ইসলামী শিক্ষার অভাবেই অপরাধ ও অপকর্মের অভয়ারণ্যে পরিণত হয় রাষ্ট্র
Share on:
একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হওয়া সত্ত্বেও বিগত সরকারের দলকানা পদধারী রাজনীতিক, অসাধু ব্যবসায়ী ও পদলেহনকারী সরকারি কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ মদদে চৌর্যবৃত্তি-ঘুষ-দুর্নীতি-লুণ্ঠন-বেহায়াপনাসহ নানা অপরাধ ও অপকর্মের অভয়ারণ্যে পরিণত হয় বাংলাদেশ।
আমাদের কলুষিত এ সমাজে নানা ধরনের অসামাজিক ও অপরাধমূলক কাজ সংগঠিত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ধর্মীয় শিক্ষা তথা ইসলামী শিক্ষার অভাব। প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় শিক্ষা থেকেই আমরা নীতি-নৈতিকতা শিখি। বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি অভাব নীতি-নৈতিকতার । কোনো ধর্মই হিংসা-অহংবোধ, হানাহানি, মারামারি, দুর্নীতি, চৌর্যবৃত্তির শিক্ষা দেয় না। ধর্ম আমাদের শেখায় মহান সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসতে আর তাঁর সব সৃষ্টির প্রতি ইহসান করতে। ধর্মের অমোঘ বাণী যে হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করে, ভালোবাসে তারপক্ষে কখনো দুর্নীতি, অনাচার, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তথা কোনো প্রকার অপরাধমূলক কাজে যুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। তাই আমাদের সব নাগরিকের ধর্ম সম্পর্কে জানা ও ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ অত্যাবশ্যক।
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিশু-কিশোর-যুবকদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত রাখতে তাদেরকে নৈতিক শিক্ষা দেয়া অপরিহার্য। বর্তমান সময়ে সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়ার আগ্রহ বেশির ভাগ অভিভাবকেরই কমে গেছে। যার ফলাফল ভয়াবহ রূপে দৃশ্যমান। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে ঘুষ-দুর্নীতি, হত্যাকাণ্ড, সন্ত্রাসবাদ, মাদকাসক্তি, অরাজকতা, অসামাজিক ও অপরাধমূলক কার্যকলাপ। ধর্মীয় শিক্ষা তথা নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা না থাকায় আমাদের সন্তানরা দিনকে দিন বিভিন্ন অনৈতিক-অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়ে পড়ছে, মা-বাবার ন্যায্য কথাও তারা অগ্রাহ্য করছে। এমনকি মা-বাবার আদেশ-নিষেধেরও তোয়াক্কা করছে না। এ ধরনের ঘটনা আমরা প্রতিনিয়ত দেখে আসছি; যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। তাই এখন থেকে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বিভিন্ন বিষয়ের পাঠদানের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত সাতটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণীত হয় ২০১০ সালে। আর এ শিক্ষানীতির ওপর ভিত্তি করেই রচিত হয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২। জাতীয় শিক্ষানীতিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে উন্নত চরিত্র গঠনে সহায়তা করা। অথচ দেখা যায়, ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতির এ কথাটি জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২-তে যেন ছিটকে পড়ে গেল; ধর্মীয় শিক্ষাকে মূল্যহীন অপাঙ্ক্তেয় হিসেবে গণ্য করা হলো।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২-তে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে বিজ্ঞান এবং ব্যবসায় শিক্ষা শাখা থেকে ইসলামী শিক্ষা পুরোপুরি বাতিল করা হয়। আর মানবিক শাখায় ইসলামী শিক্ষা রাখা হয় ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে। আবার জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১-তে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়টি দশম শ্রেণীর বোর্ড পরীক্ষা থেকে বাতিল করা হয়। অর্থাৎ দশম শ্রেণীর বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়গুলোর ক্লাস-পরীক্ষা ও বোর্ড পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। অব্যাহত থাকবে সামষ্টিক মূল্যায়নও। আর এর ওপর ভিত্তি করেই একজন শিক্ষার্থীর গ্রেড নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়টি শুধু বই নামেই থাকবে। হবে না ক্লাস-পরীক্ষা, বোর্ড পরীক্ষা, সামষ্টিক মূল্যায়ন। ফলে একসময় বিষয়টি শিক্ষার্থীদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে । একই সাথে পড়ানোর আগ্রহ হারাবেন শিক্ষকরাও। শিক্ষানীতিতে ধর্মীয় শিক্ষাকে এভাবে অবহেলা করা স্পষ্টত ধর্মীয় ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন বৈ আর কিছু নয়। এতে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অন্ধকারের পথ বেছে নেবে। সমাজের বর্তমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি পর্যায়ক্রমে আরো ভয়াবহ রূপ নেবে।
