়নের দায়িত্বে মুখ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) নিয়োজিত থাকলেও বিসিক ছাড়াও বহুসংখ্যক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে এসব কর্মকাণ্ডে যুক্ত রয়েছে, যা নিয়ে লেখার শেষ অংশে খানিকটা আলোকপাত করা যেতে পারে।
বাংলাদেশের বিদ্যমান সংস্কৃতিতে যেকোনো বিনিয়োগ শুরুর পূর্বশর্ত হিসেবে সর্বাগ্রে ভাবা হয় মূলধনের কথা, যা একেবারে সঠিক নয়। বাংলাদেশের এমএসএমই খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের উৎসাহীকরণের ক্ষেত্রে প্রথম বাধাই হচ্ছে নীতিগত পর্যায়ে বিরাজমান নানা অন্যায়, অন্যায্যতা ও অসংগতি। আরো খোলামেলাভাবে বলতে গেলে বিষয়টি হচ্ছে বৃহৎ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মধ্যকার সুযোগ-সুবিধা ও আচরণগত বৈষম্য, যেখানে রাষ্ট্র বরাবরই বড়দের স্বার্থকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এসেছে। ফলে মুখে যতই বলা হোক না কেন রাষ্ট্র এমএসএমইর পক্ষে এবং কর্মসংস্থান ও অন্য নানা বিবেচনা থেকে এ খাতের অগ্রাধিকারভিত্তিক বিকাশই তাদের কাম্য, কিন্তু এ খাতের বাস্তবতা মোটেও উল্লিখিত বক্তব্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
এমনকি যে শিল্পনীতির ভূমিকায় বলা হচ্ছে যে, ‘সরকার জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬-এ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতকে শিল্প উন্নয়নের প্রধান মাধ্যম হিসেবে গণ্য করে’, সেখানে সেই শিল্পনীতির নানা অধ্যায়েই এ খাতের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও অসংগতিপূর্ণ নানা বক্তব্য দিয়ে ভরিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়া যেটুকু স্বার্থ সংরক্ষণের বিধান সেখানে রাখা হয়েছে, এ খাতের উদ্যোক্তারা অসংগঠিত ও সমাজের অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ শ্রেণীর বিধায় বাস্তবে সেটুকুও তাদের ভাগ্যে জুটছে না।
উল্লিখিত শিল্পনীতির একটি মারাত্মক ত্রুটি হলো সেখানে শিল্পের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে চরম বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়েছে এবং পুকুরের বড় রাক্ষুসে মাছ যেভাবে ছোট মাছগুলোকে গোগ্রাসে গিলে ফেলে, এখানেও বড় শিল্পগুলোর জন্য সে ব্যবস্থাকে উৎসাহিত ও নিরাপদ করে রাখা হয়েছে। তাছাড়া সমগ্র শিল্প খাতকে বৃহৎ, মাঝারি, ক্ষুদ্র, ছোট, কুটির ইত্যাদি বহুসংখ্যক ভাগে বিভক্ত করে এর বাস্তব চর্চা ও অনুসরণকে প্রচণ্ডভাবে জটিল করে তোলা হয়েছে। এর বাইরে আবার রয়েছে কর্মী নিয়োজনের হিসাবের ভিত্তিতে শিল্পের সংজ্ঞা নির্ধারণের বিষয়টিও। আরো রয়েছে সেবামূলক ও উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে সংজ্ঞা নির্ধারণ। মোট কথা, শিল্পনীতিতে শিল্পের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে যা যা করা হয়েছে, সেটিকে তুঘলকি কাণ্ড বললেও কম বলা হয়। ফলে লক্ষ করা গেছে যে শিল্পের সংজ্ঞা অনুসরণ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট অংশীদারি প্রতিষ্ঠানগুলো যার যার মতো করে এর চর্চা করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে শিল্প মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), বিভিন্ন ব্যাংক ও উন্নয়ন অর্থায়ন প্রতিষ্ঠান (ডিএফআই), বেসরকারি গবেষণা সংস্থা, এনজিও, উন্নয়ন সহযোগী প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অনুসৃত সংজ্ঞার মধ্যে ব্যাপক অমিল ও অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর এমনটি হওয়ার কারণে এ খাতের অগ্রগতি পরিধারণের ক্ষেত্রে যেমন সমস্যা হচ্ছে, তেমন সমস্যা হচ্ছে তথ্য সমন্বয় ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও। সাম্প্রতিক সময়ে রফতানি আয়ের বিষয়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) কর্তৃক ভুল তথ্য সরবরাহের কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেনের হিসাব, জিডিপি, মাথাপিছু আয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে যেমন পরিবর্তন আনয়নের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, তেমনি শিল্পের সংজ্ঞাজনিত বিভ্রান্তি থেকে সৃষ্ট তথ্যগত অসংগতিগুলো দূরীকরণের বিষয়টিও এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
