ইলিশ ব্যবস্থাপনায় জেলেদের ওপর জুলুম ও বেইনসাফির মাত্রা বাড়ছে
Share on:
ইলিশ রক্ষার সরকারি অভিযানে গরিব জেলে, যারা মাছ ধরা বন্ধের সময় অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটায়; জেল-জরিমানা হয়েই থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তাদের ওপর জুলুম ও বেইনসাফির মাত্রা বাড়ছে। কয়েকটি ঘটনায় আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সঙ্গে এনকাউন্টারে জেলেরা প্রাণ পর্যন্ত হারিয়েছে।
জেলেদের একজন মাসুদ; চাঁদপুরে মেঘনায় পুলিশের গুলিতে ২০২১ সালের মার্চ মাসে নিহত হন। মুন্সীগঞ্জে পরিবারের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, তাঁর বয়স ছিল ২২ বছর। দুই ছেলে নিয়ে বেঁচে আছেন মাসুদের স্ত্রী। ছোট ছেলের নাম হজরত মোহাম্মদ; বয়স ৩ বছর হলো। জন্মের আগেই তার বাবা পুলিশের গুলিতে মারা যান। সেই রাতে এই পরিবারে পরদিন রান্নার জন্য একমুঠো চালও ছিল না।
সেই রাতে দ্রুতগামী নৌকারোহী পুলিশের ওপর ঠিক কীভাবে জেলেরা হামলা করল; আত্মরক্ষায় পুলিশকে গুলিই বা ছুড়তে হলো কেন; সে ব্যাপারে তদন্তের খবর জানা যায় না। এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে লক্ষ্যে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সে ব্যাপারেও কিছু জানা যায় না।
পুলিশ, অন্যান্য আধা-সামরিক ও সামরিক বাহিনীকে যখন মৎস্য মন্ত্রণালয় ‘অভিযানে’ সম্পৃক্ত করে, তখন অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ বন্ধের ব্যাপারে কী ধরনের আলোচনা হয়; আদৌ আলোচনা হয় কিনা, তাও জানা যায় না।
পরিবারের বক্তব্য, মাসুদ মরে গিয়ে বেঁচেছেন। যারা বেঁচে আছেন, মাসুদের একাধিক ভাইসহ নৌকার অন্য জেলেরা এখনও পুলিশি মামলার আসামি। মাসুদের বাবা জানালেন, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়ে ‘অমানুষিক টর্চার’ করা হয়েছে ছোট ছেলেকে। এসব কথা শুরু হলেই মাসুদের মায়ের কান্না শেষ হয় না। মেজো ছেলে মরল, আর ছোট ছেলে পুলিশি নির্যাতনের আঘাত বয়ে বেড়াচ্ছে।
আমার প্রশ্ন– প্রাকৃতিক মৎস্য খাতের এই যে গভীর সংকট, অনাহারী-অর্ধাহারী জেলেদের ওপর বলপ্রয়োগ ও নির্যাতন যেভাবে মৎস্য সংরক্ষণ-ব্যবস্থাপনার প্রধান ভিত্তি হয়ে উঠেছে, এর থেকে উত্তরণে সরকার কী চিন্তা করছে?
অক্টোবর মাসে (আশ্বিনের পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে) ডিম পাড়া ইলিশ ধরা বন্ধের মৌসুম শুরু হবে। মৎস্য মন্ত্রণালয় অভিযান চালাবে। এই অভিযান কি বিগত বছরগুলোর চেয়ে ভিন্ন রকম হবে? জেলেদের ওপর চাঁদাবাজি-বন্দুকবাজি-মামলাবাজির বাইরে কাজের কাজ কিছু হবে?
বাংলাদেশে লাখ লাখ সম্প্রদায়গত জেলেই প্রাকৃতিক মৎস্য খাতের মূল শক্তি। সেখানে ইলিশের বংশ রক্ষায় শুধু বন্দুক অভিযানে ভরসা করার যুক্তি কী? প্রাকৃতিক মৎস্য খাতের ব্যবস্থাপনায় জেলে, মৎস্যজীবী, ব্যবসায়ী ও লোকসমাজের সম্মিলিত নেতৃত্ব দরকার। সরকারকে সে জন্য উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। বন্ধের মৌসুমে জেলেদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আলোচনা এখনও দেখছি না।
জেলেরা যেহেতু দুস্থ, তাই বন্ধের মৌসুমে চাল সাহায্য দেওয়া হয়। শুধু চাল খেয়ে জেলেরা বাঁচবে, এটাই অনুমান। কিন্তু অধিকাংশ জেলে থাকে ওই চাল তালিকার বাইরে। চাল বিতরণেও দুর্নীতি; তালিকাভুক্ত জেলেরা বরাদ্দ চালের অর্ধেকও সাধারণত পায় না। দেশের অর্থনীতিতে ইলিশের অবদান নিয়ে এত কথা; কিন্তু জেলে পরিবারগুলো এখনও দুস্থ কেন?
