মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: সোমবার ১৬, সেপ্টেম্বর ২০২৪

‘এনাফ ইজ এনাফ’, এখন জ্বলে ওঠো আপন শক্তিতে

Share on:

নিউইয়র্কে বসে ১০ সেপ্টেম্বর কমলা-ট্রাম্প বিতর্ক আর ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য শুনলাম। তিনি নিজেই অনেক ভালো বলেন; তারপরও যারা এ বক্তৃতা প্রস্তুতিতে সহায়তা করেছেন তাদেরও প্রশংসা করতে হয়।


ইদানীং জনপরিসরে আলোচিত প্রায় সবকিছুরই উত্তর দেওয়ার প্রচেষ্টা ছিল বক্তৃতায়। সংস্কার চালিয়ে নেওয়ার জন্য নির্বাচিত কাণ্ডারিদের পছন্দ হয়েছে। চারজন বেশ পরিচিত; দু’জন অপরিচিত হলেও নিশ্চয়ই নিজেদের কাজে যোগ্য ব্যক্তি।

আমার মতে, সবচেয়ে কঠিন কাজটি দুর্নীতি দমন। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেভাবে দুর্নীতি ঢুকে গেছে, দমনের কাজটি অভিনব বিধিমালা ও কঠোর প্রয়োগ ছাড়া প্রায় অসম্ভব হওয়ারই কথা। সমাজ মেরামত না করে, মূল্যবোধের উন্নয়ন না করে, পারিবারিক ও আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকে দায়িত্বশীল না করে কাজটি কীভাবে হবে বুঝতে পারছি না। সমাজে সর্বত্র যে ‘টাকার’ দোর্দণ্ড প্রতাপ, সেটিকে কীভাবে মূল্যবোধ বা সত্যের লালনের মাধ্যমে মোকাবিলা সম্ভব, মাথায় আসছে না।

কত টাকা হলে ‘এনাফ ইজ এনাফ’ আমরা কেউ জানি না। পরিবারে, সমাজে, সরকারে কেউ জিজ্ঞেস করছে না–এত টাকা এলো কোত্থেকে? জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে সঞ্চিত টাকার মিল নেই কেন? অনেকের কাছে যেন গোপন টাকার গাছ আছে। যে কোনো উপায়ে টাকা বানাও, কিছু অংশীজনের মাঝে ভাগ করো, বাকিটা ম্যানেজ হয়ে যাবে। টাকা হলে মসজিদে দান করে, বিশেষ বিশেষ ত্রাণ তহবিলে দান করে, গরিবদের কিছু দান-খয়রাত করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা

রাজনীতিবিদদের কাউকে কাউকে বখরা দিয়ে পার পাওয়া যায়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সবাই যেন ক্ষমতা ব্যবহার করে এটা-ওটা পাওয়ার লাইসেন্সপ্রাপ্ত। বিগত সরকারের একজন উপদেষ্টা খোদ সরকারপ্রধানের দিকে অঙ্গুলি তুলে আমাকে বলেছিলেন, ‘শি হ্যাজ ফ্যান্টাস্টিক টলারেন্স ফর করাপশন।’ সমাজ ও রাষ্ট্র সব জায়গায় যেন দুর্নীতির ব্যাপারে একটি টলারেন্স বা ইমিউনিটি সৃষ্টি হয়ে গেছে। দোকানিরা ঠকাচ্ছেন গ্রাহককে। ব্যাংক বাধ্যতামূলক সেবা না দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। সংসদ সদস্যরা ভোটারদের থোরাই কেয়ার করেন। আমরা সবাই একটি খাঁচায় আটকে গেছি। জানি না, এ খাঁচা ভাঙব আমরা কেমন করে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি নিয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের একটি প্রকল্পের স্কোপিং বা কাজের পরিধি চিহ্নিতকরণের প্রাথমিক কাজে জড়িত ছিলাম। পরে সম্ভবত এটি আর এগোয়নি। সমমানের অন্যান্য দেশের সাফল্যের অভিজ্ঞতায় একটি ভালো কাজ অবশ্যই হতে পারে। প্রয়োজন দুর্নীতি দমন কমিশনে উচ্চপদে নিয়োগ বিধান ও কাঠামোগত সংস্কারেরও প্রায় কাছাকাছি সুকঠিন পুলিশ সংস্কার। পুলিশের কাজ যদিও জনগণকে রক্ষা ও জানমালের হেফাজত, তাদের যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করা হয়েছে বিরোধী দল ও মত ঠেঙানোর জন্য। ইউএনডিপির সৌজন্যে থানা, ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট, জেল ইন্টিগ্রেশন প্রকল্পের স্কোপিং করতে গিয়ে দেখেছিলাম–যে কিশোরটিকে টাঙ্গাইলের করটিয়া বাজারে মিছিলের সময় দৌড়ে পলায়নকালে পুলিশ গাড়িতে তুলে নিয়ে টাকা না পেয়ে বা এমনিতেই চালান করে দিয়েছিল, সে ১০-১৫ বছর সিলেট জেলে বিনা বিচারে আটকে। টাকার অভাবে আইনজীবী নিয়োগ দিতে না পেরে কত কিশোর-যুবক যে জেলে আটকে আছে বছরের পর বছর! দেশে অনেক মডেল থানা গড়ে উঠেছে, কিন্তু থানায় মামলা করার প্রক্রিয়া এখনও ‘মুনশি’নির্ভর। সেই মুনশির বেতন আবার আসে পুলিশ কর্মকর্তাদের পকেট থেকে, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নয়। অধ্যাপক ইউনূস যেমন দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাতে চেয়েছিলেন, তেমনি হয়তো একদিন আমরা একজন সৎ পুলিশ কর্মকর্তার প্রমাণ দেখতে জাদুঘরে যাব।

অনেকে বলেন, সমাজে দারিদ্র্য-বৈষম্য দূর করতে না পারলে, জবাবদিহি না আনতে পারলে নাকি পুলিশের ঘুষ-দুর্নীতি দূর হবে না। অনেকে আবার বলেন, বেতন বৃদ্ধিতে নাকি সমাধান মিলবে। অনেকে আবার সম্ভাবনা দেখেন পোশাক পাল্টানোতে। অনেকে বলেন, বিজিবির মতো পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা আসুক সামরিক বাহিনী থেকে। অনেকে আবার বলছেন সব তরুণকে বাধ্যতামূলক প্যারা-মিলিটারি ট্রেনিং দিতে। অন্য কিছু দেশের মতো পুলিশ রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়াই ঢেলে সাজানোর কথা অনেকে ভাবছেন। কভিডপূর্ব ও পরবর্তীকালে কেউ কেউ অপরাধ তদন্ত ও ব্যবস্থাপনায় সাংহাইয়ের মতো ডেটা অ্যানালিটিক্স বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহারের কথাও ভাবছিলেন।

আগেও পুলিশের আধুনিকায়ন নিয়ে কিছুটা কাজ হয়েছিল। পুলিশের ডেটা সেন্টার আপগ্রেড করতে গিয়ে পুলিশের বেশ কিছু মেধাবী প্রকৌশলী-আইন বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তারও দেখা মিলেছিল। অনেকে দক্ষিণ কোরিয়া এমনকি গণচীনের স্মার্ট পুলিশিংয়ের কথাও বলছিলেন; বলছিলেন এ কাজে অধিকতর প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা।

ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার আদলে নির্বাচন সংস্কার আমাদের এখানেও হতে পারে। অবশ্যই যদি

কর্তাব্যক্তিদের হস্তক্ষেপ একটু দমিয়ে রাখা যায়। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং ভেঙে ভেঙে নির্বাচন করার বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে। ভোটার তালিকা প্রণয়ন, সহিংসতা ও ব্যালট বাক্স ছিনতাই এড়ানো বিরাট লক্ষ্য হওয়া উচিত। ২০০৭-০৮ সালে ভোটার তালিকা আধুনিকায়ন, ব্যালট বাক্সকে স্বচ্ছ করার ব্যাপারে অনেককেই ইন্দোনেশিয়ার উদাহরণ টানতে দেখেছি। যা-ই হোক না কেন স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের পোলিং অফিসার না বানানো হবে বুদ্ধিমানের কাজ। অন্য কিছু দেশের মতো তরুণদের নিয়ে নির্বাচনকালীন রিজার্ভ ফোর্স গড়ে তোলার কথাও চিন্তা করা যায়।

