‘এস আলম’ আসলে কার?
Share on:
উইকিপিডিয়ায় এস আলমের পরিচিতিতে লেখা হয়েছে এস আলম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক। তাঁর পুরো নাম মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ওরফে মাসুদ। প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর ২১১৯, আছদগঞ্জ, চট্টগ্রাম। এস আলম এই কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কর্মীসংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে এস আলম ছিলেন অনেকটা ধরা ছোঁয়ার উর্ধ্বে। তাঁর দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ পেলে নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ তাঁকে রক্ষায় নানা কৌশলের আশ্রয় নিত।
গত বছর ডেইলি স্টার পত্রিকার অনুসন্ধানে এস আলম ও তাঁর স্ত্রী ফারজানা পারভীনের সিঙ্গাপুরে কমপক্ষে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার তথ্য বেরিয়ে আসে। যদিও তাঁরা বিদেশে বিনিয়োগ বা তহবিল স্থানান্তরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নেননি। এই খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ আদালত আদেশ দেন যে এস আলম গ্রুপের অর্থ পাচার নিয়ে কোনো তদন্ত করা যাবে না। এমনকি এস আলমের পক্ষে এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ বন্ধ করার আবদার নিয়ে আদালতে রিটও করা হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের যতজন ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ১ নম্বরে ছিলেন এস আলম। আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নেওয়ার পর বিভিন্ন খাতে তাঁর লুটপাটের কাহিনি বের হতে থাকে। আটটি ব্যাংকের মালিকানা ছিল এই গ্রুপের। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
অনেকের ধারণা ছিল, এস আলমের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দহরমমহরম বেশি থাকায় বিএনপির নেতারা তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন। কিন্তু সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো দুটি ঘটনায়।
প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, এস আলমের মালিকানাধীন গাড়িতে চড়ে নিজ এলাকায় গিয়ে সংবর্ধনা নিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদ। ঢাকা থেকে তিনি বিমানে কক্সবাজার বিমানবন্দরে পৌঁছান। এরপর দলের নেতা-কর্মীদের গাড়িবহরের সঙ্গে পেকুয়ায় পৌঁছান তিনি।
রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে এস আলম যেসব প্রতিষ্ঠান দখল করেছিলেন, ক্ষমতা পরিবর্তনের পর সেসব প্রতিষ্ঠান ভঙ্গুর হয়ে পড়লেও অনেক কর্মকর্তা তাঁর অন্যায় সুবিধার অংশীদার ছিলেন এবং দেশে–বিদেশে সম্পদ গড়েছেন। এস আলমের পাশাপাশি তাদের সম্পদেরও হিসাব নেওয়া জরুরি বলে মনে করি।
কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে সালাহউদ্দিন আহমেদের গাড়িবহর পেকুয়ায় পৌঁছানোর বিভিন্ন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এ রকম একটি ভিডিওতে দেখা যায়, যে গাড়িতে (জিপ) চড়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ কক্সবাজার থেকে পেকুয়ায় আসেন, সেটির নম্বর চট্ট মেট্রো ঘ-১১-১৫৩৩। এটি মিতসুবিশির স্টেশন ওয়াগন ব্র্যান্ডের জিপ। তিনি সামনে সিটে বসে হাত নেড়ে আশপাশের লোকজনকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন।
এস আলম পাওয়ার প্ল্যান্টের নামে এই গাড়িটি ২০১০ সালে নিবন্ধন করা। ঠিকানা লেখা আছে এস আলম ভবন, চট্টগ্রাম নগরের আছদগঞ্জ। এটি এস আলম গ্রুপের প্রধান কার্যালয়।
এস আলমের গাড়িতে চড়ার বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে এলে সালাহউদ্দিন আহমেদ দুঃখ প্রকাশ করেন। কিন্তু দুঃখ প্রকাশ করলেও তিনি রেহাই পাননি। দলের পক্ষ থেকে তাঁকে শোকজ করা হয়েছে।
রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন আছে, এস আলমের সঙ্গে বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন আহমেদের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ২০১৫ সালে সরকার বিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে সালেহউদ্দিন যে বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন, সেটি এস আলমের মালিকানাধীন একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের। পরে সেই বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যায়। এরপর তাঁকে পাওয়া যায় বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে মেঘালয়ে। সেখানে তাঁকে সাড়ে ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়। সালাউদ্দিন দেশে ফেরার পর এস আলম গ্রুপ ও ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাকে বাসায় গিয়ে ফুল দিয়ে বরন করে নেন।
এদিকে ২৯ আগস্ট চট্টগ্রামের কালুরঘাট এলাকার একটি কারখানা থেকে বিলাসবহুল কয়েকটি গাড়ি বের হওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা যায়, একটি কারখানা থেকে একের পর এক দামি গাড়ি বের হচ্ছে। সেখানে কয়েকজন ব্যক্তি তা তদারক করছেন।
