ইতিহাসে শ্বেতপত্র নিয়ে যত কথা!
Share on:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন উইনস্টন চার্চিল। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি যুক্তরাজ্য সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল সেক্রেটারি অব স্টেট ফর দ্য কলোনিজ বা বিলেতের উপনিবেশবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী।
সেটা ১৯২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯২২ সালের অক্টোবর। এই সময়কালের মধ্যে তাঁর নির্দেশনায় ‘প্যালেস্টাইন: করেসপনডেনস উইথ দ্য প্যালেস্টাইন অ্যারাব ডেলিগেশন অ্যান্ড দ্য জায়নিস্ট অর্গানাইজেশন’ নামে একটি দলিল প্রকাশ করে ব্রিটিশ সরকার।
নয়টি ছোট ছোট নথি-সংবলিত এই দলিলটি চার্চিল হোয়াইট পেপার (চার্চিলের শ্বেতপত্র) বা ফিলিস্তিন বিষয়ক ব্রিটিশ শ্বেতপত্র নামেও পরিচিতি পায়। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার ব্যালফোর ৬৭ শব্দের এক ছোট্ট পত্রে ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইহুদিদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের বিষয়ে যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন, তা ইতিহাসে ব্যালফোর ঘোষণা হিসেবে পরিচিত। চার্চিলের শ্বেতপত্র এই ব্যালফোর ঘোষণাকে সমর্থন দেয়। বলা হয়ে থাকে, এখান থেকেই হোয়াইট পেপার বা শ্বেতপত্র নামকরণটির বিস্তার ঘটে।
এর আগে কোনো সরকারি বা আধা-সরকারি দলিলকে শ্বেতপত্র হিসেবে নামকরণ হয়েছে বলে সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। তবে বিংশ শতকের গোড়া থেকেই ব্রিটেনে কোনো আইন-কানুন প্রবর্তনের আগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এক বা একাধিক সরকারি ভাষ্য-সংবলিত প্রতিবেদন তৈরি করার চর্চা প্রচলিত ছিল। এসব প্রতিবেদন অনেকটা হাল আমলের পলিসি অ্যাডভোকেসি বা নীতি প্রচারপত্রের মতো ছিল।
সে সময় ব্রিটেনে আরও দুই ধরনের প্রতিবেদন দলিল আকারে প্রকাশ করা হতো। একটি হলো, ব্লু বুক বা নীল পুস্তিকা, যা মূলত বিস্তারিত সরকারি প্রতিবেদন। আরেকটি হলো, গ্রিন পেপার বা সবুজ পত্র, যা কোনো সরকারি নীতি বিষয়ে প্রাথমিক প্রতিবেদন। এ দুটো থেকে আলাদা ধরনের হওয়ার নীতি প্রচারপত্রের মতো দলিলগুলোর নামকরণ হয় শ্বেতপত্র।
শ্বেতপত্র নিয়ে এসব কথার অবতারণা এ জন্য যে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরার জন্য একটি শ্বেতপত্র প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে গঠিত ১২ সদস্যের কমিটি ইতিমধ্যে কাজও শুরু করে দিয়েছে। কমিটি ৯০ দিনের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন তথা শ্বেতপত্রটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করবে। পাশাপাশি এটি জনগণের জন্যও উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সরকার গত দেড় দশকে নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে যে বিপর্যয় ঘটিয়ে গেছে, সেটার একটা স্পষ্ট চিত্র এই শ্বেতপত্রে উঠে আসবে। তবে এসব অনিয়মের জন্য কারা দায়ী, তা চিহ্নিত করা এই শ্বেতপত্রের কার্যপরিধির বাইরে, যা যুক্তিসংগত। বরং কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে, তার কিছু চিত্র ও সূত্র পাওয়া যাবে এই দলিল থেকে। এতে অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জ্বালানি, ব্যাংকিং, কর আহরণ, অর্থ পাচার, মেগা প্রকল্প, দারিদ্র্য ও বৈষম্য পরিস্থিতির ওপর আলোকপাত করা হবে।
বাংলাদেশে শ্বেতপত্র নিয়ে অতীতেও আলোচনা হয়েছে, কিছু কাজও হয়েছে। মানে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। তবে সেগুলো ঠিক শ্বেতপত্র হয়েছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে, বিশেষত যখন সেখানে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য।
আজ থেকে ২২ বছর আগে অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক ২০০০-এ (ফেব্রুয়ারি ০১, ২০০২ সংখ্যা) বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকার ও প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি শ্বেতপত্র প্রকাশ নিয়ে একটি প্রচ্ছদ কাহিনি প্রকাশিত হয়েছিল। ‘দুই শ্বেতহস্তীর লড়াই: জনগণের খরচ ১৫০০ কোটি টাকা’ শিরোনামে সেই প্রতিবেদনে দুটি শ্বেতপত্রের ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছিল। সেখান থেকেই জানা যায় ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠনের পর ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি ও অনিয়মের ওপর দুই খণ্ডে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে ২০০২ সালের জানুয়ারি মাসে।
