সম্পাদকীয় প্রকাশনার সময়: শনিবার ১৭, অগাস্ট ২০২৪

ওয়াসার অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর করে পানির দাম কমানো হোক

Share on:

ওয়াসার প্রধান কাজ সুপেয় পানি নিশ্চিত করা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি নিতান্তই পানির ‘দাম বাড়ানো’ একটি স্বেচ্ছাচারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তবে কেবল দামই নয়, ব্যয় বাড়ানো আর একই ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মেয়াদ বাড়ানোও হয়ে উঠেছিল এ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম কাজ।


নিরাপদ ও মানসম্মত এবং নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহে প্রায় পুরোপুরি ব্যর্থ এটি। এসব কিছুর জন্য মূলত দায়ী ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে প্রথমবারের মতো নিয়োগ পান সদ্য পদত্যাগ করা এমডি। এরপর ছয় দফায় তার মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ গত বছরের আগস্টে সপ্তমবারের মতো ওই পদে আরো তিন বছরের জন্য নিয়োগ পান তিনি। আর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ১৬ বছরে ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বেড়েছে ১৬ বার। বণিক বার্তার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ওয়াসায় তৎকালীন এমডিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল নিয়মবহির্ভূতভাবে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পানিসংক্রান্ত কাজে ন্যূনতম ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকার কথা উল্লেখ থাকলেও এ বিষয়ে কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা ছাড়াই নিয়োগ পেয়ে যান ‍তিনি। এমনকি লিখিত পরীক্ষারও শর্তাদি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কেবল ভাইভা বোর্ডের নম্বরে এমডি হন।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সম্প্রতি ওই এমডি পদত্যাগ করলে তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন একজন প্রকৌশলী। অধিকাংশ গ্রাহকের প্রত্যাশা ছিল নতুন এমডি পানির দাম কমিয়ে আনবেন। তবে নতুন এমডি বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, সবকিছুর দাম যেহেতু বাড়তি, সেখানে পানির দাম কমানো কীভাবে সম্ভব। তিনি আরো জানান যে ওয়াসায় কোনো দুর্নীতি হয়নি। যদি কোনো প্রমাণ থাকে, তাকে দিতে হবে। প্রমাণ সাপেক্ষে তিনি ব্যবস্থা নেবেন।

ক্ষমতাচ্যুত তৎকালীন এমডি বিদেশী ঋণে বড় বড় প্রকল্পের নামে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। যদিও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তা অগ্রাহ্য করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে এবার শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দুর্নীতিগ্রস্ত এমডির বিরুদ্ধে সরব হয়েছে দুদক। অস্বাভাবিক লেনদেনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের তালিকায়ও সন্দেহভাজন হিসেবে তার নাম রয়েছে।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে ওই এমডি কর্তৃক গৃহীত কোনো প্রকল্পই সফলতার মুখ দেখেনি। উল্টো বিদেশী চড়া সুদের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে প্রতি বছরই পানির দাম বাড়িয়ে গ্রাহকের ওপর চাপ বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ গত ১ জুলাই পানির দাম ১০ শতাংশ বাড়িয়েছে ওয়াসা। আর দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে দর্শানো হয়েছে বিদ্যমান পানির দামে সংস্থাটির পরিচালন ব্যয় ও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি (ডিএসএল) পরিশোধ দুরূহ হয়ে পড়েছে।

আইন অনুযায়ী, প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে পানির দাম বাড়াতে পারে ঢাকা ওয়াসা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে ওয়াসা বোর্ডের অনুমোদন নিতে হয়। আর ৫ শতাংশের বেশি বাড়াতে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু ওয়াসা সূত্রেই জানা যায়, বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই ১০ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই অভিযোগ উঠেছিল, নিয়ম না মেনে পানির দাম বাড়ানোর।

এর আগে ২০২২ সালে ওয়াসা আরেকবার দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সে সময় তারা কার্যকর করতে পারেনি উচ্চ আদালতে রিট হওয়ার কারণে। ওই রিটেও দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে ওয়াসার নিয়ম না মানার কথাই উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ ওয়াসা বোর্ডকে ‘নামেমাত্র’ করে রেখেছিলেন তৎকালীন এমডি। ২০১৭ সাল থেকে শুরু করে টানা তিন বছর ৫ শতাংশ করে পানির দাম বাড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আর সরকারের অনুমোদনের পর ২০২০ সালে আবাসিক গ্রাহকদের জন্য পানির দাম ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছিল।

বর্তমানে বিভিন্ন প্রকল্পে ওয়াসার ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি এবং বাস্তবায়নের পর তা চালু করতে না পারার মতো কারণে সংস্থাটির ব্যয় বেড়েছে। এ অবস্থায় দাম কমাতে হলে সবার আগে প্রয়োজন ওয়াসার দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করা। পাশাপাশি প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ সামনে আনা। বিশেষজ্ঞদের মতে, ওয়াসাকে স্বচ্ছ-জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা জরুরি। তাহলে পানির দাম কমানো সম্ভব।

ওয়াসা দফায় দফায় পানির দাম বাড়ালেও নগরবাসীকে সুপেয় পানি সরবরাহ করতে পারছে না। প্রায় শতভাগ গ্রাহককে ওয়াসার পানি ফুটিয়ে পান করতে হয়। এতে গ্যাসের বাড়তি ব্যবহারে আর্থিক ঝুঁকি বাড়ছে গ্রাহকদের। আবার ফুটানো পানি সর্বদা নিরাপদ হয় না। নিয়ম মেনে পানি না ফুটানো গেলে তাতে পানির প্রয়োজনীয় মান নষ্ট হয়। এতে পানিবাহিত বা পানিজনিত রোগ বাড়ার আশঙ্কা থাকে, যা মানুষের স্বাস্থ্য ব্যয়ও বাড়াবে।

নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, এ সরকার ওয়াসার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। কোনো ধরনের গণশুনানি ও যৌক্তিক কারণ ছাড়া ঢাকা ওয়াসা যাতে পানির দাম বাড়াতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে ওয়াসার প্রকৃত ব্যয় নিরূপণ করতে হবে। সবচেয়ে জরুরি হলো, ওয়াসার পানির মান বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া।

নিরাপদ পানি সুস্বাস্থ্যের জন্য অতীব জরুরি। সারা দেশের মানুষ এরই মধ্যে এক ধরনের অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করছে। তাদের কাঁধ থেকে জীবনধারণের মৌলিক উপাদান পানির বাড়তি দামের বোঝা কমবে, ওয়াসা একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে—এটিই কাম্য।