সরকারের উচিত প্রাকৃতিক মৎস্য খাতের দুরবস্থা আমলে নেওয়া। বিশেষত ইলিশ রক্ষার অভিযানগুলোর নীতিগত সংকট এবং মাঠ পর্যায়ের ব্যর্থতা স্বীকার করে সমাধানের পথ খোঁজা।
চাঁদপুর-মুন্সীগঞ্জের কথাই ধরা যাক। অভিযান বাস্তবায়নে এখানেও বন্ধের মৌসুমে বরাদ্দ হয়, কিন্তু মাছ ধরা বন্ধ হয় না। তা সে ডিম পাড়া ইলিশ কিংবা জাটকার সময়েই হোক। এটা ওপেন সিক্রেট, নদীতে মাছ ধরতে পুলিশকে মাসিক ভিত্তিতে সারাবছর চাঁদা দিতে হয়। অভিযানের সময়ও দৈনিক ভিত্তিতে ও বেশি পরিমাণে চাঁদা দিলেই মাছ ধরা যায়।
জাটকা এবং ডিম পাড়া ইলিশ ধরা হয়; পুলিশ সারাবছর চাঁদাও তোলে। গরিব জেলে, যারা চাঁদা দিতে পারে না, তাদের ভুগতে হয়, ঋণ করতে হয়, আর মাছ ধরতে গেলে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এখানে অভিযানের ফলে মাছ ও মানুষ কারোরই বিশেষ কোনো উপকার হয় না।
প্রাকৃতিক মৎস্য খাত– সাগর, নদী ও হাওরে শুধুই মাছ ধরা বাড়ানো সাফল্যের সূচক হতে পারে না। অন্যান্য সূচক বিবেচনায় না নিয়ে শুধু মাছ ধরা বাড়ালে খাতটিকে দুর্বলই করা হয়। প্রাকৃতিক মৎস্য খাতের সাফল্য ও টেকসই অবস্থার বিচারে আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো বিবেচনা করতে হবে।
যেমন প্রাকৃতিক উৎসগুলোয় দীর্ঘ মেয়াদে মাছের মজুতের কী অবস্থা থাকবে; মাছ ধরার পরিমাণ এবং দীর্ঘ মেয়াদে মাছের সম্ভাব্য মজুত সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা; মাছ ধরতে গিয়ে জলজ প্রাণ-প্রকৃতির ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে কি না।
প্রধানতম বিবেচ্য, প্রাকৃতিক মৎস্য খাতের প্রধান শক্তি যারা এ দেশে সেই সম্প্রদায়গত জেলেদের জীবন সচ্ছল, নিরাপদ ও সুখের কিনা; জেলেদের আয়-রোজগার ও জীবনমানের উন্নতি হচ্ছে কিনা।
প্রাকৃতিক মৎস্য খাত ব্যবস্থাপনায় সরকারের প্রতিনিধিত্ব করার মতো সামর্থ্যবান ও সক্ষম রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আমাদের নেই। মাছ চাষ সম্প্রসারণে মৎস্য অধিদপ্তরের সাফল্যের কথা বলা হয়। কিন্তু চাষের মাছের উৎপাদন বাড়ানো এবং প্রাকৃতিক মৎস্য খাতের সংরক্ষণ-ব্যবস্থাপনা ভিন্ন ব্যাপার।
জেলেরা প্রাকৃতিক মৎস্য খাতের প্রাণভোমরা। জেলে ও মৎস্যজীবী সংগঠনের নেতৃত্বে এবং ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় এ খাতের ব্যবস্থাপনার বুনিয়াদ তৈরি করতে হয়। প্রাকৃতিক মৎস্য খাতে লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা-সংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গী জড়িত। এখানে অংশীদারিত্বমূলক ব্যবস্থাপনায় সরকারের প্রতিনিধিত্ব করার উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান গড়তে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ দরকার।
স্বল্প মেয়াদে সরকারের উচিত জেলে, মৎস্যজীবী ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গে বসে সম্মিলিত নেতৃত্বে ডিম পাড়া ইলিশ রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়া। বন্দুকবাজি, চাঁদাবাজি ও মোবাইল কোর্টে সামারি ট্রায়ালের প্রহসন বন্ধ করা উচিত। বন্ধের মৌসুমে জেলেদের জন্য ‘পেমেন্ট ফর ইকোসিস্টেম সার্ভিস’-এর ব্যবস্থা করবে সরকার– সেই আশাও রইল।