কল্পনা করুন, আমরা নিজেরা কতটা দুর্নীতিমনা?
Share on:
প্রথম প্রেক্ষাপট কল্পনা করুন, অফিসে বসে কাজ করছি। বাড়ি থেকে আমার ছেলে ফোন করে বলল–‘বাবা, আজকে বাংলাদেশের ম্যাপের একটা প্রিন্ট আউট নিয়ে আসবা আমার জন্য? এটা আমার কালকের হোমওয়ার্ক; প্লিজ একটা প্রিন্ট আউট নিয়ে এসো। না হলে আমাকে বকা খেতে হবে।’
এমন ফোন এলে আমি কী করব? অফিসের প্রিন্টার থেকে কি ছেলের জন্য একটি প্রিন্ট আউট নিয়ে যেতাম না? আপনারা হয়তো বলবেন, এ তো শুধু একটি কাগজ আর একটু কালি। কিন্তু তবুও কাগজ আর কালি তো আমার অফিসের সম্পত্তি, আমার নয়।
প্রিন্ট করে নিয়ে গেলাম। আমি কি আমার সম্পদ নিয়ে গেলাম? না। আমি আমার অফিসের সম্পদ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
দ্বিতীয় প্রেক্ষাপট
কল্পনা করুন, একটি সেমিনারে অংশ নিতে এসেছি, যেখানে ফ্লিপচার্টে লেখার জন্য অনেক মার্কার ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছে। সেমিনারের আয়োজকরা আমাকে একটি ফ্রি নোটবুক, কলম ও একটি ব্যাগ দিয়েছেন। সারাদিন পর সেমিনার শেষ হলে আমি ইচ্ছাকৃতভাবে দুটো মার্কার ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে নিলাম, যেন সেগুলোও আমার নিজেরই। মার্কার আমার নেওয়ার কথা ছিল না। আমাকে শুধু নোটবই, কলম আর ব্যাগ দেওয়া হয়েছিল। তাহলে আমি কি আয়োজকদের সম্পত্তি চুরি করলাম না? আপনারা কি এই সামান্য চুরির কাজটিকে দুর্নীতি বলবেন?
অবশ্যই বলবেন; যা আমার নয়, তা কাউকে না বলে বা জোর করে নিয়ে নেওয়া–চুরি বা ডাকাতি।
তৃতীয় প্রেক্ষাপট
ধরুন, একটি রিকশা ভাড়া করেছি। ভাড়া ১০০ টাকা। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর আমি ইচ্ছাকৃতভাবে রিকশাওয়ালাকে ৯০ টাকা দিয়ে বললাম, আমার কাছে আর টাকা নেই। রিকশাচালক আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে ৯০ টাকাই নিলেন। তিনি হয়তো কিছু মনে করলেন না, কিন্তু আমি তো তাঁকে ১০ টাকা ঠকিয়ে দিলাম। এই কাজকে আপনারা কী বলবেন? যদি দুর্নীতি না হয়, তাহলে কী?
চতুর্থ প্রেক্ষাপট
ধরে নিতে পারেন, আমি একজন ঠিকাদার। এক কিলোমিটার রাস্তায় পিচ বসাচ্ছি। বাজেট ধরা হয়েছে ১ কোটি টাকা। আমি এ কাজের জন্য ২০ লাখ টাকা খরচ করে সরকারের কাছে ১ কোটির বিল পাঠিয়ে দিলাম। আপনারা আমার এ কাজকে কী বলবেন? দুর্নীতি, তাই না? নাকি না?