৭৫০ পৃষ্ঠার বেশি এই শ্বেতপত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৬ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহারের বিবরণী তুলে ধরা হয়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও একই সময়ে পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৯১-১৯৯৬ মেয়াদকালে বিএনপি সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ক্ষমতায় থাকার সময় আওয়ামী লীগ এই কাজটি করেনি।
শ্বেতপত্র নামের এসব দলিলে মূলত বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগপত্র, কিছু তদন্ত প্রতিবেদন, বিভিন্ন মামলার নথি, সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের অনুলিপি ইত্যাদি সন্নিবেশিত হয়। পাশাপাশি কিছু মন্তব্য বা ব্যাখ্যা জুড়ে দেওয়া হয়। শ্বেতপত্রগুলোর ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে সে সময় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বলেছিলেন যে দুর্নীতির সংজ্ঞা নির্ধারণ ও এর পরিধি বিশ্লেষণ না করে শুধু কিছু সরকারি নথির সংকলন করে শ্বেতপত্র নামকরণ করা হয়েছে, যা দিয়ে সরকারের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত হবে না।
তবে কাজটির ইতিবাচক দিক হিসেবে তিনি এ-ও বলেছিলেন যে এর মধ্য দিয়ে সরকার জনগণের তথ্য জানার অধিকার স্বীকার করে নিয়েছে। জনগণ দলিলগুলো পড়ে নিজেদের মতো করে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বলেও মন্তব্য করেছিলেন প্রয়াত এই অধ্যাপক।
পাল্টাপাল্টি শ্বেতপত্রের হালনাগাদ এক দৃষ্টান্ত অবশ্য প্রতিবেশী ভারতেই মেলে। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে এটা দেখানোর জন্য যে ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট সরকারের পরপর দুই মেয়াদি সময়কালে (২০০৪-২০১৪) ভারতের অর্থনীতির অবস্থা কতটা খারাপ ছিল। পাশাপাশি শ্বেতপত্রে এটাও তুলে ধরা হয় যে নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বে বিজেপির শাসনামলে (২০১৪-২০২৩) ভারতের অর্থনীতি কীভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ও ক্রমাগত তেজি হয়েছে। বিজেপির এই শ্বেতপত্রের বিপরীতে কংগ্রেস অবশ্য প্রকাশ করেছে ব্ল্যাক পেপার বা কৃষ্ণপত্র (বা কালোপত্র)। তাতে মোদি সরকারের এক দশকের শাসনের নানা অনিয়ম-বিচ্যুতি তুলে ধরা হয়েছে।
বলা দরকার যে শ্বেতপত্র কোনো একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ের ব্যাপক, তথ্যমূলক ও বিশ্লেষণধর্মী চালচিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করে, যা সরকার বা নীতিনির্ধারকদের তথ্যনির্ভর নীতি প্রণয়ন বা সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে। অন্যদিকে কালোপত্র কোনো একটি বিষয় বা নীতির সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো প্রচলিত বা প্রতিষ্ঠিত বয়ান বা বিদ্যমান নীতিকে যুক্তি-তথ্য দিয়ে চ্যালেঞ্জ করা ও তার বিচ্যুতি তুলে ধরা। পাশাপাশি বিকল্প কী হতে পারে তা সুপারিশ করা।
একটি গ্রহণযোগ্য বা মানসম্মত শ্বেতপত্র কেমন হতে পারে, তার উদাহরণ ভারত থেকেই টানা যায়। প্রণব মুখার্জি অর্থমন্ত্রী থাকার সময় ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় কালোটাকার ওপর যে শ্বেতপত্র প্রস্তুত করেছিল, সেটার কথা বলা হচ্ছে। আজ থেকে এক যুগ আগে ২০১২ সালে ১০০ পৃষ্ঠার বেশি এই শ্বেতপত্রটি প্রকাশ করা হয়, যার পরিচিতি হিসেবে বলা হয় যে এই দলিলটি হলো ‘কালো টাকার বিভিন্ন রূপ এবং দেশের নীতি ও প্রশাসনিক কাঠামোর সঙ্গে এর জটিল সম্পর্কের’ বিস্তারিত বিশ্লেষণ।
ধরে নেওয়া যায় যে শ্বেতপত্রের স্বীকৃত কাঠামো অনুসরণ করেই বাংলাদেশের আলোচ্য শ্বেতপত্রটি প্রস্তুত করা হবে। ইতিমধ্যে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি বেশ কিছু বিষয়ে জনসাধারণের কাছ থেকে মতামত ও পরামর্শ আহ্বান করেছে। বিষয়গুলোর মধ্যে আছে: সরকারি পরিসংখ্যানের যথার্থতা ও নির্ভরযোগ্যতা; সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো; প্রবৃদ্ধি; মূল্যস্ফীতির প্রবণতা ও তার অভিঘাত; দারিদ্র্য ও বৈষম্য; অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ; সরকারি ব্যয় বরাদ্দে অগ্রাধিকার মূল্যায়ন; বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য ও ঋণ সক্ষমতা; মেগা উন্নয়ন প্রকল্প; ব্যাংক খাতের প্রকৃত অবস্থা; জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের পরিস্থিতি; ব্যবসা-পরিবেশ ও বেসরকারি বিনিয়োগ; টাকা পাচার; প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার ইত্যাদি।
জনসাধারণের কাছ থেকে মতামত আহ্বান করা শ্বেতপত্র প্রণয়নকে অধিকতর অংশগ্রহণমূলক করবে, পাশাপাশি এর স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণেও ভূমিকা রাখবে।