যাঁরা ভিডিওটি শেয়ার করেছেন, তাঁদের ভাষ্য, এগুলো শিল্প গ্রুপ এস আলমের গাড়ি এবং যাঁরা তত্ত্বাবধানে আছেন, তাঁরা বিএনপির নেতা-কর্মী। এ ঘটনার পর দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ানসহ তিন নেতাকে কারণ দর্শানোর চিঠি দিয়েছে দলটি। গাড়ি-কাণ্ডে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের একটি সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ১১ আগস্ট ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় দখল করতে এস আলম গ্রুপের পক্ষে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্যসচিব রবিউল ইসলাম ওরফে নয়নকে ভাড়া করার কাজটি হয় আকিজ উদ্দিনের তত্ত্বাবধায়নে। আকিজউদ্দিন এস আলমের পিএস ছিলেন। পরে তিনি ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি হন। (চট্টগ্রাম প্রতিদিন, ২৮ আগস্ট, ২০২৪)
এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলমের (মাসুদ) মেয়ের শ্বশুর মীর গ্রুপের আবদুস সালাম বিএনপির নেতা এনামুল হক এনামের মামাতো ভাই। কালুর ঘাটে যে ওয়্যার হাউস থেকে গাড়িগুলো বের হয়েছিল, সেটি মীর গ্রুপের।
এস আলম গ্রুপ ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি ইসলামী ব্যাংক দখল করে। সেই দখল প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) কিছু কর্মকর্তা। সহকর্মী সানাউল্লাহ সাকিব প্রথম আলোয় লিখেছেন, ‘২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি। পরীবাগের বাসায় ছিলেন ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মান্নান। ভোরের দিকে হঠাৎ করেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা। জানান, তাঁকে তাঁদের সঙ্গে যেতে হবে। তবে আবদুল মান্নান একাই নন। একইভাবে নিজ নিজ বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানকেও।’
এদিকে এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম (এস আলম) ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ১৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এ তদন্ত শুরু করেছে। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান জানিয়েছেন, এস আলম গ্রুপের মালিক ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাতিল করে বাংলাদেশেই স্থায়ীভাবে বসবাসের (পিআর) অনুমতি নিয়েছেন। পাশাপাশি সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সাইপ্রাসসহ ইউরোপে দেশ থেকে অর্থ পাচার করে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ গড়েছেন। পাচার করা অর্থে প্রায় ২৪৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের ক্যানালি লজিস্টিক প্রাইভেট লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে সিঙ্গাপুরে। এ ছাড়া জালজালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানি ও বিনিয়োগের নিমিত্তে নামে-বেনামে ৬টি ব্যাংক থেকে ৯৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন তাঁরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক এস আলম গ্রুপের সম্পদ বিক্রি করে ঋণের টাকা তুলে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। কেন্দ্রীয ব্যাংক তাঁর সম্পদ না কেনার জন্যও জনগণের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে। কিন্তু এস আলমের ঋণের পরিমান ব্যাংকের কাছে বন্ধক দেওয়া সম্পদের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে সম্পদ বিক্রি করলে কিছু টাকা উঠতে পারে। পুরো টাকা আসবে না। আরও অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বেলায়ও এ কথা প্রযোজ্য। একই সম্পদ বন্ধক রেখে একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে তারা।
এস আলমের কারণে টাকা ফেরত না পাওয়ার ঝুকি তৈরি হয়েছে প্রায় দুই কোটি ব্যাংক আমানতকারীর। এতে আস্থাহীনতায় পুরো ব্যাংক খাত ঝুকির মুখে পড়েছে।
আশির দশকে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করা এস আলম গ্রুপ সব সরকারের সঙ্গেই সদ্ভাব রক্ষা করে চলত। চট্টগ্রামের সাংবাদিকদের সূত্রে জেনেছি, বিএনপি ও ইসলামী দলগুলোর সঙ্গেই এস আলমের ঘনিষ্টতা বেশি ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাঁর মামা আখতারুজ্জামান চৌধুরীর সূত্র ধরে তিনি সরকারের শীর্ষ মহলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান। জোর করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখল করেন। আর এ ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এস আলম ও তাঁর সহযোগীরা নানা কৌশলে বিএনপির নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন গাড়িতে সালাহউদ্দিন আহমেদের সংবর্ধনাস্থলে যাওয়া কিংবা এস আলমের প্রতিষ্ঠান থেকে বিএনপির নেতাদের ১৪টি গাড়ি বের করে নেওয়া দুটি উদাহরণ মাত্র।
রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে এস আলম যেসব প্রতিষ্ঠান দখল করেছিলেন, ক্ষমতা পরিবর্তনের পর সেসব প্রতিষ্ঠান ভঙ্গুর হয়ে পড়লেও অনেক কর্মকর্তা তাঁর অন্যায় সুবিধার অংশীদার ছিলেন এবং দেশে–বিদেশে সম্পদ গড়েছেন। এস আলমের পাশাপাশি তাদের সম্পদেরও হিসাব নেওয়া জরুরি বলে মনে করি।