আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না
Share on:
আল্লাহ ছাড় দেন : আল্লাহ তা’আলা পরম সহিষ্ণু ও মহাধৈর্যশীল। তাই তিনি ছাড় দেন, যাতে মানুষ সত্য ও সঠিক কর্মনীতিতে ফিরে আসে। আল্লাহ তা’আলার দু’টো গুণবাচক নাম হলো ‘আল হালীম’ অর্থাৎ মহাসহিষ্ণু ও আস সাবুর অর্থাৎ মহা ধৈর্যশীল।
দু’টি নামের তাৎপর্য হলো, যারা আল্লাহর চরম বিরোধিতা করে, তা সত্ত্বেও আল্লাহ তাদেরকে সাথে সাথে ধ্বংস করে দেন না।
কারণ তিনি মহাসহিষ্ণু ও মহাধৈর্যশীল। আমরা হযরত ইবরাহিম (আ:) এর সেই বিখ্যাত দু’আটি জানি, যাতে তিনি তাঁর মহান রবকে বলেছিলেন, “হে আমার রব! এই শহরকে শান্তি ও নিরাপত্তার শহর বানিয়ে দাও। আর এর অধিবাসীদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহ ও আখেরাতকে মানবে তাদেরকে সব রকমের ফলের আহার্য দান করো।”
জবাবে তাঁর রব বললেন : “আর যে মানবে না, দুনিয়ার গুটিকয় দিনের জীবনের সামগ্রী আমি তাকেও দেবো। কিন্তু সবশেষে তাকে আমি জাহান্নামের আযাবের মধ্যে নিক্ষেপ করবো এবং সেটি নিকৃষ্টতম আবাস।”(সুরা বাকারা:১২৬) আয়াতে আল্লাহর জবাবের প্রথম অংশটুকু “ছাড় দেয়া” এর অন্তর্ভুক্ত। শেষের অংশটুকু “ছেড়ে দেন না” এর অন্তর্ভুক্ত।
সুরা বাকারার ১২৪ নং আয়াতে হযরত ইবরাহিম (আ:)কে যখন মুসলিম জাতির নেতার পদে আসীন করা হয় তখন ইবরাহিম (আ:) বলেছিলেন, আমার সন্তানদের ব্যাপারেও কি একই হুকুম? জবাবে আল্লাহ তা’আলা বলেন, আমার এ হুকুম যালেমদের ব্যাপারে নয়। এই ফরমানটি সামনে রেখেই হযরত ইবরাহিম (আ:) বাকারার উল্লেখিত ১২৬ নং আয়াতে রিযিকের জন্য কেবলমাত্র নিজের মু’মিন সন্তান ও বংশধরদের জন্য দু’আ করলেন। কিন্তু মহান আল্লাহ জবাবে সংগে সংগেই তাঁকে জানিয়ে দিলেন, সত্যনিষ্ঠ নেতৃত্ব এক কথা আর রিযিক ও আহার্য দান করা অন্য কথা। সত্যনিষ্ঠ ও সৎকর্মশীল মু’মিনরাই একমাত্র নেতৃত্বের অধিকারী হবে। কিন্তু দুনিয়ার রিযিক ও আহার্য মু’মিন ও কাফির নির্বিশেষে সবাইকে দেয়া হবে। কাফির আল্লাহকে স্বীকার না করলেও আল্লাহ দুনিয়ার গুটিকয় দিনের জন্য তাকে আহার্য দিয়ে যাবেন। এটি তাঁর মহাসহিষ্ণুতা ও মহাধৈর্যশীল নামের ফল।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, “এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ, আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ সর্বদর্শী ও মহাসহিষ্ণু।” (আন নিসা : ১২) সুরা নিসায় মহান আল্লাহ মিরাসের সমুদয় বন্টন পদ্ধতি বর্ণনার পর আল্লাহর জ্ঞান ও সহিষ্ণুতার উচ্চারণ করার পেছনে এখানে দুটি কারণ রয়েছে। এক, যদি এ আইন ও বিধানের বিরুদ্ধাচারণ করা হয় তাহলে মানুষ আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচতে পারবে না। দুই, আল্লাহ যে অংশ যেভাবে নির্ধারণ করেছেন তা একেবারেই নির্ভুল। কারণ যে বিষয় মানুষের কল্যাণ ও সুবিধা তা মানুষের চেয়ে আল্লাহ ভালো জানেন। এই সংগে আল্লাহর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা গুণের কথা বলার কারণ হচ্ছে এই যে, এ আইন প্রবর্তনের ব্যাপারে আল্লাহ কোন কঠোরতা আরোপ করেননি। বরং তিনি এমন নীতি-নিয়ম প্রর্বতন করেছেন যা মেনে চলা মানুষের জন্য অত্যন্ত সহজ এবং এর ফলে মানুষ কোন কষ্ট, অভাব ও সংকীর্ণতার মুখোমুখি হবে না।