এই দুর্নীতিগুলো আমাদের মতো সাধারণ মানুষই করে। এতে আমাদের সবার হাত আছে। সরকারি অফিসে সেবা নিতে গিয়ে তাড়াতাড়ি সেবা পেতে টাকা দেওয়া, চাকরি বা পদোন্নতির জন্য ঘুষ দেওয়া–এমনটি আমরা সবাই করছি। সন্তানদের ভালো স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য আমাদের কানেকশনের আশ্রয় নিই বা ঘুষ দিই। হাসপাতালে একটু ভালো যত্ন বা দ্রুত পরিষেবা পেতে আমরা অতিরিক্ত টাকা দিই। বাড়িতে বৈদ্যুতিক সংযোগ বা মিটার লাগাতে বা মেরামতের জন্য আমরা ইউটিলিটি কর্মীদের ঘুষ দিই। আমরা পরীক্ষায় নকল করি; অনেকে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন অনেক দামে কিনে পরীক্ষা দেয়। আমাদের দেশের বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের ভালো ফল পাইয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের ঘুষ দেন। আমরা ঘুষের মাধ্যমে মিথ্যা সার্টিফিকেট বা ডিগ্রি পাই। আমরা ব্যক্তিগত লাভের জন্য জাল নথি তৈরি করি বা সরকারি রেকর্ড বদলে ফেলি। আমরা ব্যক্তিগত কাজের জন্য সরকারি যানবাহন ব্যবহার করি। আমাদের ভোটের প্রার্থী বা রাজনীতিকরা নির্বাচনের সময় ভোটারদের প্রভাবিত করার জন্য টাকা দেন।
এই আমরাই। এগুলো সব আমরাই করি। আমাদের প্রায় সবার জীবনেই দুর্নীতির কিছু না কিছু ছিটেফোঁটা আছে।
আসুন এবার আরও দুটো প্রেক্ষাপট দেখি।
পঞ্চম প্রেক্ষাপট
ভেবে নিন আমি চিনি, পেঁয়াজ ও ভোজ্যতেলের একজন বড় আমদানিকারক। আমার সঙ্গে এই একই পণ্যগুলোর অন্য আমদানিকারকদের ভালো সম্পর্ক আছে। একদিন সকালে আমি এবং আমার আমদানিকারকদের সংগঠন (ক্লাব বলে ডাকলে ভালো শোনায়) ৫০০ কোটি টাকা বাড়তি লাভ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। তাই আমি আমার গুদাম থেকে চিনি, পেঁয়াজ ও ভোজ্যতেল বাজারে ছাড়া বন্ধ করে দিলাম। এসব খাদ্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে গেল, আর আমি অনেক মুনাফা করলাম।
আপনারা আমার এই কাজকে কী বলবেন? এথিক্যাল ব্যবসা? কৌশলগত ব্যবসা? না। এটা বিশাল দুর্নীতি–যা গরিব মানুষের অকল্যাণ ডেকে আনে, কষ্ট দেয়, সাধারণ গরিব মানুষদের প্রতি আমার উদাসীনতার প্রমাণ দেয়।
ষষ্ঠ প্রেক্ষাপট
এবার ধরুন, আমি শিল্পকারখানা শুরু করার জন্য ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছি। ঋণ অনুমোদিত হওয়ার পর আমি প্রথমেই ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্ক দেখিয়ে বেশ কিছু জমি ও বিলাসবহুল একটি গাড়ি কিনে ফেললাম। জমি ও গাড়ি আমার আগে থেকেই ছিল, তবুও কিনলাম। আমার এই কাজকে আপনারা কী বলবেন? এটাও কি ব্যবসায়িক কৌশল? না; এটা আমানতকারীদের কষ্টার্জিত অর্থ নিয়ে দুর্নীতি করা। এবং আমি সম্ভবত লোন ডিফল্ট করব এবং ক্ষমতার উচ্চপর্যায়ে আমার কানেকশন ব্যবহার করে সহজেই পার পেয়ে যাব।
আমরা যদি চাই, এমন এক লাখ প্রেক্ষাপট নিয়ে মহালম্বা একটি ফর্দ তৈরি করে দিতে পারি, মোটা পুস্তক লিখে দিতে পারি এবং চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারি যে আমাদের দেশের প্রত্যেক মানুষই দুর্নীতিগ্রস্ত। দুর্নীতিতে আমাদের সবারই হাত আছে। দুর্নীতিগ্রস্ততায় আমরা একতাবদ্ধ। সম্ভবত শুধু অতিদরিদ্র ও মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা দুর্নীতিপরায়ণ নন।
সবচেয়ে হতাশার বিষয়, আমরা যে প্রতিনিয়ত দুর্নীতি করে যাচ্ছি, তা নিয়ে আমাদের মনে কোনো অপরাধবোধ নেই। থাকলেই বা কী হতো, ওই বোধের সঙ্গেও দুর্নীতি করে আমরা পার পেয়ে যেতাম!