আসুন চলমান রাষ্ট্র সংস্কার কাজে অংশগ্রহণ করি
Share on:
বাংলাদেশের সব শ্রেণির ছাত্ররা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে। তারা শুধু ইতিহাস জন্ম দিয়ে ক্লান্ত হয়নি, সেই ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছে।
মূলত ছাত্রদের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান বাংলাদেশে ঘটিয়েছেন এবং স্বৈরতান্ত্রিক, এক নায়ক নায়কত্রান্তিক শাসন ও দুর্নীতিবাজ শাসকদের হাত থেকে শুধু দেশকে রক্ষায় করেননি, বরং রাষ্ট্রের বিনির্মাণে তথা এর কাঠামো সংস্কারে তারা সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। কয়েকটি ছোট কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা এখানে বিশ্লেষণ করব।
এক. দেশের এই ক্রান্তিকালে আমাদের ছাত্র ভাইয়েরা (স্কুল, কলেজ ,বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণির মাদরাসার ছাত্রবৃন্দ) আমাদের সংখ্যালঘু ভাই-বোনদের ধর্মীয় উপাসনালয়, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং বাড়ি-ঘরের পাহারায় নিযুক্ত হয়েছেন। যখন দেখি অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে পাঞ্জাবি-পায়জামা, দাঁড়ি-টুপিওয়ালা ছাত্ররা (বিশেষ করে মাদরাসা ছাত্ররা) সংখ্যালঘু ভাইদের এসব স্থাপনা পাহারায় নিযুক্ত, তখন মনে হয় আমরা এক নতুন বাংলাদেশের দিকে যাত্রা করছি, যেই বাংলাদেশে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব শ্রেণির, সব পেশার মানুষ শান্তিতে বসবাস করব, যেখানে কারোর বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বা অন্য কোনো মৌলিক অধিকার হরণ করা হবে না, সবাই প্রাণ খুলে মুক্ত বাতাসে শ্বাস গ্রহণ করতে পারবে। গত কয়েকদিন থেকেই ঢাকার প্রায় সব এলাকায় ডাকাতি, গণ-ডাকাতি, চুরি-ছিনতাই এবং অন্যান্য অপরাধ প্রতিরোধে আমাদের ছাত্র ভাইয়েরা এবং সাধারণ জনতা রাত জেগে পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় পাহারার ব্যবস্থা করেছে। আজ রাত তিনটার দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখি রাস্তায় আমার ছাত্র ভাইয়েরা বসে আছেন লাঠি নিয়ে। তারা টহল দিচ্ছেন রাস্তায় রাস্তায়, অলিতে গলিতে। এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা যা আমাদের দেশকে নতুন করে সাজিয়ে দিতে পারে।
দুই. দেশের এই ক্রান্তিকালে, পরিবর্তিত পরিস্থিতি দেশের প্রায় প্রত্যেকটি পুলিশ স্টেশন বা থানায় আজ সব শ্রেণির ছাত্ররা পাহারায় নিযুক্ত হয়েছে। দুর্বৃত্তদের হামলায় (যা কখনোই ছাত্রদের কাজ হতে পারে না) সারাদেশের প্রায় প্রতিটি থানায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে, আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সব কিছু। এক একটা পুলিশ স্টেশন তো রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি যা প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়েছে। একটা দেশের আইন-শৃঙ্খলা যদি ঠিক না থাকে, তাহলে কোনো ভাবেই সে দেশে উন্নয়ন সম্ভব না, মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব না, দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করা সম্ভব না, চুরি ছিনতাই প্রতিরোধ করা সম্ভব না। এক্ষেত্রে আমরা কেউই নিরাপদ থাকব না, যা বিগত কয়েকদিনের ঘটনায় পরিলক্ষিত হয়েছে বা প্রমাণিত হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে একটি দেশ কতটা নিরাপদ তা নির্ভর করে দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা নিরাপদ। আমরা যদি আমাদের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে না আসতে পারি, তাহলে আবার আমরা অন্ধকারের দিকেই ধাবিত হব, তাহলে সেই রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি তথা শোষণের দিকেই ধাবিত হব। সেই ক্ষেত্রে দেশ কখনোই আলোর মুখ দেখতে পাবে না। যে সংগ্রাম আমাদের ছাত্র ভাইদের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আজ একটি সুন্দর কাঙ্ক্ষিত ফলাফল এর দিকে ধাবিত হওয়ার কথা তা থেকে আমরা শত শত হাত দূরেই থেকে যাব।
