একজন স্বৈরাচারের উত্থান ও পথপরিক্রমা
Share on:
‘হাউ টু বিকাম আ টাইর্যান্ট’ ডকু-সিরিজটি নেটফ্লিক্সে প্রকাশিত হয় ২০২১ সালে। ছয় এপিসোডের সিরিজটিতে আক্ষরিক অর্থেই দেখানো হয়েছে একজন স্বৈরাচারের উত্থান ও পথপরিক্রমা।
তারা জনতার সামনে ‘বিশেষ শত্রু’-এর ভয় দেখিয়ে ক্ষমতায় আসে, যেখানে নিজেকে উপস্থাপন করা হয় ‘রক্ষাকর্তা’ হিসেবে। মসনদ পাওয়ার পর প্রথমেই বিনাশ করে সম্ভাব্য শত্রুকে। সাধারণের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ‘ভয়’ দিয়ে। ক্ষমতা দীর্ঘ করা হয় নিজেকে মহিমান্বিত করে।
দুঃখজনকভাবে, প্রায় দেড় যুগে বাংলাদেশ সাক্ষী হয়েছে এমন প্রতিটি ব্যাপারেরই। এখানে তৈরি করা হয়েছে স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির ধারণা। পুরোটা সময় ছিল ‘শেখ হাসিনা বিকল্পহীন রক্ষক’ এ প্রস্তাবের দাপট। সেক্ষেত্রে কিন্তু ‘শত্রুপক্ষ’-এর সংজ্ঞা কেবল জামায়াত কিংবা বিএনপিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এমন সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকেও যুক্ত করা হয়েছে তালিকায়, যারা প্রশ্ন করেছে শাসনযন্ত্রকে। নিজের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য শোষণযন্ত্রের শীর্ষে থাকা মানুষটির ‘আমিত্ব’-কে মহিমান্বিত করা হয়েছে সর্বস্তরে।
অত্যাচারী শাসক আর দস্যুর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো দস্যু নগ্নভাবে সরাসরি আঘাত করে; আর অত্যাচারী শাসক সামনে আসে ‘পবিত্র’ ও ‘অপবিত্র’ সমীকরণ ব্যবহার করে। বিগত দেড় যুগের দুঃশাসনে পবিত্র তালিকায় বসানো হয়েছিল তথাকথিত চেতনা, পক্ষশক্তি, মুক্তিযুদ্ধকে। বিপরীতে অপবিত্র ছিল যেকোনো বিরোধী মতবাদ। বিপ্লবের পয়লা শর্ত হলো শোষণযন্ত্রের আরোপিত সংজ্ঞাকে অতিক্রম করা। প্রতিরোধ করা সেই সব প্রতীককে, যা শোষকের দুঃশাসনের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হয়েছে। কয়েক বছর থেকেই দেশের চিত্রপট বদলাচ্ছিল।
নতুন প্রজন্মের সামনে কাজ করেনি বিএনপি কিংবা জামায়াত ট্যাগ। খুব বেশি জমেনি চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধ তকমাও। অর্থাৎ দেড় যুগ ধরে যা কিছুকে ‘পবিত্র’ ও ‘অপবিত্র’ ফতোয়া দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে তা এতটাই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে মানুষ তাতে ভ্রুক্ষেপ করেনি। অথবা আওয়ামী রাজনীতিতে প্রতিপক্ষের তালিকা বড় বানাতে বানাতে নিজেরাই দেউলিয়া হয়ে গেছে। এজন্যই হয়তো তারা বুঝতে পারেনি তিলে তিলে সঞ্চিত জনপ্রতিরোধকে। ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ স্লোগানটাকে তারা হয়তো আন্দোলনের শুরু মনে করেছে, কিন্তু এটা মূলত ছিল প্রতিরোধ যাত্রার সর্বশেষ পরিণতি।