এমএসএমইতে অর্থায়নের ব্যাপারে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও রয়েছে সীমাহীন রক্ষণশীলতা। তাদের মধ্যকার অধিকাংশই ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ঋণদানে খুব একটা আগ্রহী নয়। আগ্রহী নয় গ্রামাঞ্চলের উদ্যোক্তাদের ঋণদানের ব্যাপারেও। তদুপরি উৎপাদনমূলক শিল্পের চেয়ে তাদের আগ্রহ সেবামূলক শিল্পের প্রতি। স্বল্পব্যয়ী প্রকল্পের চেয়ে তাদের কাছে অগ্রাধিকার পায় বৃহদাকার প্রকল্প। এমনকি কারো করো ওপর ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে নির্দিষ্ট হারে ঋণদানের ব্যাপারে গঠনতান্ত্রিক তথা বিধিগত বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেটিও তারা সংজ্ঞার ফাঁকফোকর গলিয়ে বহুলাংশে এড়িয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ: ব্যাংক অব স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কমার্সের (বেসিক ব্যাংক) ক্ষেত্রে গঠনতান্ত্রিক (Memorandum of Articles of Association) বাধ্যবাধকতা রয়েছে যে, তাদেরকে বিনিয়োগযোগ্য ঋণ তহবিলের ন্যূনতম ৫০ শতাংশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে প্রদান করতে হবে। এখন এ বাধ্যবাধকতা পূরণ করতে গিয়ে তারা যদি তাদের ঋণ তহবিলের ৫০ শতাংশের সিংহভাগই ক্ষুদ্র শিল্পের ১৫ কোটি টাকার ওপরসীমার কাছাকাছি পর্যায়ের প্রকল্পে প্রদান করে, তাহলে অনুসরণীয় বাধ্যবাধকতা হয়তো পূরণ হলো। কিন্তু ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতের আওতাধীন ছোট ছোট উদ্যোক্তাকে ঋণদানের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদানের যে স্পিরিট থেকে উল্লিখিত বাধ্যবাধকতা গঠনতন্ত্রে যুক্ত করা হয়েছে, তা বস্তুত অপূর্ণই থেকে গেল। একইভাবে ব্যাংকগুলো যদি তাদের ঋণ তহবিলের বড় অংশই সেবামূলক শিল্পে প্রদান করে নিজেদের ওপর অর্পিত দায় শোধ করতে চায়, সেটিও নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন এবং তা করা যাচ্ছেও না। ফলে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতের উৎপাদন (ম্যানুফ্যাকচারিং) সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা বরাবরের মতোই বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন।
এমএসএমই খাতের পোষক সংস্থা বিসিকের মূল কাজ হচ্ছে সারা দেশে উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা, যার বিস্তারিত বিবরণের আওতায় রয়েছে প্রশিক্ষণ, ঋণ, অবকাঠামো (শিল্প প্লট), উৎপাদন উন্নয়ন, পণ্য বিপণন ইত্যাদি। তদুপরি শিল্প নিবন্ধন ও কর-শুল্ক মওকুফের মতো নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিবদ্ধ কাজগুলোও তারা করে থাকে। আর এ কাজগুলো করার জন্য দেশের সব জেলাতেই তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বিস্তৃত রয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে আরো প্রায় ১০০টি শিল্পনগরী বা শিল্পপার্ক। যতটুকু জানা যায়, উল্লিখিত কর্মকাণ্ডের মধ্যে তাদের সর্বাধিক মনোযোগ এখন শিল্পনগরীগুলোর প্রতি, যা মোটেও অপ্রয়োজনীয় নয়। কিন্তু দেশে যদি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়াতে হয়, যা নতুন সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার, তাহলে বিসিককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রমের ওপর এবং সেটি গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে দিতে হবে। বিবিএসের ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশে যে প্রায় ৮ লাখ শিক্ষিত বেকার যুবক রয়েছে, এদের একটি বড় অংশকে বিসিক কর্তৃক আনুষঙ্গিক সহায়তা ও সমর্থন দিয়ে অবশ্যই উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যারা নিজের পাশাপাশি অন্য বহু সংখ্যকের জন্যও কর্মসংস্থানের সুযোগ গড়ে তুলবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিবিএসের জরিপে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা আট লাখ বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা এখন ১২ লাখেরও