এখন আমাদের ‘মানুষ’ হওয়ার চ্যালেঞ্জ!
Share on:
পৃথিবীতো এখন রাজনীতির পৃথিবী। পৃথিবীতে রাজনীতি হয়, হয় অপরাজনীতিও। এ কারণেই নানা সংঘাত ও সংকটে বিভক্ত হয়ে পড়েছে আমাদের প্রিয় এই পৃথিবী। এমন বাস্তবতায় মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) শুরু হলো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম বার্ষিক অধিবেশনের সাধারণ বিতর্ক।
সাধারণ বিতর্কে বক্তব্য পেশ করে থাকেন সদস্য দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানেরা। এ উপলক্ষে নিউইয়র্কে জড়ো হয়েছেন বিশ্বনেতারা।
এ বছর সাধারণ বিতর্কের প্রতিপাদ্য বিষয়, ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয় : বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শান্তি, টেকসই উন্নয়ন ও মানবিক মর্যাদার অগ্রগতি সাধনে এক সঙ্গে কাজ করা।’ এই প্রতিপাদ্য বিষয়ে অংশ নিতে বিশ্বের প্রায় ১৩০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানেরা এখন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। এবারের বিতর্কের প্রতিপাদ্য বিষয়টি খুবই প্রাসঙ্গিক, গুরুত্বপূর্ণ এবং আকর্ষণীয়ও বটে। বিশ্ববাসীর দৃষ্টি এখন নিউইয়র্কের দিকে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম বার্ষিক অধিবেশনে এবার যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অধিবেশনের ফাঁকে মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে। উল্লেখ্য যে, সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের তেমন নজির নেই। জো বাইডেন এদিন ড. ইউনূসকে কাছে পেয়ে বুকে টেনে নেন।
হাতে হাত রেখে বলেন, বাংলাদেশে সংস্কারের যে লক্ষ্য নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ঠিক করেছেন, তা বাস্তবে রূপ দিতে সব ধরনের সহযোগিতা করবে হোয়াইট হাউস। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি থাকবে পূর্ণ সমর্থন। নিউইয়র্কের কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, জাতিসংঘ সদর দপ্তরে শীর্ষ নেতাদের জন্য নির্ধারিত সভাকক্ষে ড. ইউনূসের সঙ্গে জো বাইডেনের নির্ধারিত সময় ছিল ১৫ মিনিট। কিন্তু অত্যন্ত উষ্ণ এবং হৃদ্যতাপূর্ণ বৈঠকটি শেষ পর্যন্ত প্রায় ৩০ মিনিট স্থায়ী হয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, বৈঠকে ড. ইউনূস বিগত সরকারের আমলে সব ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সাহসী ভূমিকা ও বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা জো বাইডেনকে জানান।
ড. ইউনূস জোর দিয়ে বলেন, দেশ পুনর্গঠনে তার সরকারকে অবশ্যই সফল হতে হবে। এ সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন যে কোনো সাহায্যে বাংলাদেশ সরকারের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। বাইডেন আরও বলেন, শিক্ষার্থীরা যদি দেশের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, তাহলে তাদেরও (যুক্তরাষ্ট্র সরকার) পূর্ণ সমর্থন করা উচিত। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা জুলাই বিপ্লবকালীন এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের আঁকা দেয়াল চিত্রে ছবি সম্বলিত ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ শীষক আর্টবুক জো বাইডেনকে উপহার দেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক একাধিক কূটনীতিক বলেন, চিরাচরিত প্রথা ভেঙে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বৈঠক প্রতীকী অর্থে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংক্ষিপ্ত হলেও দুই শীর্ষ নেতার বৈঠক এই বার্তাই দিচ্ছে যে, হোয়াইট হাউস বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর কঙ্কাল এক বাংলাদেশর ছবি প্রত্যক্ষ করলো দেশের