‘গণমাধ্যম’ কেন আক্রমণের শিকার?
Share on:
বলা যেত আন্দোলনের মধ্যে আক্রমণের শিকার হয়েছে গণমাধ্যমও। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনায় ব্যাপারটা খানিক ভিন্ন। ‘আক্রমণের শিকার’ ব্যাপারটা অনেকটা ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’-এর মতো। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলন বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে তৈরি হওয়া সহিংসতার ঘটনায় গণমাধ্যম কর্মীরা আক্রমণের লক্ষ্য ছিলেন। এর বেশকিছু প্রমাণ গণমাধ্যম এমনকি ফেসবুক থেকেও পাঠক জেনেছেন।
বর্তমান লেখকের সহকর্মী মেহেদী হাসান মামুন (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, বণিক বার্তা) আহত হয়েছিলেন তার ক্যাম্পাসে। এর বাইরে আলোকচিত্রী সালাহউদ্দীন রাজু ও মাসফিকুর সোহানও সহিংসতার সাক্ষ্য বহন করছেন। লেখক ব্যক্তিগতভাবেও মৌখিক আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছেন একাধিক বার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এর কারণ কী?
সাংবাদিকের কাজ সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। ৯টা-৫টার চাকরির মতো এ পেশা নয়। তবে সাংবাদিকদের এ কাজ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা, কেবল ‘ক্রাইম রিপোর্টার’রাই এ ধরনের অবস্থার মধ্য দিয়ে যান। বাস্তবিক, কেবল খুন, ধর্ষণ, মানব পাচার বা কিডনি রÅাকেটের সংবাদ পরিবেশনকারী সাংবাদিকরাই এমন জীবনযাপন করেন বা টানটান উত্তেজনার মধ্যে থাকেন, ব্যাপারটা এমন নয়। গণমাধ্যমের প্রায় প্রতিটি কর্মী তার প্রতিটি কাজ নিয়ে স্নায়ুর সর্বোচ্চ ব্যবহার করেন। এটা সাংবাদিকতার শুরু থেকেই হচ্ছে। কেবল খুনের প্রতিবেদন নয়, একটা রিয়েল এস্টেট ব্যবসার দুর্নীতির খবর প্রকাশ করা সাংবাদিকও টার্গেটে পরিণত হতে পারেন ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর। সিনেমার সাফল্য নিয়ে মিথ্যা প্রচার করা নির্মাতা বা কলাকুশলীদের মিথ্যাচার প্রকাশ করা বিনোদন সাংবাদিকও হতে পারেন তাদের লক্ষ্য।
লেখার এ পর্যায়ে বলা ঘটনাগুলো সাংবাদিকতার শুরু থেকেই হয়ে আসছে। এগুলো নিয়ে লেখা হয়েছে প্রতিবেদন, তৈরি হয়েছে সিনেমা, লেখা হয়েছে গল্প। এর বাইরে আরেকটা প্রতিরোধ বা নিপীড়ন আসে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। সেটি নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান হতে পারে। তবে অবশ্যই ক্ষমতাশালী। জরুরি নয় যে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী। এর বাইরেও সামষ্টিকভাবে ক্ষমতাবান ব্যক্তি বা জোট সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের ওপর চড়াও হয়েছেন এমন খবর দুর্লভ নয়। জাতীয় দৈনিক বা টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক বা সাংবাদিকতার ইতিহাস ও তার বাহ্যিক রূপ এক রকম। এর বাইরে স্থানীয় সাংবাদিকতার একটা চিত্র আছে। বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে স্থানীয় সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা রাজনৈতিক দল, ক্যাডার বাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসনের মাধ্যমে হেনস্তা, শারীরিক নিগ্রহের শিকার হওয়ার পাশাপাশি জীবন দিয়েছেন এমন বহু প্রতিবেদন পাঠকের জানা। অর্থাৎ সাংবাদিকরা বরাবরই লক্ষ্যে ছিলেন।
এমনটা হওয়ার কারণ মূলত সত্য প্রকাশ এবং তার কারণে নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থে আঘাত। সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ করত সেই গোষ্ঠী। একটি নয়, একাধিক। এদের নির্দিষ্ট কোনো পরিচয়ে বাঁধা যায় না। জাতীয় পর্যায়ের সাংবাদিকদের তুলনায় স্থানীয় সাংবাদিকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতেন, কেননা তাদের প্রতিরক্ষার সুযোগ ছিল কম। স্থানীয় পর্যায়ে থাকার কারণে তাদের প্রতিরোধক্ষমতা কম হওয়ায় এ ঘটনা ঘটত। আবার জাতীয় পর্যায়ের সাংবাদিকরাও আক্রান্ত হয়েছেন। তারা বিচার অবধি পাননি। সাগর-রুনির বিষয়টি আমাদের সবারই জানা। সে ঘটনার কোনো বিচার আমরা অবধি দেখিনি।
