মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শনিবার ৭, সেপ্টেম্বর ২০২৪

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে

Share on:

অবশেষে বহুল বিতর্কিত অপ্রদর্শিত অর্থ হিসেবে বিবেচিত কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার। সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।


সামান্য কর দিয়ে এবং উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন না করার সুযোগ রেখে কালো টাকা সাদা করার বিধান গত সরকারের আমলে অর্থবিলে অন্তর্ভুক্ত করায় সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে সমালোচনা ছিল।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়। অর্থবিলে বলা হয়, উৎস যা-ই হোক, উপার্জিত টাকা এর আগে আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করে কর না দিয়ে থাকলে তার ওপর ১৫ শতাংশ কর দিয়ে তা প্রদর্শন করা যাবে। এ হারে কর দিলে আয়কর বা অন্য কোনো সংস্থা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না। গত সরকারের এ সিদ্ধান্ত নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছে। কারণ, বৈধ করদাতাদের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত আয়করের পাশাপাশি অতিরিক্ত সারচার্জ দিতে হয়। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, কালো টাকা সাদা করার ঢালাও সুযোগ দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করার আহ্বান জানিয়েছে।

অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর বৈষম্যমূলক এ সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি ওঠে। গত ১৫ আগস্ট বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে স্ট্যাটাসে বলেন, চলতি অর্থবছরে দেয়া কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ এই অর্থবছরের বাজেটে দেয়া আছে, সেটি বাতিল করা হোক। সর্বোচ্চ আয়কর ৩০ শতাংশের সঙ্গে ৫ থেকে ১০ শতাংশ জরিমানা যোগ করে সীমিত সময়ের (৩ থেকে ৬ মাস) জন্য এ সুযোগ পুনর্বহাল করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, সাধারণভাবে যে কোনো করদাতা সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ করের সঙ্গে ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শন করার সুযোগ পান। এর বাইরে প্লট বা ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে এলাকাভেদে নির্দিষ্ট আয়তনের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত কর পরিশোধ করে টাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। তবে এসব ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট যে কোনো সংস্থা চাইলে টাকার উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারবে। তাই এ সুযোগ সাধারণ কেউ গ্রহণ করে না। এ জন্য মূলত কালো টাকাকে অর্থনীতির মূলধারায় আনতে বিভিন্ন অর্থবছর দায়মুক্তির আওতায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ করে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয় সরকার। তবে এ সুযোগেও খুব বেশি সাড়া পাওয়া যায়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এক ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।

আসলে কালো টাকা কী-তা নিয়ে অনেকের মধ্যে কোন স্বচ্ছ ধারণা নেই। তাই বিষয়টি নিয়ে কিছুটা হলেও অস্পষ্টতা রয়েছে। মূলত, এটি একটি প্রচলিত ও ঐতিহ্যগত পরিভাষা। অর্থনীতিবিদেরা একে অনানুষ্ঠানিক (ইনফরমাল), গোপন (আন্ডারগ্রাউন্ড), অপ্রদর্শিত (আনডিসক্লোজড), লুকানো (হিডেন) বা ছায়া (শ্যাডো) অর্থনীতি বলে থাকেন। আয়কর বিবরণীতে যে আয় প্রদর্শন করা হয়নি, সেটাই অপ্রদর্শিত। এই অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ বা অবৈধ দুভাবেই অর্জিত হতে পারে। বৈধ আয় হয়েও আয়কর বিবরণীতে না দেখালে সেটি যেমন অপ্রদর্শিত আয়, তেমনি অবৈধ উপায়ে অর্জিত আয়ও অপ্রদর্শিত আয়। অবৈধ বা অনানুষ্ঠানিক অথবা অপ্রদর্শিত যা-ই বলা হোক না কেন, এটি আসলে কালো বা অবৈধ টাকা। এতে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়।