অস্বীকার করার উপায় নেই, এ দেশের ধর্মপ্রাণ দেশপ্রেমিক আপামর মানুষ চায়, প্রথম শ্রেণী থেকে স্নাতকোত্তর শ্রেণী পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা তথা ইসলাম শিক্ষা বিষয়টি সিলেবাসের আওতাভুক্ত করে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা আগের মতো বহাল রাখা হোক। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর ‘মানবিক, বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা, সঙ্গীত এবং গার্হস্থ্য বিজ্ঞান’ শাখায় ইসলাম শিক্ষা বিষয়টি আগের মতো বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং উভয় শ্রেণীতেই বিষয়টি বোর্ড পরীক্ষার অন্তর্র্ভুক্ত করতে হবে। বার্ষিক পিরিয়ড সংখ্যা বা শিখন-ঘণ্টার বিষয়ভিত্তিক বণ্টনে ধর্ম শিক্ষা, প্রায় সব শ্রেণীতে যে অবর্ণনীয় বৈষম্যের শিকার হয়েছে, তা দূর করতে হবে। ইসলাম শিক্ষা পাঠ্যবইয়ের নাম ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ এর পরিবর্তে ‘ইসলাম শিক্ষা’ রাখাই বাঞ্ছনীয়। অন্যান্য ধর্মশিক্ষার ক্ষেত্রেও নিজ নিজ ধর্মের নামে থাকাই উচিত।
তা ছাড়া বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ইসলাম শিক্ষাকে নানা গুচ্ছের বেড়াজালে ফেলে যেভাবে তুচ্ছ বিষয়ে পরিণত করেছে তা বাতিল করতে হবে। বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য একে নৈর্বাচনিক বিষয় হিসেবে (চতুর্থ বিষয় হিসেবে নয়) উন্মুক্ত রাখতে হবে।
অত্যন্ত পরিতাপ ও বিস্ময়ের বিষয়, ২০০৭ সালের পরে বাংলাদেশের কোনো সরকারি-বেসরকারি কলেজে ইসলাম শিক্ষা (ইসলামিক স্টাডিজ) বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করার কোনো আবেদন গ্রহণ করেনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যুক্তি ছিল, ইসলামিক স্টাডিজ অধ্যয়ন করলে শিক্ষার্থীরা জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত হয়। অতএব জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে হলে ইসলামিক স্টাডিজ তথা ইসলামিক ভাবধারার শিক্ষাকে দেশ থেকে নির্মূল করা ছাড়া এর কোনো বিকল্প নেই। যা কোনো দায়িত্বশীল ও বিবেকবান নীতিনির্ধারকের কথা হতে পারে না।
তা ছাড়া অনার্স ও মাস্টার্স পাঠদানকারী সরকারি-বেসরকারি কলেজগুলোতে বিগত ১৫ বছরে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ের একটি পদও সৃজন করা হয়নি বা কাউকে নতুন করে পদায়ন করাও হয়নি। উল্টো সুযোগ বুঝে বিভিন্ন কলেজ থেকে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগটি অঘোষিতভাবে বিলীন করা হয়েছে। আর প্রাচীন যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগটি চালু ছিল, সেখানেও অবিশ্বাস্য রকমভাবে আসন সংখ্যা কমানো হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ প্রতিষ্ঠাকাল তথা ১৯২১ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু থাকা ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে আসন সংখ্যা ১৮০টি থেকে কমিয়ে বর্তমানে ১০০টি করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে অন্য কোনো বিষয়ের আসনসংখ্যা কমানোর নজির নেই।
স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত ৫৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যে একমাত্র কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়েও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ খোলা হয়নি। অথচ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নাম দিয়ে চালু হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অনেক তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ, অপ্রয়োজনীয় ও অহেতুক বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়েছে।
তাই দেশের সাধারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনতিবিলম্বে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করা এখন সময়ের দাবি। তা ছাড়া দেশের সব উপজেলা পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি কলেজে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে অনার্স কোর্স এবং জেলা পর্যায়ের বড় কলেজগুলোতে মাস্টার্স কোর্স চালু করা আবশ্যক।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশে নতুন প্রজন্মকে ধার্মিক, আদর্শবান ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সব পাবলিক ও বেসরকারি প্রকৌশল এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে স্নাতক ও ডিপ্লোমা কোর্সে বাধ্যতামূলক ১০০ নম্বরের ‘ইসলামের মৌলিক শিক্ষা’ নামক একটি কোর্স চালু করা অতীব প্রয়োজন। এতে সব পেশাজীবীই ইসলামের ধর্মীয় ও আদর্শিক মৌলিক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে এবং ধর্মীয় বিধিবিধান অনুশীলন করে একজন আদর্শবান সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে।
একটি কথা না বললেই নয়। সমাজে বিরাজমান সংস্কৃতির একটি বিশাল অংশ দখল করে আছে ধর্মীয় আচার ও অনুশাসন। ধর্মীয় এই আচার ও অনুশাসন সামাজিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করে একটি নান্দনিক রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত করে। একে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা কারো নেই। তবে নৈতিক শিক্ষার জন্য শুধু ইসলাম নয়, সব ধর্মের প্রতি সমান আনুগত্য প্রকাশ করে এগিয়ে এলেই সমাজ গঠনের প্রশ্নে তা হবে ইতিবাচক।
আমরা আশা রাখি, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে। ইসলামের অনুপম আলোয় আলোকিত হবে সারা দেশ। নষ্ট ও পঙ্কিলময় এ সমাজে বইবে শান্তির ফল্গুধারা। এই দিন অতি সন্নিকটেই ইনশা আল্লাহ।