এ দেশে যেন আর কালরাত নেমে না আসে
Share on:
বছর ঘুরে আবার এসেছে শোকের মাস, আমাদের দুঃখ-বেদনা, লজ্জা-অনুশোচনার মাস আগস্ট। বাংলাদেশের, বাঙালি জাতির মর্মস্থলে জ্বলন্ত লৌহশলাকার মতো বিদ্ধ হয়ে আছে প্রায় অর্ধশতাব্দী আগেকার নির্মমতা, নৃশংসতা, বিশ্বাসঘাতকতা, রক্তপাতের এক মর্মন্তুদ স্মৃতি। এ দেশ, এ জাতি কখনও ভুলবে না, ভুলতে পারে না ১৯৭৫-এর আগস্ট মাসের ১৫ তারিখের সেই ভয়াল রাতের কথা।
সে রাতে পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তাদের পরিবারের প্রায় সব সদস্য, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন, দেহরক্ষী, ভৃত্য সব মিলিয়ে ২৮ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক রাজনৈতিক গণহত্যাকাণ্ডের অধ্যায়টি রচনা করে। খুনিরা বঙ্গবন্ধুর নিজের ও পরিজনের পরিবারের নববিবাহিত আর সন্তানসম্ভবা বধূ থেকে শুরু করে দুগ্ধপোষ্য শিশু, অবোধ বালক পর্যন্ত কাউকে হত্যার বাইরে রাখেনি।
ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বিশ্বের ইতিহাসে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নতুন কিছু নয়। কালে কালে, যুগে যুগে বহু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। দূর সময়ের কথা বাদ দিয়ে শুধু সাম্প্রতিক কালের ইতিহাসে চোখ রাখলেও দেখা যাবে, ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী এবং পাকিস্তানের প্রথম উজিরে আজম বা প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানও আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর পুত্র প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী এবং পাকিস্তানের উজিরে আজম জুলফিকার আলি ভুট্টো ও তাঁর কন্যা উজিরে আজম বেনজির ভুট্টোও পরবর্তীকালে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। যদিও জুলফিকার আলি ভুট্টোর বেলায় বিচারের প্রহসন করে ফাঁসিকাষ্ঠে চড়ানো হয়েছিল।
নবজাত বাংলাদেশে পঁচাত্তরের আগস্টে পরিবার-পরিজনসহ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নির্মমতা ও ব্যাপকতার দিক থেকে বাকি সব রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। এর আগে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক নেতা বা সরকারপ্রধান হত্যাকাণ্ডের শিকার হননি। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়েই এ দেশে এই অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা হয়। যার ধারাবাহিকতায় একই বছরের নভেম্বরে জেলবন্দি অবস্থায় নিহত হন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামান এবং আরও পরে ১৯৮১ সালে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান।
পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে খুনিদের বিচার ও দণ্ড নিশ্চিত করে জাতিকে সেই লজ্জা ও কলঙ্ক থেকে কিছুটা মুক্তি দিয়েছেন বটে; হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি সেই মহান নেতাকে চিরতরে হারানোর শোক, বেদনা আর মনোকষ্টের আগুন আজও পুরোপুরি নেভেনি। অর্ধশতাব্দী ধরে সবচেয়ে বেশি পুড়ছেন শেখ হাসিনা নিজেই। তিনি জীবনে যা হারিয়েছেন, এ পৃথিবীতে আর কারও জীবনে অত বেশি হারানোর উদাহরণ আছে কিনা জানি না।
ক্যালেন্ডারে প্রতিবছর আগস্ট মাস আসে আমাদের সেই দুঃসহ শোকের ক্ষতকে আরও একবার উস্কে দিতে। পুরোনো ক্ষত থেকে নতুন করে রক্তক্ষরণ হয়। জনকের পবিত্র রক্তপাতের স্মৃতিকে সাক্ষী রেখে আবারও আমরা নতুন করে শপথ নিই বাংলাদেশের পবিত্র মাটি থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, পাকিস্তানপন্থি শক্তিকে চিরতরে নির্মূল নিশ্চিহ্ন করে ফেলার।
আমাদের সেই প্রয়াস এখনও সম্পূর্ণ সফল হয়নি। এখনও দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পুরোনো সেই সাপগুলো লুকিয়ে আছে। সুযোগ পেলে এখনও তারা তাদের অন্ধকার গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে ছোবল বসানোর জন্য প্রস্তুত। অর্ধশতাব্দী কাল ধরে মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষের শক্তির বহু চেষ্টা ও সংগ্রাম সত্ত্বেও এসব সাপের বিষদাঁত এখনও সম্পূর্ণ ভাঙা যায়নি– এটাই গভীর উদ্বেগের বিষয়।
বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার গণরায় নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী এবং জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করেছে। তা সত্ত্বেও রক্তবীজের ঝাড়ের মতো এদের চিন্তাধারার অনুসারীদের বিলুপ্তি ঘটেনি। তলে তলে এখনও তারা তাদের প্রতিক্রিয়াশীল ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে চলেছে। ন্যূনতম একটা সুযোগ পেলে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সামান্যতম অবনতি বা হেরফের ঘটলে, তারা সেই সুযোগের অসদ্ব্যবহার করে নানা ধ্বংসাত্মক, নাশকতামূলক ও হন্তারক তৎপরতার মাধ্যমে জননেত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়।
ছাত্রসমাজসহ সমগ্র জাতিকে এখন আগের চেয়ে আরও বেশি সচেতন থাকতে হবে– কোনো অগণতান্ত্রিক, প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি ভবিষ্যতে আর কোনোদিন যেন বাংলাদেশকে ছিনতাই করে নিতে না পারে; মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিপক্ষ আবারও এ দেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মতো আরেক কালরাত্রি ডেকে আনতে না পারে। এ দেশে যেন দ্বিতীয় শোকের মাস না আসে।