সাধারণভাবে কালো টাকা বলতে এমন টাকাকে বুঝানো হয় যার উৎস বৈধ বা আইনসম্মত নয়। ঘুষ, দুর্নীতি, কালোবাজারি, চোরাকারবার, মাদক ও আগ্নেয়াস্ত্রসহ নিষিদ্ধ পণ্যের ব্যবসা থেকে উপার্জিত অর্থ হচ্ছে কালো টাকা। তবে আয়কর আইন অনুসারে বৈধ উৎস থেকে অর্জিত অর্থও কালো হতে পারে। যদি টাকার মালিক তার আয়কর বিবরণীতে তার উল্লেখ না করেন; ওই টাকা করযোগ্য হলেও কর দেন না। অবশ্য আয়কর আইনে কালো টাকা বলতে কিছু নেই। আইনের কোথাও এ শব্দটির উল্লেখ নেই। সেখানে অপ্রদর্শিত অর্থের উল্লেখ আছে। আয়ের যে অংশ আয়কর বিবরণীতে প্রদর্শন করা হয় না, তা-ই অপ্রদর্শিত অর্থ (Un-disclosed Money); সাধারণভাবে যা কালো টাকা নামে পরিচিতি পেয়েছে।

তবে কেউ কেউ কালো টাকা ও অপ্রদর্শিত অর্থের মধ্যে একটা স্পষ্ট সীমারেখা টানার চেষ্টা করেছেন। তাদের মতে, অপ্রদর্শিত অর্থের উৎস বৈধ হতে পারে, আবার অবৈধও হতে পারে। কিন্তু কালো টাকার উৎস নিশ্চিতভাবেই অবৈধ। তাই বৈধ অপ্রদর্শিত অর্থের সঙ্গে কালো টাকাকে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়। তবে নৈতিক মানদণ্ডে অসৎ উদ্দেশ্যে অপ্রদর্শিত বৈধ অর্থ অবৈধ হতে বাধ্য। কারণ, কর ফাঁকিকে আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। আর যেকাজ শাস্তিযোগ্য তা কোনভাবেই বৈধ মনে করার কোন সুযোগ নেই। তাই প্রচলিত অর্থে কালো টাকার উৎস যা-ই হোক তা কোনভাবেই বৈধ হতে পারে না। এটিই বাস্তবতা।

একথা কারো অজানা নয় যে, দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কালো টাকা। ঘুষ, দুর্নীতি, চোরাচালান কিংবা চাঁদাবাজির মতো অবৈধ আয়ের পাশাপাশি বৈধ আয়ে কর ফাঁকির ব্যাপক প্রবণতার কারণে অর্থনীতিতে কালো টাকার দাপট থামছে না। বিভিন্ন সময়ে সহজ শর্তে অপ্রর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেয়া হলেও তা গ্রহণে আগ্রহী হননি অবৈধ অর্থের মালিকরা। বরং সমাজ, রাজনীতি ও ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় তাদের কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন বৈধ উপার্জনকারী ও নিয়মিত করদাতারা। এ অবস্থায় সমাজ ও রাষ্ট্রে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে কালো টাকার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা খুবই উদাসীন।

কালো টাকা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতুহলের শেষ নেই। তাদের সরল-সোজা ভাবনা হলো বাজারে তো কখনো কালো রং-এর টাকা দেখা যায় না। কিন্তু তারা বেমালুম ভুলে যান যে, নোটের রং নয়, আয়ের উৎস ও কর পরিশোধের ভিত্তিতে ঠিক হয় টাকা কালো বা সাদা কি না! ঘুষ, দুর্নীতি, চোরাচালান, চাঁদাবাজি, কালোবাজারি, মাদক ব্যবসা, আমদানি-রপ্তানিতে জালিয়াতিসহ বেআইনি কাজের মাধ্যমে যে অর্থ আসে, তা-ই কালো টাকা। বৈধভাবে আয় করে ঠিকমতো কর না দিলেও সেই টাকা কালো হয়ে যায়। আবার বৈধ খাতে কারসাজির মাধ্যমেও কালো টাকা উৎপাদিত হয়। যেমন জমি কেনাবেচায় যে দামে রেজিস্ট্রেশন হয়, প্রকৃতপক্ষে বিক্রি হয় তার চেয়ে অনেক বেশি দামে। এক্ষেত্রে কাগজপত্রে গোপন করা অংশটি অপ্রর্শিত বা কালো টাকা।

অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত ‘কালো টাকা ও অর্থ পাচার: বাংলাদেশে দুর্নীতির রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধে কালো টাকার প্রধান পাঁচটি উৎস উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হলো সরকারি তহবিল, স্টোর ও পতিত সম্পত্তি আত্মসাৎ, তহবিল তছরুপ ও জোরপূর্বক দখল এবং আমলাদের পক্ষ থেকে পরিতোষণ; চোরাচালান, মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা, মানব পাচার, অর্থ পাচার ব্যবসা; মজুতদারি, কালোবাজারি, বিদেশি মুদ্রার অবৈধ ব্যবসা, আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং, রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং ইত্যাদি ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্ক; জাতীয়করণ হওয়া অথবা সরকারি এবং বেসরকারি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে গৃহীত বিশাল পরিমাণের ঋণ আত্মসাৎ ও তা পরিশোধ না করা; রাষ্ট্রের সহায়তায় বিদেশি অর্থায়নে কোটি কোটি ডলার প্রকল্পের কমিশন এজেন্সি, বিভিন্ন ক্রয় কাজের দালালি এবং পারমিট লাইসেন্স হস্তান্তর, নিজের পক্ষে আইন প্রয়োগ এবং পণ্যদ্রব্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও সিন্ডিকেট গঠনের মাধ্যমে অনুপার্জিত আয়। তার মতে, ‘কালো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হলো সেসব লেনদেন, যা দেশের প্রচলিত নিয়মকানুন অনুযায়ী বিধিসম্মত নয়। কালো অর্থনীতির লেনদেন অনিয়ন্ত্রিত, করারোপিত নয় এবং এগুলো পরিমাপ করা হয় না, কারণ ওইসব লেনদেন নথিভুক্ত নয়।’

বাংলাদেশে দেশে কালো টাকার পরিমাণ কত, তা নিয়ে নানা জনের নানা মত রয়েছে। ২০১১ সালে ‘বাংলাদেশের অপ্রকাশ্য অর্থনীতির আকার: একটি অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ’ শিরোনামে সমীক্ষা করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। সেই সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৭৩ সালে দেশে কালো টাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৭ শতাংশের সমান। সেখান থেকে ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০১০ সালে জিডিপির ৬২ দশমিক ৭৫ শতাংশে দাঁড়ায়।

কালো টাকার বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ধারাবাহিক গবেষণা করছেন অস্ট্রিয়ান অর্থনীতিবিদ ফ্রেডারিক স্নাইডার। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ‘শেডিং লাইট অন দ্য শ্যাডো ইকোনমি: আ গ্লোবাল ডেটাবেইস অ্যান্ড দ্য ইন্টারঅ্যাকশন উইথ দ্য অফিশিয়াল ওয়ান’ শিরোনামে একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তিনি। এতে ১৫৭টি দেশের তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ২৭ বছরে বাংলাদেশে কালো টাকার গড় হার ছিল জিডিপির ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ। সর্বশেষ গত ৩ জুন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ‘বিকল্প বাজেট প্রস্তাব ২০২৪-২৫’-এ বলা হয়েছে, ১৯৭২-৭৩ থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত ৫০ বছরে পুঞ্জীভূত কালো টাকার পরিমাণ ১ কোটি ৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তাদের হিসাবে প্রতি বছর গড়ে জিডিপির ৩৩ শতাংশ টাকা অপ্রদর্শিত থেকে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরে জিডিপির আকার হবে ৫০ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। গবেষকদের অভিমত অনুযায়ী এক-তৃতীয়াংশ (৩৩ শতাংশ) কালো বা অপ থাকলে তার পরিমাণ ১৬ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

