এবারের লড়াইটা ছিল দেশীয় কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে
Share on:
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতিকে এমন এক ক্রস রোডে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যা আগে কখনও ঘটেনি। এমনকি একাত্তরেও না। একাত্তরে পথটা ছিল দুর্গম ও কঠিন; কিন্তু লক্ষ্য ছিল সুনির্দিষ্ট ও একমুখী। জানা ছিল পথের শেষে কী আছে।
পৌঁছতে না পারলে কী হবে, তাও জানা ছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের বাস্তবতা ভিন্ন। একাত্তরের লড়াইটা ছিল বিদেশি আধা ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে। এবারের লড়াইটা হলো দেশীয় কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। লড়াইয়ের এই চরিত্রগত পার্থক্যই বর্তমান পরিস্থিতির সমীকরণকে করে তুলেছে জটিল। সেই জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে দেশ তথা দেশের রাজনীতি।
ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থানের তোড়ে ভেসে যায় শেখ হাসিনার ১৫ বছরের সাজানো ভুবন, তাতে দৃশ্যত একক নেতৃত্ব ছিল না; না কোনো দল, না কোনো নেতা। চরম ডান থেকে চরম বাম; সবার অংশগ্রহণেই ছাত্র আন্দোলন রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। সময় ও পরিস্থিতির দাবিতে নানামুখী অংশীজন এক মোহনায় এসে মিললেও আন্দোলনের সাধারণ গন্তব্য না থাকায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর ভরকেন্দ্র খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে গণঅভ্যুত্থানে পতনের পর টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। দলের শীর্ষ ব্যক্তি শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ইতোমধ্যে দলের প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় নেতা গা-ঢাকা দিয়েছেন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছেন। আগামী দিনে দলটির অবস্থা কী দাঁড়াবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। মাঠে অনেক গুজবই ঘুরছে। ভবিতব্যই বলবে কী অপেক্ষা করছে দলটির জন্য। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ের মতো ঘুরে দাঁড়াবে, নাকি মুসলিম লীগের মতো ইতিহাসের কানাগলিতে ঠাঁই নেবে, তা কেবল সময়ই বলতে পারে।
অন্যদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। আওয়ামী আমলে দলটির হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক জেল খেটেছেন বা জেল এড়াতে পলাতক জীবন কাটিয়েছেন। গত দেড় দশকে কয়েকবারই বিএনপি চেষ্টা করেছে সরকারবিরোধী সফল আন্দোলন গড়ে তুলতে; শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। দৃশ্যত হতাশ দলটি ছাত্র-জনতার আন্দোলন ‘কোটা সংস্কার’ থেকে সরকার পতনের এক দফায় পরিণত হওয়ার সময় থেকেই চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তারা প্রকাশ্যেই আন্দোলনে সংহতি ও একাত্মতা ঘোষণা করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ৫ আগস্ট সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে সর্ববৃহৎ বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি ভাবতে শুরু করে, তারাই জিতে গেছে এবং এবার তারাই ক্ষমতার মসনদে বসতে যাচ্ছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর মাঠে আরও অনেক শক্তি দাঁড়িয়ে যাওয়া দেখে দলটির প্রাথমিক উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়তে শুরু করে।
বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র ও আন্দোলনের সাথী জামায়াতে ইসলামীও এক দশকের বেশি সময় পর মাঠে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা হাজার হাজার মানুষের সমাবেশও ঘটিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারেও তাদের প্রভাব বেশ ভালোভাবে লক্ষণীয়। সেনাপ্রধান তাঁর প্রথম বৈঠকে তখন পর্যন্ত নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং বৈঠক পরবর্তী প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রথমেই দলটির নাম উল্লেখ করেছেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও দলটির প্রাক্তনী বা ভাবাদর্শিক ঘনিষ্ঠদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। এতে করে বিএনপির কাছে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়– বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না। বরং তাদের এক সময়ের মিত্র জামায়াতই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ফলে দুই দলের মধ্যে এক ধরনের দূরত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমাদের সব সময় জামায়াতের সঙ্গে ট্যাগ করবেন না যে জামায়াত-বিএনপি। না, এটা একদম ঠিক না। জামায়াত আলাদা দল, বিএনপি আলাদা দল। দুই দলের দৃষ্টিভঙ্গি এক না’। (সমকাল, ২৮ আগস্ট ২০২৪)।
এদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান বলেছেন, ‘বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর বাস্তবে কোনো দলীয় জোট নেই। গত আন্দোলনে বিএনপি থেকে জোট না থাকার ঘোষণা দিয়েছেন তাদের দলীয় নেতারা। তাই তাদের সঙ্গে এখন আমাদের কোনো দলীয় জোট নেই।’ (কালের কণ্ঠ, ৩১ আগস্ট ২০২৪)।
সিপিবিসহ বাম ঘরানার দলগুলোও আগস্ট আন্দোলনকে শুরু থেকেই সমর্থন দিয়েছে। এ আন্দোলনে সিপিবি এবং তার ছাত্র সংগঠনের বেশ ক’জন নেতাকর্মী শহীদও হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই আগামী দিনের রাজনীতিতে তারাও ভূমিকা রাখার প্রত্যাশা রাখে। এমনকি হেফাজতে ইসলামের মতো কট্টরপন্থি ইসলামী দল, যারা কিনা একসময় শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ খেতাবে ভূষিত করেছিল, তাদেরও এই আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। তারাও আগামী দিনের রাজনীতিতে অংশীদার হতে চায়। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় তারা কমিটি গঠনের কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
উল্লিখিত দলসহ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সমর্থন দেওয়া এবং অংশ নেওয়া অন্যান্য দল যখন তাদের নিজ নিজ আদর্শিক অবস্থান থেকে পরিস্থিতিকে নিজেদের অনুকূলে নেওয়ার চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ রাষ্ট্রের সংবিধান পুনর্লিখন তথা পরিবর্তনের কথা বলা শুরু করেছেন। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী রীয়াজ সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধানের পুনর্লিখন করতে হবে।’ (সমকাল, ৩১ আগস্ট, ২০২৪)
শুধু আলী রিয়াজই নন, অনেকেই তাঁর মতো কথা বলছেন। বলা বাহুল্য, তারা যে এটি সম্পূর্ণভাবে অরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে করছেন– এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতার ভরকেন্দ্র যে ঠিক কোথায় বা কার নিয়ন্ত্রণে, তা নিয়ে জনমনে বিরাজ করছে হাজারো প্রশ্ন; সেই সঙ্গে এর লক্ষ্য নিয়েও। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যেসব রাজনৈতিক দল বা শক্তি শেখ হাসিনা সরকারকে সরানোর আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, তাদের একটির আদর্শের সঙ্গে আরেকটির আদর্শের কোনো মিল নেই। কখনও কখনও বিপরীতধর্মীও বটে। এ অবস্থায় কোনোরূপ একমুখী পথ খুঁজে পাওয়া আসলেই কঠিন।
মনে রাখতে হবে, ক্রস রোডে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। থাকলে পেছন থেকে অজানা বাহনের ধাক্কা লাগার আশঙ্কা থাকে। তা যেন না ঘটে, অন্তর্বর্তী সরকারকে সেটাই নিশ্চিত করতে হবে। এবং তা যত দ্রুত হবে ততই মঙ্গল।