বেশি হবে বলেই ধারণা করা চলে এবং বিসিককে এ বর্ধিত সংখ্যা হিসেবে নিয়েই কাজ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয় সামনে আনা প্রয়োজন যে উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রমের বিশ্ব র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে ১৩৭ দেশের মধ্যে ১৩২, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন, এমনকি আফগানিস্তানেরও পর। এটি একটু পুরনো হিসাব। তবে নতুন হিসাবেও এক্ষেত্রে খুব বেশি হেরফের হবে বলে মনে হয় না। সে যা-ই হোক, বিসিকের এখন উচিত হবে উদ্যোক্তা উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিরাজমান এ নাজুক পরিস্থিতি থেকে দেশের এমএসএমই খাতকে উদ্ধারে সচেষ্ট হওয়া। কাজটি রাতারাতি হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা ও নেতৃত্বের যে অসীম গুণাবলি রয়েছে, যা তারা সাম্প্রতিক আন্দোলনের সময় দেখিয়েছে, সেটিকে যদি উদ্যোক্তা উন্নয়নের কাজে যথাযথভাবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে আশা করা যায় যে আগামী তিন-চার বছরের মধ্যেই উদ্যোক্তা উন্নয়নের বিশ্ব র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান অনেকটাই সম্মানজনক পর্যায়ে উঠে আসবে। তবে বিষয়টি স্পষ্ট করা প্রয়োজন যে এক্ষেত্রে বিসিক বা বাংলাদেশের মূল উদ্দেশ্য হবে র্যাংকিং পরিবর্তন নয়—এ বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত তরুণের মেধা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে দেশকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা। তবে কাজটি বিসিকের একার পক্ষে সম্ভব নয় কিছুতেই। সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ও সমন্বয়ের ভিত্তিতেই এটি করতে হবে। এ সমন্বয়ের কাজটি কীভাবে করা যাবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর উচিত হবে শিগগিরই একসঙ্গে বসা।
উল্লিখিত কাজগুলো করার জন্য রাষ্ট্রকে অবশ্যই কিছু বাড়তি বিনিয়োগ করতে হবে, যা ১৬ বছরের ধ্বংসযজ্ঞের পর এখন সাবলীলভাবে করাটা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। তা সত্ত্বেও অপ্রয়োজনীয় খাত থেকে অর্থ সাশ্রয় করে এমএসএমই ও অগ্রাধিকারভিত্তিক অন্যান্য খাতের উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য কীভাবে তা বাড়ানো যায়, তা নিয়ে সরকারকে চিন্তাভাবনা করতে হবে। এক্ষেত্রে লেখার সূচনায় উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য দেশে অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার যে ইঙ্গিত করা হয়েছিল তার ধারাবাহিকতায় বলি, যুক্তি ও বিবেচনার সব পরিসীমা লঙ্ঘন করে বিগত সরকার ২০১১ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্কিল ফর এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট (এসইআইপি) ও ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (এনএসডিআই) স্থাপন করে। প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থ মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাজ কি উদ্যোক্তা উন্নয়ন বা দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম দেখাশোনা করা? এ জাতীয় কাজে যদি দক্ষতার কোনো ঘাটতি থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে উচিত হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা। কিন্তু সেটি না করে মাঠের কাজ সচিবালয়ে নিয়ে আসাটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আসলে এসব করা হয়েছে বস্তুত কেন্দ্রে বসে নানামাত্রিক সুবিধা ভোগের আয়োজনকে নিরঙ্কুশ করে তোলা, যা গত ১৬ বছরে অন্যান্য ক্ষেত্রেও হয়েছে। এখন সময় এসেছে সে অবস্থায় যতি টানা। বরং তা করার লক্ষ্যে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবিলম্বে বিলুপ্ত করে সেখান থেকে সাশ্রয়কৃত অর্থ এমএসএমই ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতের কাজে ব্যয় করা জরুরি বলে মনে করি।
অতএব এ দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর স্বার্থের দিকে তাকিয়ে এ খাতকে উচ্চ উৎপাদনশীলতার ভিত্তিতে যত দ্রুত দক্ষ ও গতিশীল করে তোলা যাবে, ততই মঙ্গল।