আগস্টের অভ্যুত্থানে একদিকে যেমন মাদ্রাসার ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল, অন্যদিকে ছিল বামপন্থী দলগুলোর সদিচ্ছা। ছাত্ররা যেমন ছিল, তেমনি এগিয়ে এসেছে শ্রমিক ও মজুর। সবাই চেয়েছে শোষণযন্ত্রের লাগাম টেনে ধরতে। এজন্য শোষণযন্ত্রের অভিধানে সৃষ্ট সব ধরনের ইতিবাচক শব্দকে নিয়েই মশকরা হয়েছে। বিপরীতে গ্রহণ করেছে সরকারের দেয়া নেতিবাচক তকমাগুলো। বিজয়ের পর যে ভাস্কর্য ও ম্যুরাল ভাঙা হয়েছে, সেটা এ গতিশীল প্রক্রিয়ারই দৃশ্যমান রূপ মাত্র। যে যে সিম্বল ব্যবহার করে গত দেড় যুগে এত হত্যা, অবিচার, নির্যাতন ও গুম চালানো হলো তার সবকিছুতেই উগরে পড়েছে জনতার ক্ষোভ। যা কিছুর মধ্য দিয়ে মানুষকে দাবিয়ে রাখা হয়েছে, তার প্রতি ঝরে পড়েছে বিতৃষ্ণা। সব ভাস্কর্যের ওপর কিন্তু তাদের বিতৃষ্ণা দেখা যায়নি। জনগণ সেগুলোর ওপরই ক্রোধ ঝেড়েছে, যেগুলোকে ফ্যাসিবাদী শাসনের সঙ্গে সমার্থক বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। ভাস্কর্য ভেঙে পড়াটা দুঃখজনক, কিন্তু এ নেতিবাচকতা বিজয়ের উচ্ছ্বাস থেকে আসেনি; এসেছে গত দেড় দশকের দমন-পীড়নে। ঠিক একইভাবে মানুষের ক্ষোভ গিয়ে পড়েছে পুলিশের ওপর। কারণ এ দীর্ঘ সময়ে পুলিশ প্রায়োগিক অর্থে পরিণত হয়েছিল শোষণযন্ত্রের উপকরণ মাত্রে।
শেখ হাসিনার সরকার যে কেবল সাঈদ ও মুগ্ধকে হত্যা করেই খুনি, এমন তো না। ক্ষমতা ছাড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বলপ্রয়োগের নীতিতে অবিচল ছিলেন। এর প্রমাণ পদত্যাগের দিন সকালে শহীদ মিনারে চালানো গুলি। পিলখানা হত্যাকাণ্ড থেকে যাত্রাবাড়ী হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত দীর্ঘ দেড় দশক সময়ে দমন-পীড়নের জন্য নাম কুড়িয়েছেন তিনি। তার মসনদের মোহে গোটা বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল অদৃশ্য ‘আয়নাঘর’।
মানুষ ভয়কে অতিক্রম করতে গিয়ে কেবল ভয়কেই অতিক্রম করেনি, অতিক্রম করেছে সব ধরনের সনাতনী আদর্শিক ব্যবধানও। সব মত, পথ ও সংস্কৃতির তরুণদের এই ঐক্যবদ্ধ উল্লম্ফনকে কেবল ইউরোপের এনলাইটেনমেন্টের সঙ্গেই তুলনা করা সম্ভব। কারণ এখন আর বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক টোটেম ও ট্যাবু অবশিষ্ট নেই। কেবল আছে নাগরিক ও মানবিক পরিচিতি।
শেখ হাসিনা যে মুহূর্তে হেলিকপ্টারে উঠলেন, তা গোটা বাংলাদেশের জন্য ‘জিরো আওয়ার’। একে বরং ‘হাসিনা যাত্রা’ বলা যেতে পারে। কারণ তিনি প্রথমে নিজে হাতে বিরোধী দলগুলোকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে গেছেন, যাওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ করে গেছেন নিজের দল আওয়ামী লীগকে। সর্বশেষ সজীব ওয়াজেদ জয়ের বক্তব্য (শেখ হাসিনার পর আপনাদের কী হবে, তা আমার চিন্তার বিষয় না, আমাদের পরিবারেরও চিন্তার বিষয় না। আপনারা বুঝবেন) সে ধারণাকেই শক্তিশালী করে। ফলে বাংলাদেশে এখন সে অর্থে সুগঠিত কোনো রাজনৈতিক দল অবশিষ্ট নেই।
আদর্শিকভাবে এমন শূন্যে নেমে আসার ঘটনা ইতিহাস ঘাঁটলে খুব কম দেখা যায়। এছাড়া ‘হাসিনা যাত্রা’-এর মধ্য দিয়ে দেশে দীর্ঘদিন ধরে যে হাসিনা বনাম খালেদা অধ্যায় চলেছে, সেটাও সম্ভবত শেষ হতে চলেছে। প্রথমবারের মতো তৈরি হয়েছে দুই পরিবারের বাইরে ক্ষমতা যাওয়ার সম্ভাবনা। সেদিক থেকে দেখলে বাংলাদেশে সবকিছুই নতুন করে শুরু হবে। যদি প্রতিটি পদক্ষেপ ঠিকঠাক নেয়া হয়, তাহলে এটা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত। দেশকে পুনর্গঠনের দ্বিতীয় সুযোগ। বহু দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণ করার উপায়। সুযোগ এমন এক সমাজ প্রতিষ্ঠার, যেখানে সব ধরনের মত ও সংস্কৃতি মর্যাদার সঙ্গে সহাবস্থান করবে।
