কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বহাল!
Share on:
যে টাকার আয় ও আয়ের উৎস ঘোষণা না দিয়ে রাষ্ট্রের প্রাপ্য কর ফাঁকি দেয়া হয় বা যায়, যে টাকা অবৈধভাবে অর্জিত, সে টাকাই অপ্রদর্শিত বা কালো টাকা। এ টাকা আয়ের মূল কারণ হলো দেশে সুশাসনের অভাব। এ কালো টাকা উপার্জন দেশের অর্থনীতিতে শুধু আয়বৈষম্যই তৈরি করে না, বরং দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতাকেও উৎসাহিত করে।
কালো টাকাকে কর প্রদানের সময় ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ সংজ্ঞায়িত করে গুরুতর অপরাধকে হালকা করার অবস্থান নেয়া সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত আয়ের উৎস, উপায় ও উপলক্ষ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করা।
ন্যায়নীতির অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে কালো টাকার সব সুযোগ বন্ধ করতে হবে। এজন্য সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি। কেননা অপ্রদর্শিত বা কালো টাকা লালন করার সংস্কৃতি থেকে সরে না এলে আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য থেকে বাংলাদেশের মুক্তি মিলবে না। এ ধরনের অন্যায্য সুযোগ দিয়ে অবৈধ সম্পদ অর্জনে উৎসাহিত করার পাশাপাশি দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
অন্যান্য বছরের বাজেটের মতো ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয় বিগত সরকার। স্থাবর সম্পত্তি যেমন ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট কর এবং নগদসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করা যাবে। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল ঘোষণার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ২ সেপ্টেম্বর জারি করা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সিকিউরিটিজ, নগদ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, আর্থিক স্কিম ও ইনস্ট্রুমেন্ট, সব ধরনের ডিপোজিট বা সেভিং ডিপোজিটের ক্ষেত্রে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিলের ঘোষণা দেয়া হয়।
কিন্তু বাজেটের সময় ঘোষিত এলাকাভেদে স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস ও ভূমিতে প্রতি বর্গমিটারের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণে কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত (কালো) অর্থ প্রদর্শিত (সাদা) করার সুযোগ বহাল রয়ে গেছে এখনো। অন্যদিকে বৈধ আয়ে সর্বোচ্চ করারোপ করা হয়েছে ৩০ শতাংশ।
এ ধরনের বিধান বৈষম্যমূলক ও অসাংবিধানিক, যা সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করবে, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করতে সমর্থ হবে না’। এটা স্পষ্টত দ্বিমুখী নীতি। কালো টাকা সাদা করার এ অন্যায্য আইনের মাধ্যমে মূলত অসৎ করদাতাদের পুরস্কৃতই করা হচ্ছে, বরং সৎ করদাতাদের প্রতিও করা হচ্ছে অবিচার।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অবশ্যই কালো টাকা সমাজের বা সরকারের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অনৈতিকতা ও অব্যবস্থাপনার সৃষ্টি, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও ন্যায়-ন্যায্যতা নীতিনির্ভরতায় বিপুল ব্যর্থতার প্রতিফল। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক নজির থেকে দেখা যায়, তুলনামূলক সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাওয়ার পর হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, ইরান, নিকারাগুয়া, বলিভিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠতে পেরেছে। এসব দেশ প্রথম পর্বে কালো টাকাকে প্রযত্ন দিতে সাদা করাকে গুরুত্ব দিত। পরবর্তী সময়ে শক্ত হাতে কালো টাকা সৃষ্টির উৎস বন্ধ করার রাষ্ট্রীয় প্রতিবিধান জোরদারের ফলে সেসব দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নে চমকপ্রদ গতিসঞ্চার হয়েছে। যেমন সুহার্তোর ১৯৬৫-৯৮ সালের ৩৩ বছরের শাসনকে ইন্দোনেশিয়ার উন্নয়নতত্ত্বে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ নামে আখ্যায়িত হয়। কিন্তু গত দুই দশকে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি কমিয়ে সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হওয়ায় সেখানে এখন অর্থবহ উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে বা হচ্ছে।
স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে আসছে। কিন্তু তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। সরকারের এ ধরনের বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য সিদ্ধান্তে নিয়মিত করদাতারা বরং নিয়মিত কর প্রদানে নিরুৎসাহিত হয়েছে। ফলে সরকার লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে প্রত্যক্ষ কর আদায়েও ব্যর্থ হয়েছে। অর্থনীতিতে কালো টাকা ফিরিয়ে আনার প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জরিমানা ও নিয়মিত কর আদায়। এরপর উৎপাদনশীল খাতে সেই অর্থ বিনিয়োগ করা। নানা আঙ্গিক ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরীক্ষা-পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কালো টাকা অর্থনীতিতে ফিরে আসার পরিবর্তে অর্থনীতি বরং কালো টাকামুখী হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়েই চলেছে। এটি গণতন্ত্রসহ সব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে সংক্রমণ ও দখল করার পথে ধাবমান। কেননা কালো টাকা সাদা করার এ সুযোগ অন্যায্য বোধকে প্রশ্রয় দেয়। সীমিত আকারে ও স্বল্প সময়ের জন্য এ সুযোগ অর্থনীতির জন্য সহায়ক হলেও দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পাচার হওয়া অর্থ অর্থনীতিতে ফেরত আসার পরিবর্তে পাচারের পরিমাণ ক্রমেই বেড়েছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির গত বছর মে মাসে বিকল্প বাজেট প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৫০ বছরে দেশ থেকে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) পরিসংখ্যানমতে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ২০০৯-১৫ সময়কালে মোট অন্তত ৮২৭ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা টাকার অংকে ৯১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত কালো টাকার উৎস, উপায় ও উপলক্ষ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করা। অবৈধভাবে অর্জিত বা আয়ের জ্ঞাত সূত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন যেকোনো অর্থবিত্তকে কালো টাকা অভিহিত করার যে আইনি অবস্থানে রয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সেটাই সাংবিধানিকভাবে বেশি যৌক্তিক। এর আলোকে দুর্বৃত্তায়নের ভয়াবহ বেড়াজাল থেকে আইনের আওতায় দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ঘুসখোর আমলা এবং অতি মুনাফাবাজ, চোরাকারবারি, ব্যাংক লুটপাটকারী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের অপরাধের শাস্তি বিধান জরুরি। তাহলে সমাজে ও অর্থনীতিতে একটা ইতিবাচক বার্তা যাবে। জরিমানা ছাড়া, অত্যন্ত হ্রাসকৃত হারে কর প্রদানের সুযোগ এবং ‘অর্থের উৎস নিয়ে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবেন না’—এ ধরনের জাতীয় বিধান জারি বলবৎ থাকায় দেশের অর্থনীতি ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে। কালো টাকা লালন থেকে সরে না এলে আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য থেকে বাংলাদেশের সহজেই মুক্তি মিলবে না। কালো টাকা সাদা করার মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে যৌক্তিকতা দেয়ার চেষ্টা না করে তা সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য হওয়াই কাম্য।
সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিগত সরকারের পতন হয়েছে। দেশের দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ছাত্র আন্দোলনটির মূল দাবি—বৈষম্য নিরসন, রাষ্ট্র সংস্কার ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা। তাই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া সংবিধান পরিপন্থী। এখন যেহেতু ছাত্র-জনতার সরকার, সেহেতু সংবিধান পরিপন্থী ও বৈষম্যমূলক এ ধরনের আইন বাতিল জরুরি।