আমাদের দেশে কালো টাকা বারবার সাদা করার সুযোগ দেয়া হলেও তা কোনভাবেই মূলধারায় ফিরে আনা সম্ভব হয়নি। বৈধতা না থাকায় মূলধারার বাইরে চলে যাওয়া বিপুল পরিমাণ টাকা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বা বিনিয়োগেও কোনো ভূমিকা রাখছে না। এতে সরকারও কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব পায়নি। সঙ্গত কারণে বিভিন্ন সময়ে কালো টাকাকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার সুযোগ দেয়া হয়। গত ৫৩ বছরে ২১ বার এমন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে কখনো প্রত্যাশা অনুযায়ী সাড়া দেননি অবৈধ অর্থের মালিকরা। জানা যায়, জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরে সর্বপ্রথম অবৈধভাবে উপার্জিত টাকা বৈধ করার সুযোগ দেয়া হয়। তখন এই প্রক্রিয়ায় বৈধতা পেয়েছিল ৭০ কোটি টাকা। সরকার রাজস্ব পেয়েছিল ১০ কোটি টাকা। এরপর এরশাদ আমলে ১৯৮৭-৮৮ অর্থবছর থেকে টানা ৩ বছর একই সুযোগ দেয়া হয়। এর মধ্যে প্রথম বছর ২০ শতাংশ হারে কর পরিশোধের বিধান করা হয়। ১৯৮৮-৮৯ এবং ১৮৮৯-৯০ অর্থবছরে ১০ শতাংশ কর দিয়ে শিল্প খাতে অবৈধ অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়। ওই তিন অর্থবছরে বৈধ হয়েছিল ৮৫০ কোটি টাকা।

১৯৯১-৯৬ পর্যন্ত বিএনপির আমলে ঘোষণা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়নি। তবে আয়কর আইনের বিশেষ বিধান কাজে লাগিয়ে সেই সময় ১৫০ কোটি টাকা সাদা হয়। সেখান থেকে আয়কর আদায় হয় ১৫ কোটি টাকা। ২০০০-২০০১ অর্থবছরের বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ রেখেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া। সেবার ১ হাজার কোটি টাকার অপ্রদর্শিত অর্থ মূলধারার অর্থনীতিতে যুক্ত হয়।

এরপর বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী টানা চার বছর কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছিলেন। এর মধ্যে প্রথম তিন অর্থবছর (২০০২-০৩ থেকে ২০০৪-০৫) কোনো রকম কর পরিশোধ ছাড়াই অপ্রদর্শিত অর্থকে বৈধতা দেয়া হয়। সে সুযোগে সাদা হয়েছিল ১ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। আর ২০০৫-০৬ অর্থবছরে সাড়ে ৭ শতাংশ কর পরিশোধের শর্তে একই সুযোগ দেয়া হয়। ওই বছর বৈধতা পেয়েছিল ৪ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে সীমিত সময়ের জন্য কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছিল সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওই সময় বৈধ হয়েছিল ৯ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা।

সদ্য পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদের প্রথম বাজেটেই অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দিয়েছিলেন সে সময়ের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সেবার (২০০৯-১০ অর্থবছর) বৈধ হয় ১ হাজার ২১৩ কোটি টাকা। আবুল মাল আবদুল মুহিতের দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৪ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি শিল্প ও আবাসন খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়। ওই সময় ৪ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা সাদা হয়।

এরপর ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেয়া হয়। এ ছাড়া নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে প্লট-ফ্ল্যাটও কিনে রাখা হয়। সব মিলিয়ে সেই সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন ১১ হাজার ৮৩৯ জন। সাদা হয়েছিল দেশের ইতিহাসে এক বছরে সর্বোচ্চ ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সেখান থেকে সরকার রাজস্ব পায় ২ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার সুযোগ দিয়েছিল সরকার। সেজন্য মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ হারে কর ধার্য করা হয়। এমন সুযোগেও বিদেশ থেকে একটি টাকাও দেশে ফেরেনি। এ কারণে পরের বছর আর সে সুযোগ রাখা হয়নি। তবে দু’বছর না যেতেই আবার অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ ফিরিয়ে দিয়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরে ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করলেই বৈধতা পাবে যে কোনো টাকা।

এ বিষয়ে সংসদে উত্থাপিত অর্থবিলে বলা হয়, ‘নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সিকিউরিটিজ, আর্থিক স্কিম ও ইনস্ট্রুমেন্ট এবং সব ধরনের ডিপোজিট বা সেভিং ডিপোজিট ১৫ শতাংশ কর দিয়ে ট্যাক্স রিটার্নে প্রদর্শন করা যাবে। এর বাইরে বাজারমূল্যের ১৫ শতাংশ কর দিয়ে যে কোনো ধরনের পরিসম্পদ বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া নির্ধারিত কর পরিশোধ সাপেক্ষে অপ্রদর্শিত জমি ও ফ্ল্যাট বৈধ করারও সুযোগ দিচ্ছে সরকার। কালো টাকার মালিকদের এ ধরনের সুযোগ দেয়াকে বৈষম্যমূলক এবং অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর পক্ষে সে সময় বলা হয়, ‘অবৈধ অর্থকে এভাবে দায়মুক্তির নিশ্চয়তা দিয়ে সরকার প্রকারান্তরে নাগরিকদের দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। রাজস্ব বাড়ানোর খোঁড়া যুক্তিতে দুর্নীতি ও অনৈতিকতার গভীরতর ও ব্যাপকতর বিকাশকে স্বাভাবিকতায় পরিণত করা হচ্ছে। দুর্নীতিকে লাইসেন্স দেয়ার এই প্রক্রিয়া চিরতরে বন্ধ হবে এটাই প্রত্যাশিত।’