প্রশাসনিক সংস্কারেও ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও ফিলিপাইনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অপ্টিমাইজেশন নিয়ে সেন্ট্রাল ইউরোপে কিছু কাজ হয়েছে বলে ইউএনডিপি

কর্মকর্তাদের কাছে শুনেছিলাম। সেই সঙ্গে মেধাবীদের সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি ভাবা উচিত। ড. ফখরুদ্দীন আহমদ ২০০৮ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে আমার সঙ্গে আলোচনায় যে দুটি কাজে আরও ভালো করা উচিত ছিল মনে করেছিলেন, তার একটি প্রধান উপদেষ্টার কাছে আসা ফাইলের সংখ্যা কমানো। আরেকটি হলো, সত্যিকার মেধাবীদের সরকারে যোগদানে আকৃষ্ট করা। শুধু শুধু বিদেশে ট্রেনিং আর বেতন বাড়িয়ে যে কাজ হবে না, তা আমরা জেনে গেছি।

মার্কিন দূতাবাসের এক কর্মকর্তা একবার বলেছিলেন, আমাদের দেশ থেকে নাকি বেশির ভাগ ‘রিটায়ারমেন্টে যাচ্ছি যাচ্ছি’ কর্মকর্তাদের বিদেশে পাঠানো হয় বা প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত করা হয়। প্রয়োজনীয়তা যাচাই করে বা ফিরে এসে অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর জন্য নয়। খোদাকে ধন্যবাদ অনেক কষ্ট করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিনা পরিশ্রমে পিএইচডি ডিগ্রি ‘দখলের’ বাতিক থেকে রক্ষা করা গেছে। যদিও পুরোটা নয়। সচিব আইউব কাদরী একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের পিএইচডি ডিগ্রি লাভের হিড়িক দেখে বলেছিলেন, ‘দে আর সেলিং সার্টিফিকেটস।’ বিসিএসের সিলেবাস, পরীক্ষা নেওয়ার পদ্ধতি এবং সিলেকশন নিয়েও ভাবতে হবে। এখানেও প্রযুক্তির যথোপযুক্ত ব্যবহার দুর্নীতিবিরোধী বাঁধ তৈরিতে সাহায্য করতে পারে।

সংবিধানের বারবার কাটা-ছেঁড়াও বেখাপ্পা লেগেছে।

সংবিধান প্রণয়নের শুরুর দিকে হয়তো তাড়াহুড়োও ছিল। ইদানীংকালে সমমানের যেসব দেশ সংবিধানের আধুনিকায়ন করেছে বা ঢেলে সাজিয়েছে, তাদের উদ্যোগগুলো বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনি বিধান ও অনুসৃত অনুশীলনগুলোরও রিভিউ প্রয়োজন। যাতে একজন এবিএম খায়রুল হক বা শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকরা দৈত্য বনে যেতে না পারেন।

আমাদের এই চিরচেনা দেশে আমরাই সব পারি বা পারব ভাবা অমূলক নয়। তবে বিশ্বায়নের এই যুগে ‘পথের সাথীকেও চিনে নিতে হবে’ বৈকি।

ইন্দোনেশিয়া, আরব আমিরাত, এমনকি ভারতে কিছু আইনি সংস্কারের সাফল্যের অভিজ্ঞতায় দেখেছি–যা করণীয় তা ত্বরিত চিহ্নিত করে ভালো একটি টিমের মাধমে দ্রুত বাস্তবায়নের পথে এগোতে হবে। হার্ভার্ড প্রফেসররা আমাদের বারবার বলেছেন, ‘এক্সিকিউশন ইজ দ্য কি।’ অর্থাৎ বৃক্ষ তোমার নাম কী–ফলে পরিচয়।

দৈনিক সমকাল