আসুন আমরা সবাই মিলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি, প্রত্যেকটা থানা, পুলিশের অন্যান্য স্থাপনা আমরা নিরাপদ করে গড়ে তুলি । প্রত্যেক পুলিশ ভাইদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করি। ছাত্র-জনতার সহযোগিতায় একমাত্র পুলিশ ভাইরাই পারে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতে, দেশকে সার্বিকভাবে নিরাপদ করতে। আমাদের সেনাবাহিনীর সদস্যবৃন্দ দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে একটি সার্বিক নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলতে, চলুন আমরা তাদেরকে সহযোগিতা করি। পুলিশ ভাইদের কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করি। হ্যাঁ, হয়তো আমার- আপনার পুলিশ ভাইদের উপর মনের ক্ষোভ থাকতে পারে কিন্তু মনে রাখবেন তারা আপনার-আমার এই সমাজেরই কারো না কারোর ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী বা সন্তান। তারা কিন্তু এই সমাজ থেকেই এসেছে। আমরা যখনই তাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেব, দেখবেন আমরা একটা সুন্দর নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলতে পারব। হ্যাঁ অবশ্যই পুলিশ বাহিনীর রিফর্ম দরকার যেন তারা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের শিকার না হয়, যেন তারা শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না হয়, যেন তারা নিজের বিবেক-বুদ্ধির বিসর্জন দিয়ে রাজনৈতিক পালেহনকারী না হয়। আমরা জনসাধারণ দেখতে চাই পুলিশ বাহিনী কাজ করবে দেশের জন্য, দেশের সার্বিক অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য, দেশের মানুষের জন্য, কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য নয় বা কোনো ব্যক্তি বিশেষের জন্য নয়। পুলিশের প্রতিটি বুলেট ব্যবহার হবে দেশের মানুষের নিরাপত্তার জন্য, দেশের নিরাপত্তার জন্য। পুলিশ বাহিনীর গুটিকয়েক দুর্বিত্তায়িত সিনিয়র অফিসারদের জন্য আজকের পুলিশের এই সার্বিক অবস্থা। এই সব দুর্নীতিবাজ, রাজনৈতিক পালেহনকারী এবং দুর্বিতায়নকারী অফিসারদের নির্দেশেই ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানো হয়েছে, তাদের বিচার এদেশে অবশ্যই হবে। অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। দেশের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য, আমাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ভাইদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করি, যেন সবাই মিলে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।
তিন. চাকরি সূত্রে পৃথিবীর অনেক দেশেই বিশেষ করে, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আফ্রিকা অঞ্চলে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু আমাদের মত এরকম অসভ্যভাবে তারা কেউ ওয়াল লিখন বা দেয়ালে লিখে না। চারিদিকে কখনোই এরকম নোংরাভাবে পোস্টার ছাপিয়ে তারা টানায় না। এরকম পোস্টার বা দেয়াল লিখে তারা নিজেদেরকে জাহির করে না। আমাদের দেশের দেয়ালগুলো (সেটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেয়াল হোক বা বাড়ির দেয়াল হোক বা অন্য কোন এবং অন্যান্য জায়গায় দেয়াল লিখন, পোস্টার লাগানো বা দেয়ালে ছাপ দেওয়া) যেন অসভ্যতার চূড়ান্ত মানদণ্ড প্রকাশ করে। রাজনৈতিক পালেহনকারী, দেউলিয়াপনা এবং দুর্বৃত্তায়নের চিত্র খুব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে এসব দেয়াল বা ওয়ালে। সাথে সাথে বিভিন্ন শ্রেনির ব্যবসায়িক এবং কোচিং সেন্টার সমূহের বিজ্ঞাপন যুক্ত হয়েছে। ছাত্র জনতার এই অভ্যুত্থানের পরে একটা বিষয় দেখে মনের ভেতরে একটা আশা উঁকি দিচ্ছিল যে, আমরা মনে হয় এর থেকে বের হয়ে আসব। সেদিন দেখলাম ছাত্ররা তাদের স্কুল, কলেজের দেয়াল লিখনগুলো মুছে দিচ্ছে, পরিষ্কার করছে এবং নতুন করে রং লাগিয়ে দিচ্ছে। মনে হয়েছে যেন এই রং স্বাধীনতার রং, এই রং আমাদের জীবনের রং, এই রং আমাদের নতুন করে সভ্যতার রং। হ্যাঁ, আমরা এই ওয়ালগুলোকে আমাদের জীবনের রঙে রাঙিয়ে তুলতে পারি ।এখনে আমরা বিভিন্ন শিক্ষামূলক উপদেশ এবং বিভিন্ন বাণী সমূহ প্রচার করতে পারি, যেটা হয়তো আমাদের শিক্ষার একটা পার্ট বা উপকরণ হয়ে উঠতে পারে (ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এটা অনেক আগেই করেছে এবং অন্যান্য জায়গায় এটা দেখেছি)।
