মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: বৃহস্পতিবার ১৫, অগাস্ট ২০২৪

ইসরায়েলের ‘হত্যাযজ্ঞ’ হৃদয় কঠিন হয়ে গেছে

Share on:

আরও একবার, এটা অনিচ্ছাকৃত। আরও একবার, এটা গণহত্যা নয়, কোনোভাবেই তা নয়। হাজার হোক, কতজন হতাহত হলো সেই সংখ্যা দিয়ে নয়; বরং উদ্দেশ্য দিয়ে নির্ধারণ করতে হবে যে কোনো হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা বলা যায় কি না। আর এখানে তো এ রকম কোনো উদ্দেশ্যই ছিল না।


দুই সপ্তাহ আগে মাজেদাল শামসে যখন হিজবুল্লাহ ১২ জন শিশুকে হত্যা করেছিল, তখন ইসরায়েলজুড়ে রব উঠেছিল, ‘গণহত্যা,’ ‘খুন’ ও ‘অবর্ণনীয় নৃশংসতা’। অথচ ইসরায়েলের কেউ কি এটা চিন্তা করেছিল যে হিজবুল্লাহ অধিকৃত গোলান মালভূমিতে ১২ জন দ্রুজ শিশুকে হত্যা করতে চেয়েছে? যেখানে হিজবুল্লাহ আছে, সেখানে তো আসলে উদ্দেশ্য কখনোই বিবেচনায় আসবে না। কারণ, তারা সব সময়ই হত্যাকারী। ১২ দ্রুজ শিশু নিহত হয়েছে মানে হিজবুল্লাহ তাদের হত্যা করতে চেয়েছে!

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) ক্ষেত্রে গল্পটা ভিন্ন। তাদের অস্ত্রের পবিত্রতা আছে। এটা খুনি-হত্যাকারী নয়; কিন্তু গত শনিবার গাজা শহরের তাবেইন স্কুলে যে মানুষগুলো নিহত হলেন, তাঁরা তো মাজেদাল শামসে ফুটবল খেলতে যাওয়া শিশুদের মতোই প্রাণ হারালেন; আর এই হত্যাযজ্ঞের দায়ও একই রকম।

গত ১০ দিনে আইডিএফ গাজায় আটটি স্কুলে বোমা ফেলেছে এবং প্রতিটি জায়গায় অন্তত দুই অঙ্কের সংখ্যার মানুষ হত্যা করেছে। তবে রেকর্ড তৈরি হয়েছে শনিবার যখন মানুষজন ভোরের প্রার্থনার (ফজরের নামাজ) জন্য স্কুলের নিকটবর্তী মসজিদে সমবেত হয়েছিলেন, তখন বোমা ফেলে প্রায় ১০০ জনকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে। এরা অনেকেই ইসরায়েলি হামলায় আগের জায়গা থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন, আর অনেকেই তাঁদের পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যদের হারিয়ে ফেললেন।

আল-জাজিরায় প্রকাশিত ছবিগুলো ভীষণ মর্মান্তিক—কিশোরীরা তাদের মা–বাবার মরদেহের পাশে কান্না করছে, রঙিন সিনথেটিক আবরণে অনেকের দেহের অঙ্গগুলো মুড়ে রাখা হয়েছে। তাঁরা প্রার্থনার জন্য জেগে উঠেছিলেন আর তারপরই নৃশংসভাবে ‘জবাই’ হয়ে গেলেন। এ যেন সেই বারুখ গোল্ডস্টেইনের হাতে ফিলিস্তিনিদের নিহত হওয়ার মতো হত্যাকাণ্ড যদিও এখানে দ্বিগুণের বেশি নিহত হয়েছেন ইসরায়েলি সৈন্যদের দ্বারা। (১৯৯৪ সালে হেবরনের একটি মসজিদে ঢুকে উগ্রবাদী ইহুদি গোল্ডস্টেইন নির্বিচার গুলি করে অন্তত ২৯ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেন। সে সময় আহত হন ১২৫ জনের বেশি। তবে যাঁরা বেঁচে যান, তাঁরা এই খুনিকে ধরে ফেলেন ও তাঁদের গণপিটুনিতে তিনিও প্রাণ হারান।)

ইসরায়েল তার সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় ও অপরাধমূলক যুদ্ধটা চালাচ্ছে। সম্ভাবনা প্রবল যে এটা থামার আগে সরকার এবং সেনাবাহিনী শেষবারের মতো মরিয়া হয়ে উঠেছে নির্বিচার ও অবাধে যত খুশি হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্য। তাই ১০ দিনে ৮ স্কুলের ঘটনা হেগের আন্তর্জাতিক আদালতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই গণহত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করতে পারে, এমন আইনজ্ঞ তো এখনো জন্ম নেননি।

