‘ইসলামী বিশ্বের সঙ্গে সেতুবন্ধ’ যেভাবে পুড়িয়ে দিয়েছে জার্মানি
Share on:
২০০৩ সালের মার্চে জার্মান পররাষ্ট্র দপ্তর ‘কানতারা’ নামে একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিল। ধ্রুপদি আরবি ভাষায় কানতারা মানে ‘সেতু’। এর উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলা ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বে উস্কে দেওয়া শত্রুতা মোকাবিলা।
জার্মান সরকার পরিচালিত ব্রডকাস্টার হলো ডয়চে ভেলে। তাদের দ্বারা পরিচালিত কানতারার ঘোষিত লক্ষ্য ছিল পশ্চিম ও ইসলামী বিশ্বের সাংস্কৃতিক বিভাজনের মধ্যে ‘বন্ধন’ তৈরি এবং আন্তঃধর্মীয় সংলাপের জন্য একটি নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম হাজির করা।
গত ২০ বছরের বেশি সময় ধরে ইংরেজি, জার্মান ও আরবি ভাষায় প্রকাশিত পোর্টালটি সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এ জন্য আপাতদৃষ্টিতে জার্মান সরকারের কোনো সম্পাদকীয় নির্দেশনা ছিল না। তবে সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে যখন পোর্টালটি গাজায় গণহত্যার প্রেক্ষাপটে জার্মানিতে চলমান ইহুদিবিরোধী বিতর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা প্রকাশ করে। এ বছরের শুরুতে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, কানতারা পুনর্গঠন এবং এর ব্যবস্থাপনা ডয়চে ভেলে থেকে ইনস্টিটিউট ফর ফরেন কালচারাল রিলেশনে হস্তান্তর করা হবে। এটি ফেডারেল পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত এবং তারাই অর্থায়ন করে। এর পর সম্পাদকীয় বিভাগের সব কর্মী প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগ করেন। ১ জুলাই কানতারার ব্যবস্থাপনা ডয়চে ভেলে থেকে আইএফএ-তে স্থানান্তরিত হয়। এখানে কোনো সম্পাদকীয় কর্মী ছিলেন না। আইএফএ থেকে বলা হয়েছে, সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান জেনিস হ্যাগম্যান দায়িত্ব নিয়ে নতুন সম্পাদনা পরিষদ গঠন করবেন। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দাপ্তরিকভাবে কাজ শুরু না করা পর্যন্ত এটি আইএফএর সম্পাদকীয় বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
কানতারায় এই ক্রান্তিকাল মধ্যপ্রাচ্য ও এর জনগণ সম্পর্কে জার্মান সরকারের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি পর্যবেক্ষণ ছেঁকে দেখার একটি অনন্য সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা এখন ইসলামিক বিশ্বের কাছে জার্মানির ‘সেতু’ হিসেবে বিজ্ঞাপন দেওয়া প্ল্যাটফর্মটি প্রকাশ্যে সম্পাদনা করছেন।
ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের আগে কানতারাকে মধ্যপ্রাচ্য ও বৃহৎ ইসলামী বিশ্ব নিয়ে নিরপেক্ষ, সূক্ষ্ম প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণের জন্য জার্মানি ও মধ্যপ্রাচ্য উভয় অঞ্চলে সম্মানের সঙ্গে দেখা হতো। এখন আর সেই অবস্থা নেই। এ মুহূর্তে পররাষ্ট্র দপ্তর অধিভুক্ত আইএফএর সম্পাদকীয় নির্দেশনায় কানতারা আন্তঃসাংস্কৃতিক ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপে প্রধানত দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে মনে হয় না। বরং দুর্বল গবেষণা ও সম্পাদকীয় মতামতের মাধ্যমে মুসলমানদের ব্যাপারে বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের সম্পর্কে জার্মান সরকারের পক্ষপাত ও কুসংস্কার নিশ্চিত করার দিকে মনোনিবেশ করেছে।