আসুন আজকে থেকে আমরা শপথ গ্রহণ করি আমরা এসব দেয়াল লিখন লিখব না বা পোস্টার বিভিন্ন জায়গায় লাগাব না, আমাদের পরিবেশের ক্ষতি করব না, আমাদের অর্থনীতির ক্ষতি করব না। ছাত্র ভাইদের অনুরোধ করবো তারা যেন এ সব কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করেন। কাউকেই এ সব অসভ্য কাজগুলো করতে আমরা দেব না, প্রতিরোধ গড়ে তুলব। আমরা যেন সভ্য জাতি হিসেবে পৃথিবীতে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারি এবং একটি সুন্দর বসবাসযোগ্য পরিবেশ গড়ে তুলতে পারি।
চার. ছাত্ররা আজ ঢাকা শহরের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করার চেষ্টা করছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ইউরোপ-আমেরিকা থেকে শুরু করে আফ্রিকার দেশ সমূহে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের যে ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছি, ওই তুলনায় ঢাকা শহরের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা পৃথিবীর অন্যতম একটা কঠিন কাজ বলে মনে হয়। কারণ এখনও ট্রাফিকের কোনো স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটারাইজড কোনো সিস্টেম নেই। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে ট্রাফিক পুলিশ অথচ ট্রাফিক সিগন্যালগুলো বাতিগুলোর (লাল-সবুজ) নিয়ন্ত্রণ সিটি কর্পোরেশনের হাতে। একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা বলি আসাদগেট আড়ং এর সামনে যে পুলিশ বক্সটা রয়েছে তার কর্নারে এক সময় দুই হাত রাস্তা ভেঙে দেওয়ার জন্য ট্রাফিক পুলিশ চেষ্টা করেছিল যেন গাড়িগুলোর মুভমেন্ট খুব সহজ হয় কিন্তু পুলিশ সেটা করতে পারেনি কারণ রাস্তাগুলোর নিয়ন্ত্রণ পুলিশের হাতে নেই।
একটা আধুনিক শহরের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ থাকতে হয় রাস্তাঘাট অথচ আমাদের ঢাকা শহরে রয়েছে মাত্র ৭ থেকে ৯ ভাগ এবং এর ফুটপাতগুলোর অধিকাংশ দেখা যাচ্ছে হকারদের দখলে বা রাজনৈতিক নেতাদের দখলে। জনগণ কখনোই ফুটপাত দিয়ে স্মুথলি হাঁটতে পারে না। আবার সেই জনগণ নিয়ম মানতেও আগ্রহী না। যে যার মত যেভাবে পারে সেভাবেই গাড়ি চালাচ্ছে, কেউ কোনো নিয়মের তোয়াক্কা করছে না। ফুটপাত দিয়ে মোটরসাইকেল উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখানে ভিআইপিদের জন্য এক নিয়ম, সাধারণ মানুষের জন্য এক নিয়ম, রাজনৈতিক নেতাদের জন্য এক নিয়ম। এক হ-য-ব-র-ল অবস্থা! এর মধ্যেই ট্রাফিক পুলিশকে ঢাকা শহরে অন্যতম কঠিন কাজ যানবাহন নিয়ন্ত্রণের কাজটি করতে হয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। আজ সেই কঠিন কাজটি আমাদের ছাত্ররা হাতে নিয়েছে, সত্যি এটি অনেক কঠিন কাজ। মিডিয়ায় দেখলাম ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজটি যে কত কঠিন তা ছাত্রদের অভিব্যক্তি বা তাদের সাক্ষাৎকারে আমরা এর প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি। চলুন আমরা ট্রাফিক পুলিশ ভাইদের কাজের পরিবেশ তথা সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ঢাকা শহরের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করার চেষ্টা করি।
সর্বশেষ ছাত্রদের কাছে আমার একটি বিনীত আবেদন ও অনুরোধ তা হলো- আমরা কি ঢাকা শহরকে শব্দ দূষণমুক্ত নগরী ঘোষণা করতে পারি না। ছাত্র ভাইদের যে অদম্য শক্তি শুধু তাদের সহযোগিতার মাধ্যমেই আমরা পারি আমাদের এই প্রাণের শহরকে শব্দ দূষণমুক্ত করতে। চলুন ছাত্র-জনতা আমরা একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি যে, ঢাকা শহরে তথা দেশের সর্বত্র কোনো হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহৃত হবে না, অপ্রয়োজনে কোনরকম হর্ন ব্যবহার করা যাবে না।