যথারীতি আইডিএফের মুখপাত্র গতানুগতিক বিবৃতি দিয়েছেন, যা দুনিয়ার কেউই বিশ্বাস করছেন না। বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, ‘আঘাত হানার আগে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যাতে বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষতির ঝুঁকি কমানো যায়। এসব পদক্ষেপের মধ্যে ছিল নিখুঁত ভেদাস্ত্র, আকাশ থেকে নজরদারি ও আগাম গোয়েন্দা তথ্য।’

আচ্ছা, এতসব স্পর্শকাতর পদক্ষেপ নেওয়ার পরও ১০০ জন মানুষ হত্যার শিকার হয়েছেন! তাহলে চিন্তা করে দেখুন তো এসব পদক্ষেপ না নিলে আরও কত মানুষ নিহত হতেন? গাজার ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেহেতু হামাস–নিয়ন্ত্রিত, সেহেতু তাদের দেওয়া হতাহতের পরিসংখ্যান সঠিক নয় বলে দাবি করাটাও বেদনাদায়ক। ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তো গোড়া ইহুদিপন্থী শাসক দলের নিয়ন্ত্রণে।

এ ধরনের ইতরামি সহ্য করা অসম্ভব, বিশেষত যখন ১০ দিনের মধ্যে এটি ছিল অষ্টম স্কুল যা বোমা হামলার শিকার হয়েছে। স্কুলগুলোয় হামাসের কমান্ড সেন্টার ছিল বলে যে দাবি করা হয়েছে, তা মেনে নেওয়া কঠিন। এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনী একটি প্রমাণও হাজির করে দেখাতে পারেনি যে তাদের হামলা করা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর একটিও হামাসের কমান্ড সেন্টার ছিল। (স্কুলগুলো উদ্বাস্তুদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।) অবশ্য ইসরায়েলিদের এ নিয়ে কিছু আসে যায় না। তারা সবকিছুরই আগাম সমর্থন দেয়। তাদের কাছে সবকিছুই নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য; কিন্তু তাদের পাশে কেউ আর তা মানতে রাজি নয়।

আর এটা তো বলতেই হবে—যদি সে রকম কোনো ‘কমান্ড সেন্টার’ (এটা একটা বায়বীয় কথাও বটে) থেকেও থাকে, তার পরও শিশুসহ কয়েক ডজন অসহায়, বিপর্যস্ত ও ভীত মানুষদের হত্যা করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কোনোটিতে যখন একজন হামাসের পুলিশ কর্মকর্তা লুকিয়ে থাকেন, তখনো এভাবে গণহারে হত্যা গ্রহণযোগ্য নয়। তারপর ১০ দিনে যখন ৮ বার এ রকম হত্যাযজ্ঞ চলে, তখন মনে রাখতে হবে যে এ বিষয়ে পরিষ্কার একটি নীতিতে তা চলছে। আর তা হলো আন্তর্জাতিক যুদ্ধ অপরাধ নীতি।

ইসরায়েল তার সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় ও অপরাধমূলক যুদ্ধটা চালাচ্ছে। সম্ভাবনা প্রবল যে এটা থামার আগে সরকার এবং সেনাবাহিনী শেষবারের মতো মরিয়া হয়ে উঠেছে নির্বিচার ও অবাধে যত খুশি হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্য। তাই ১০ দিনে ৮ স্কুলের ঘটনা হেগের আন্তর্জাতিক আদালতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই গণহত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করতে পারে, এমন আইনজ্ঞ তো এখনো জন্ম নেননি।

১৯৯৬ সালে লেবাননে অপারেশন ‘গ্রেপস অব র‍্যাথ’ চালানোর সময় আইডিএফ কাফর কানায় একটি জাতিসংঘ আশ্রয়শিবিরে ১০২ জন বাস্তুচ্যুত মানুষকে হত্যা করেছিল। এরপর ইসরায়েল তা অস্বীকারের চেষ্টা করে অজুহাত দেখিয়েছিল। তবে কয়েক দিন পরেই এই অভিযান শেষ করতে হয়েছিল ইসরায়েলকে। শনিবারের হত্যাযজ্ঞ একই ধরনের ফল বয়ে আনবে না, যা আমাদের জন্য ভয়াবহই হবে। ইসরায়েল ইতিমধ্যে একটি ভিন্ন ধরনের রাষ্ট্র হয়ে গেছে, এর সেনাবাহিনীও ভিন্ন ধরনের। তাদের হৃদয় কঠিনতর হয়ে গেছে, যেমনটা হয়ে আছে বেশির ভাগ ইসরায়েলের।

প্রথম আলো