সম্ভবত কানতারার নতুন সম্পাদকীয় অবস্থানের সর্বোৎকৃষ্ট নজির তাদের প্রকাশিত এক নিবন্ধে উঠে এসেছে। নিবন্ধটির শিরোনাম ছিল– ‘ক্রাইসিস কমিউনিকেশন অ্যান্ড দ্য মিডল ইস্ট: লাইক অ্যান্ড শেয়ার’। গত ২৫ জুলাই এটি প্রকাশ পেয়েছিল। মূলত এটি ছিল মধ্যপ্রাচ্য ও এর জনগণের ব্যাপারে জার্মান সরকারের সত্যিকার মনোভাব।
উপসম্পাদকীয় নিবন্ধটি গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধ নিয়ে মরক্কো-জার্মান লেখক সিনেব এল মাসরারের মিডিয়া কাভারেজ বিশ্লেষণ করেছে। এতে ফিলিস্তিনিদের মজ্জাগতভাবে সহিংস ও ইহুদিবিরোধী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। নিবন্ধে বেশ জোর দিয়ে বলা হয়েছে, যেসব ফিলিস্তিনি সাংবাদিক গণহত্যার বিষয়ে প্রতিবেদন করেছেন, তারা মূলত হামাসেরই ছদ্মবেশী কর্মী। তারা কোনো রকম প্রমাণ কিংবা সমর্থন করে এমন কোনো যুক্তি না দিয়ে এগুলো তুলে ধরেছেন। গাজার মৃত্যু ও ভোগান্তি চিত্রগুলো ‘সাজানো’। ফিলিস্তিনিরা একমাত্র ‘ইসলামের ইহুদিবিদ্বেষ’জনিত কারণে ইহুদি দখলদারদের ঘৃণা করে। মূলত গাজায় কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে ‘বাজারের স্টল ও বারবিকিউ ফাঁড়িগুলো’র ছবি
তুলে ধরছে না। লেখক দাবি করেছেন, ‘সম্প্রতি প্রকাশিত ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন (আইপিসি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজা উপত্যকায় দুর্ভিক্ষ ছিল না এবং বর্তমানে এমন কিছুর অস্তিত্বও নেই।’
স্পষ্টতই এটি এক অরওয়েলিয়ান মিথ্যাচার। পেশাগত নীতি-নৈতিকতা মেনে চলে এমন সাংবাদিকতায় এ ধরনের পুনরাবৃত্তির কোনো স্থান নেই। মধ্যপ্রাচ্যে আসলে একটি ‘নাৎসি অতীত’ ছিল– এটা কি ইঙ্গিত দেয়? অবশ্যই কিছুই না। নাৎসিবাদ একটি একচেটিয়াভাবে পশ্চিমা ব্যাপার, বিশেষত জার্মানের সঙ্গে যুক্ত। এই মতাদর্শের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও এখানকার মুসলমানদের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই।
ভবিষ্যৎ যাই হোক না কেন, কানতারার এই ক্রান্তিকাল ও এল মাসরার নিবন্ধ ইতোমধ্যে জার্মান সরকার ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। তারা আমাদের দেখিয়েছে, জার্মান সরকার ইসরায়েলকে একটি ধর্মপন্থি ও নৈতিক সত্তা হিসেবে দেখে; এমনকি যখন দেশটি গণহত্যা চালায়, তখনও। তারা মুসলমানদের ইহুদিবিরোধী বলে তুলে ধরে এবং পশ্চিমা গণতন্ত্র অস্থিতিশীল করতে যে কোনোভাবে চক্রান্তকারী বলে সরাসরি তুলে ধরে। যাই হোক, গাজায় ইসরায়েলের চলমান গণহত্যায় জার্মান মনোভাব বোঝা এবং তার মোকাবিলায় লেখাটি আসলেই মূল্যবান তথ্য।