জনগণ। অবাধ লুন্ঠন, দুর্নীতি ও অর্থপাচারের কারণে দেশ বড় এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। অফিস-আদালত, প্রশাসন, সবকিছু নতুন করে গড়তে হচ্ছে। আইন-শৃংখলা প্রতিষ্ঠার কাজটিও এখন বড় হয়ে উঠেছে। এছাড়া স্বৈরাচারের প্রেতাত্মারা শিল্প-কারখানাসহ বিভিন্ন জায়গায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের যন্ত্রণা-বঞ্চনার ফিরিস্তি নিয়ে এখন সবাই হাজির ইউনূস সরকারের সামনে। কারো যেন তর সইছে না। সমস্যার সমাধানে যে যৌক্তিক সময়ের প্রয়োজন, সেটাও অনেকে বুঝতে চাইছেন না।
এদিকে সংখ্যালঘু এবং পাহাড়িদেরও উসকে দিতে চাইছেন বিশেষ মহল। দীর্ঘদিনের বিরাজমান কিছু সমস্যাকে পুঁজি করে যারা দেশের পরিস্থিতির অবনিত ঘটাতে চাইছেন, তারা যে দেশের বন্ধু নন, তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। এমন অপকর্মে পরাজিত ফ্যাসিস্টদের কিছু দুরাত্মাকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে বাইরের অপশক্তিও। এমন বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য বন্ধু রাষ্ট্রের সহযোগিতা বাংলাদেশের কাম্য। বাইডেন প্রশাসন তো বেশ স্পষ্টভাবে বাড়িয়ে দিল বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার হাত। ড. ইউনূসের জন্য এটা একটা বড় সাফল্য।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশন চলছে। প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে বিশ্বনেতারা কথা বলছেন। কথা বলবেন বাংলাদেশ সরকারের নেতা ড. ইউনূসও। আমরা ড. ইউনূসের বিশ্বদৃষ্টি সম্পর্কে জানার অপেক্ষায় আছি। আমরা বাংলাদেশের সমস্যার যেমন সমাধান চাই, তেমনি চাই বিশ্ব -সংকটের সমাধানও। কারণ আমরা শুধু বাংলাদেশের নাগরিক নই, বিশ্ব নাগরিকও বটে।
এমন এক সময় জাতিসংঘের ৭৯তম বার্ষিক অধিবেশন চলছে, যখন বিভিন্ন ধরনের সংঘাত ও সংকটের মধ্যে রয়েছে বহুভাগে বিভক্ত আমাদের এই বিশ্ব। সাধারণ পরিষদের এবারের অধিবেশনে ইউক্রেন, ফিলিস্তিনের গাজা, ইসরাইল-হিজবুল্লাহ ও সুদানের সংঘাতের মতো বিষয় বিশেষ গুরুত্ব পেতে পারে। এছাড়া বার্ষিক অধিবেশনের আগে-পরে আরো কয়েকটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এসব সম্মেলনের মধ্যে রয়েছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো প্রভাব মোকাবিলার বিষয়।
সাধারণ পরিষদের বিতর্কের আগে আয়োজিত জলবায়ু সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে কয়েকজন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান জলবায়ুজনিত দুর্যোগ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান আস্থাহীনতার বিষয়ে সতর্ক করে দেন। এই সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জগুলো আমাদের সমাধানের সামর্থ্যরে চেয়ে দ্রুতগতিতে ধেয়ে আসছে। সংকটগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে গুলিয়ে যাচ্ছে এবং প্রত্যেকটিকে বাড়িয়ে তুলছে।’
আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধান প্রসঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিব যা বললেন তা ভেবে দেখার মতো। সমাধানের সামর্থ্যরে চেয়ে দ্রুতগতিতে ধেয়ে আসছে চ্যালেঞ্জ। অর্থাৎ সামর্থ্যরে চেয়ে চ্যালেঞ্জের দ্রুতি ও মাত্রা বেশি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আবার আস্থার সংকট। এমন জটিল অবস্থার সমাধানে কূটনীতির পোশাকি ভাষা কিংবা চাতুর্য কতটা কার্যকর হবে? সমস্যার সমাধানে আমাদের আবার মানুষ হতে হবে এবং উপলব্ধি করতে হবে মানব ও পৃথিবীর সীমাবদ্ধতা। সবাইকে নিয়ে বাঁচতে হলে এবং দূষণমুক্ত পৃথিবী চাইলে বিশ্ব নেতাদের আগে দূষণমুক্ত হতে হবে। এটাই এখন সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ উত্তরণে এখন প্রয়োজন স্রষ্টার বাণীর পুনঃপাঠ।