প্রতিবার বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হলেও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের উল্লেখযোগ্য কোন আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না। সহজ বা বিনা শর্তে বারবার অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেয়া হলেও এতে খুব বেশি সাড়া দেন না কালো টাকার মালিকরা। স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০ বছর কোনো না কোনোভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বহাল ছিল। তাতে সব মিলিয়ে বৈধ হয়েছে প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা। কালো টাকার সম্ভাব্য মোট পরিমাণের সবচেয়ে কম হিসাব বিবেচনায় নিলেও মূলধারায় ফিরেছে মাত্র আড়াই শতাংশ। অর্থনীতিবিদদের মতে, সাদা করার সুযোগ দেয়া বা না দেয়া দেশে কালো টাকার উৎপাদন ও বিকাশে কোনো ভূমিকা রাখে না। রাজনীতি ও অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ না হলে অবৈধ অর্থের দাপট কোনোভাবেই কমানো যাবে না। দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘যারা খারাপ কাজ করছে, তাদের শাস্তি হচ্ছে না বলেই অন্যরাও সেই পথে যাচ্ছে। সুতরাং এটা একেবারেই পরিষ্কার যে, কালো টাকার দাপট বন্ধ করতে হলে অপরাধীদের শাস্তি বিধান করতে হবে।’

আসলে, কালো টাকা সমাজ ও অর্থনীতিতে সংকট বাড়িয়েছে। ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জাতীয় অর্থনীতি। দুর্নীতি, চোরাচালানসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অবৈধ লেনদেন বন্ধে একের পর এক আইন করা হলেও দেশে অবৈধ আয়ের উৎস বন্ধ হয়নি। প্রতি বছরই নানা পন্থায় বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করছে দুর্নীতিবাজরা। এসব টাকা উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে কোনো ভূমিকা রাখছে না।

মূলত, কালো টাকা একদিকে অর্থনীতির ভারসাম্য নষ্ট করেছে, অন্যদিকে অবৈধ লেনদেন বাড়তে থাকায় রাষ্ট্র বঞ্চিত হয়েছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে। আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে অবাধে এ ধরনের অর্থকে বৈধ করার সুযোগ দেয়ায় দুর্নীতি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড উৎসাহিত হচ্ছে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য হলো, ‘দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি ও অর্থনীতির ছায়াতলেই কালো টাকার বিকাশ ঘটেছে। নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কারসহ সামগ্রিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত সমাজে কালো টাকার দাপটের অবসান হবে না।’

স্বাধীনতার পর প্রায় ৪০ বছর কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হলেও এতে পর্বত মূষিকও প্রসব করেনি বরং এর মাধ্যমে দুর্নীতি ও অনিয়মকে উৎসাহিত করা হয়েছে। দুর্নীতিবাজরা এ সুযোগ খুব কমই গ্রহণ করেছে। মূলত, কালো টাকা মালিকরা বগল বাজিয়ে নিজেদের অপকর্ম অব্যাহত রেখেছে। এর মাধ্যমে দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাট ও স্বেচ্ছাচারিতাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও প্রদান করা হয়েছে। তাই এই সুযোগ বাতিলের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বোধদয় ঘটেছে বলেই মনে হচ্ছে। যা খুবই সময়োচিত ও যৌক্তিক। কারণ, কালো কখনো সাদা হতে পারে না। আর এই অর্থের বর্ণবিন্যাসও জাতির জন্য কল্যাণকর নয়। তাই এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।

দৈনিক সংগ্রাম