কিন্তু নির্দিষ্ট সেই সব গোষ্ঠী বাদেও এখন গণমাধ্যম কর্মীরা সার্বিকভাবে আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছেন। তবে তার আগে হয়েছিলেন ক্ষোভের কারণ।
গণমাধ্যম শব্দটির শুরুতেই আছে ‘গণ’ অর্থাৎ গণমানুষ। গণমাধ্যমের দায়িত্ব মূলত গণমানুষের কথা বলা। একালে গণমাধ্যমের প্রতি জনতারই একটা ক্ষোভ আছে। আর সে ক্ষোভের কারণ হিসেবে জনতা বলে, গণমাধ্যম তার কাজটি করছে না। গণমাধ্যমের কাজ ছিল মূলত সত্য প্রকাশ। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর তারা সেটি না করে কারো না কারো মুখপাত্রে পরিণত হয়। সত্য প্রকাশে গণমাধ্যম দুই পা পিছিয়ে গেছে এ কথা আজ গণমানুষই বলে থাকে। তারা আবার বলে থাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কেননা তাদের মতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই তাদের কথা বলা ও কথা প্রচারের উপযুক্ত মাধ্যম। গণমাধ্যম তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে পুলিশ ও বিশৃঙ্খলা তৈরি করা নির্দিষ্ট ছাত্র সংগঠন বাদেও এলাকার অলিগলিতে আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছিলেন গণমাধ্যমকর্মীরা। কেননা মানুষ মনে করছে, গণমাধ্যম এ আন্দোলনের ক্ষেত্রে সত্য প্রকাশ করেনি। তারা ফেসবুকে দেখেছেন নানা ঘটনা কিন্তু তার প্রকাশ গণমাধ্যমে পাননি। ১৯ জুলাই দিবাগত রাত থেকে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের সময় খবরাখবর জানার জন্য মানুষের একমাত্র অবলম্বন ছিল টেলিভিশন। কিন্তু টেলিভিশনে মানুষ তাদের পছন্দ বা প্রয়োজনমতো তথ্য পায়নি। প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেল (দু-একটি বাদে) অনেকটাই কেটেছেঁটে ‘খবর’ প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে একটি চ্যানেলের সাংবাদিক পুলিশকে গুলি করতে উদ্বুদ্ধ করছেন (তিনি ভালো একটি ভিডিও নেয়ার আশায়) এমন ক্লিপও মানুষ দেখেছে। এর বাইরে ছাত্রদের আন্দোলন নিয়ে তারা ফর্মুলা অনুসারে খবর প্রকাশ করেছেন বলে মানুষের অভিযোগ।
বিশ্বজুড়েই গণমাধ্যমের ওপর আছে এক রকম সেন্সরশিপ। সরকার, প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে এই সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়। কেবল সরকার নয়, বাণিজ্যিক নানা প্রতিষ্ঠানও তাদের চাহিদা অনুসারে ব্যবহার করে থাকে গণমাধ্যমকে। এর ফলে গণমাধ্যম সত্যিই কিছু ক্ষেত্রে তার নিজের কাজ, দায়িত্ব ও উদ্দেশ্য থেকে সরে এসেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘সেলফ সেন্সরশিপ’। যতটা না প্রতিষ্ঠান তাদের নিয়ন্ত্রণ করে, তারা নিজেরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করে বেশি। এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি বিশ্বজুড়ে তৈরি হয়েছে। তীব্র ডানপন্থার উত্থানের পাশাপাশি এ ভয়ের সংস্কৃতি ও পুঁজিবাদ সংবাদমাধ্যমকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে গণমানুষ আস্থা হারিয়েছে গণমাধ্যম থেকে।
এর সঙ্গে গণমানুষেরও আছে কিছু ভুল। তারা গণমাধ্যমকে ভুল বুঝেছে অর্ধ দর্শকের বেশি সময় ধরে। গণমাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেটের বিস্তৃতি ও সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তার আগে মানুষ জানত টেলিভিশনকে। তার আগে জানত প্রিন্ট মিডিয়াকে। কিন্তু গত অর্ধদশক ও বিশেষত কভিড-১৯ মহামারীর পর তারা আপন করে নিয়েছে ফেসবুক ও ইউটিউবের কিছু পেজ ও চ্যানেলকে। এসব চ্যানেল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কনটেন্ট নিয়ে কাজ করে। আর তারা দিয়ে থাকে পপুলার ন্যারেটিভ।