মসনদ কখনো খালি থাকে না। কেউ না কেউ তো বসবেই। সেক্ষেত্রে এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হলো নয়া কোনো টোটেম ও ট্যাবু গড়ে উঠতে না দেয়া। জনগণ ভিন্ন রাষ্ট্রের কোনো টোটেম থাকার দরকার নেই। কোনো মূর্তি কিংবা ভাবমূর্তিকে পুঁজি করে ফের স্বৈরাচারী শক্তির উত্থান ঘটবে, তার ন্যূনতম আশঙ্কাও বন্ধ রাখা জরুরি। রাষ্ট্রের বণ্টিত সুবিধার মধ্যে সব নাগরিকের অধিকার সমান। ফলে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয় যেন ব্যক্তির যোগ্যতার চেয়ে বড় হয়ে না ওঠে। গত দেড় যুগে শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি প্রধান অভিযোগই ছিল দলীয় রাজনৈতিক আনুগত্যই তার আমলের নিয়োগ ও পদোন্নতির প্রধান শর্ত।
এই দলীয় আনুগত্যের কারণেই বঞ্চিত হয়েছে মেধা। সরকারের চাটুকারে পরিণত হয়েছিল প্রশাসন। দলীয় অস্ত্রধারী নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মিলেমিশে বিরোধীদের ওপর চড়াও হয়েছে পুলিশ। নতুন সরকার যদি সে নীতিকেই এগিয়ে নেয়, কিন্তু প্রতিশোধ নেয়াকেই অগ্রাধিকার দেয়, তাহলে তা দিনশেষে ভালো কিছু বয়ে আনবে না। সত্যি বলতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সহজেই সামাল দেয়া যেত। অরাজনৈতিক ও অহিংস একটি আন্দোলনকে সহিংস পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়ার পেছনে কাজ করেছে বিগত সরকারপ্রধানের একগুঁয়ে আচরণ। জনতার ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে তার সরকার বলপ্রয়োগের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের সমালোচনার কণ্ঠরোধ করতে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রোধ করতেই সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জারি করে। ফোনে আড়ি পাতা কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি—কোনোটিই গণতান্ত্রিক আচরণ নয়। আর অগণতান্ত্রিক চর্চার ভবিষ্যৎ কখনই ভালো হয় না। এর আগে আইয়ুব খান ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, গদিছাড়া হয়েছেন এরশাদও। দুজনেরই ভাগ্য ভালো হওয়ার কারণে পালাতে হয়নি। কিন্তু হাসিনাকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে ইতিহাসের সমালোচিত স্বৈরশাসকদের মতো অজ্ঞাত স্থান থেকে হেলিকপ্টারে চড়ে।
জনতার বিজয় অর্জিত হয়েছে। সরে গেছে শোষণযন্ত্র। এ রক্তাক্ত পথ পাড়ি দেয়ার পর জনতার ঘাড়ে নতুন করে কোনো শোষণযন্ত্র সওয়ার না হোক। বরং আগামী দিনগুলোয় অগ্রাধিকার পাক বৈষম্য থেকে মুক্তি। স্বাধীনতা, সাম্য ও মানবিক মর্যাদাকে সমুন্নত রেখে একটা কার্যকর ব্যবস্থা কায়েম হোক; যেখানে কোনোভাবেই যেন নতুন টোটেম ও ট্যাবুর আশ্রয়ে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি জারি না হয়।