পপুলার ন্যারেটিভেরও নানা ধাঁচ আছে। প্রতিষ্ঠান, সরকার বা ক্ষমতাসীনের পক্ষে কথা বলা একদিকে যেমন পপুলার ন্যারেটিভ বা অবস্থান, তেমনি পুরোপুরি বিপরীত বা বিরুদ্ধে কথা বলাও আরেক রকম জনপ্রিয় ধারায় অবস্থান। এছাড়া ইউটিউবে আছে লোকরঞ্জন করার মতো চ্যানেল। তারা দাবি করে তারা খবর প্রকাশ করে কিন্তু আদতে তারা খবর নয়, কনটেন্ট প্রচার করে। লোকে এসবে মজা পায়। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এরা কখনই সাংবাদিক নয়।
কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটি ভিডিও চোখে পড়ে। কারওয়ান বাজারের মেট্রো স্টেশনের লিফটের নিচে এক কনটেন্ট ক্রিয়েটর লিফটে উঠতে চাওয়া তরুণকে প্রশ্ন করছেন তিনি প্রতিবন্ধী বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কিনা। কনটেন্ট ক্রিয়েটর ভদ্রলোক মূলত তার রিচ বাড়াতে এমন একটি ভিডিও করেছেন। কেননা প্রায় শূন্য লিফটে ছেলেটি উঠলেও তাতে কোনো ক্ষতি হতো না। এ ভিডিওর কমেন্ট সেকশনে অনেকেই কনটেন্ট ক্রিয়েটরকে ‘সাংবাদিক ভাইটি’ বলে বিদ্রূপ করে কমেন্ট করেছেন। কিন্তু আদতে লোকটি সাংবাদিক নন।
গণমাধ্যমকে গত কয়েকটি বছরে ভুল বোঝা হয়েছে। ইউটিউব কনটেন্টের যুগে সাধারণ মানুষই বদলে দিয়েছে সাংবাদিকতার সংজ্ঞা। অনেক ক্ষেত্রে তারা জানেই না সাংবাদিকতা কী বা সাংবাদিক কারা। যাকে তাকে সাংবাদিক তকমা দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে মূল ধারার কিছু গণমাধ্যমও একসময় টেলিভিশনের টিআরপি ও পরে ইউটিউবে ভিউ বাণিজ্যের কারণে নানা সুড়সুড়িমূলক, মিথ্যা ও সংবেদী শিরোনাম বা বক্তব্যের তথ্য ও কনটেন্ট প্রচার করেছে। ফলে গণমাধ্যমের ওপর থেকে মানুষের ভরসা দিনদিন কমেছে। তারা কেবল বাণিজ্য করে গেছে। সংবাদ, তথ্য বা খবরের চিন্তা করেননি, সত্য তো পরের কথা।
এর মধ্যেও কিছু গণমাধ্যম নিজের কাজটা করে গেছে নিষ্ঠার সঙ্গে। এখনো দেশের একাধিক জাতীয় দৈনিক নিয়মিত গঠনমূলক লেখা প্রকাশ করে। সেই সঙ্গে থাকে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে নানা স্টোরি। চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়েও ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট ও তার পরে দেশের প্রিন্ট মিডিয়া সত্য প্রকাশে পেছপা হয়নি। প্রায় প্রতিটি ছাপা পত্রিকা নিয়মিত সত্য ঘটনা প্রকাশ করেছে। কিন্তু প্রিন্ট মিডিয়ার জনপ্রিয়তা যেহেতু আধুনিকতার কারণেই খানিকটা কমেছিল, তারা দায়িত্ব পালন করেও গণমানুষের কাছে পৌঁছতে পারেনি পুরোপুরি। অন্তত জনপ্রিয় ধারায়।
বাংলাদেশ টেলিভিশনে আক্রমণ করার সময় আক্রমণকারীরা ‘বাতাবি লেবু’ বলে বিদ্রূপ করেছিল, একই রকম বিদ্রূপ গত কয়েক দিনে দেখা গেছে অন্যান্য বিষয়ে। তবে সেই তুলনায় প্রিন্ট মিডিয়ার প্রতি আক্রোশ কমই দেখা গেছে। কিন্তু সাংবাদিকতাকে ভুল বোঝা ও সেই ভুলকে সংশোধন না করার কারণে জনতার ক্ষোভও প্রশমিত হয়নি। তারা গণমাধ্যমকে দেখছেন ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে। সে কারণেই আন্দোলনের সময় ইটপাটকেল ছুটে এসেছে গণমাধ্যম কর্মীদের দিকে। কারফিউর সময় অলিগলি বা অন্ধকার রাস্তায় কোথাও পথ আটকে সাংবাদিক দেখলে তাকে হেনস্তা করেছে আন্দোলনকারীর ছদ্মবেশে থাকা লোকজন। অর্থাৎ এক ধরনের রোষের লক্ষ্য ছিলেন বা আছেন গণমাধ্যম কর্মীরা।
এত কিছুর মধ্যে বলা যায়, গত ১০-১৫ দিনে প্রিন্ট মিডিয়া যেভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে সেটি আশাজাগানিয়া। সেই সঙ্গে ছিল কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলও। একাধিক প্রতিবেদন নিয়ে ছাত্রসমাজ ও গণমানুষের মধ্যে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তাই আশা করা যায়, গণমাধ্যম নিয়ে এ ভুল ধারণা থেকে গণমাধ্যমই নিজেদের বের করে আনবে।