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, “(হে নবী!) তাদেরকে বলো, তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমাদের যেসব শরীককে ডাকো কখনো কি তোমরা তাদেরকে দেখেছো? আমাকে বলো, তারা পৃথিবীতে কী সৃষ্টি করেছে? অথবা আকাশসমূহে তাদের কি শরীকানা আছে? তাদেরকে কি আমি কোন কিতাব লিখে দিয়েছি যার ভিত্তিতে তারা কোন সুস্পষ্ট প্রমাণপত্র লাভ করেছে? না বরং এ জালেমরা পরস্পর নিছক ধাপ্পা দিয়েই চলছে। আসলে আল্লাহই আকাশ ও পৃথিবীকে অটল ও অনড় রেখেছেন এবং যদি তারা টলটলায়মান হয় তাহলে আল্লাহর পরে দ্বিতীয় আর কেউ তাদেরকে স্থির রাখার ক্ষমতা রাখে না। নি:সন্দেহে আল্লাহ বড়ই সহিষ্ণু ও ক্ষমাশীল।”(সুরা ফাতির : ৪০-৪১)
আল্লাহ সমীপে এতোবড় অপরাধ করা হচ্ছে এবং এরপরও তিনি শাস্তি দেবার ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছেন না, এটা তাঁর নিছক সহনশীলতা ও ক্ষমাগুণের পরিচায়ক। পৃথিবীতে কত মানুষ যে ধাপ্পা দিয়ে চলছে, বিদ্রোহ করেছে, আল্লাহর সাথে তাঁরই সৃষ্টিকে শরীক করছে, আল্লাহ, রাসুল (স:), কুরআন ও দীন ইসলামের প্রতি বিদ্রুপাত্মক আচরণ করছে, তথাপি মহাসহিষ্ণু আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবীকে অটল ও অনড় রেখেছেন এবং তাদের জন্য পৃথিবীটা বাস উপযোগী করে রেখেছেন। যদি তারা টলটলায়মান হতো, তাহলে আল্লাহর পরে দ্বিতীয় আর কেউ নেই তাদেরকে স্থির রাখার ক্ষমতা রাখে। নি:সন্দেহে আল্লাহ বড়ই সহিষ্ণু। আল্লাহ সামান্য অসহিষ্ণু হলে এবং একটু টলটলায়মান পৃথিবীটাকে না থামালে কোন প্রাণই অবশিষ্ট থাকতো না। কিন্তু মহাসহিষ্ণু আল্লাহ তা’আলা তা করেন না।
তিনি আস সাবুর বা মহাধৈর্যশীল। এই মহাবিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টি সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন এক সত্তা এর শাসন কর্তৃত্ব চালাচ্ছেন। তিনি তাঁর বান্দাদের যেকোন বিদ্রুপাত্মক আচরণের জন্য সাথে সাথেই শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু মহান আল্লাহ সাথে সাথেই তাকে পাকড়াও করেন না। তবে কেউ যদি সীমা অতিক্রম করে যায় এবং কোন প্রকারেই বিপর্যয় সৃষ্টিতে বিরত না হয়, তখন তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের শাস্তি দেন। আল্লাহ বলেন, “এটা তোমাদের হাতের উপার্জন। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য জালেম নন।” (আলে ইমরান : ১৮২) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, আর আমি জনপদগুলো ধ্বংস করি না যতক্ষণ না সেগুলোর বাসিন্দারা জালেম হয়ে যায়।” (সুরা কাসাস : ৫৯) পৃথিবীতে তারা যে আল্লাহর সাথে বিদ্রুপাত্মক আচরণ করে চলেছে, তাদেরকে সেই আল্লাহই খাদ্য, পানি, আলো, বাতাস ও অক্সিজেন দিয়ে লালন-পালন করে যাচ্ছেন। তাঁর বিরোধিতার কারণে তিনি অসহ্য হয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছেন না। বরং তাদেরকে একটা সময় পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে যাচ্ছেন। ধৈর্যশীল গুণের সাথে সাথে গাফুর ও রাহিমও রয়েছে। তিনি অফুরান দয়া ও ক্ষমার আধার। যারা সত্যকে অপদস্থ করার জন্য এমন সব মিথ্যার পাহাড় সৃষ্টি করে তাদেরকেও তিনি তাঁর মহাধৈর্যের গুণে অবকাশ দেন এবং তাদের অপরাধের কথা শুনার সাথে সাথেই তাদের ওপর আযাব নাযিল করেন না। তোমরা নাফরমানি করতে থাকো, অপরাধ করতে থাকো, তাঁর দেয়া জীবিকায় প্রতিপালিত হয়ে তাঁরই বিধান অমান্য করতে থাকো। কিন্তু তিনি ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও ক্ষমার আশ্রয় নেন এবং তোমাদের উপলব্ধি করার ও সংশোধিত হবার জন্য ছাড় ও অবকাশ দিয়ে যেতে থাকেন। অন্যথায় তিনি যদি কঠোরভাবে পাকড়াও করতেন, তাহলে তোমাদের এ দুনিয়া থেকে বিদায় দিয়ে তোমাদের জায়গায় অন্য একটি জাতির উত্থান ঘটানো অথবা সমগ্র মানব জাতিকে ধ্বংস করে দিয়ে আর একটি নতুন প্রজাতির জন্ম দেয়া তাঁর পক্ষে মোটেই কঠিন ছিল না।
আল্লাহ ছেড়ে দেন না : আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রতিটি বান্দাকেই বিদ্রোহ ও সীমালংঘন থেকে ফিরে আসার সুযোগ দেন। যারা এ সুযোগকে কাজে লাগায়, তাওবা করে ফিরে আসে তাকে তিনি ক্ষমা করে দেন। আর যারা আল্লাহর মহাসহিষ্ণু ও মহাধৈর্যশীল নাামের অপব্যবহার করে অন্ধকারে ডুবে থাকে তাকে তিনি নির্দিষ্ট সময়ের পরে পাকড়াও করেন। তখন তাঁর পাকড়াও থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোন সুযোগ থাকে না। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “প্রত্যেক জাতির জন্য অবকাশের একটি সময় নির্দিষ্ট রয়েছে। তারপর যখন কোন জাতির সময় পূর্ণ হয়ে যাবে তখন এক মুহূর্তকালের জন্যেও তাকে বিলম্বিত বা ত্বরান্বিত করা হবে না।”(সুরা আরাফ:৩৪) আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আসলে তোমার রবের পাকড়াও বড় শক্ত।”(সুরা বুরুজ:১২) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন,“আর কাফেররা যেন কখনো মনে না করে যে, তারা নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে; নিশ্চয় তারা (আল্লাহকে) অপারগ করতে পারবে না।” (সুরা আনফাল : ৫৯)
অবকাশের সময় নির্দিষ্ট করার মানে এই নয় যে, প্রত্যেক জাতির জন্যে বছর, মাস, দিন ধরে একটি আয়ুস্কাল নির্দিষ্ট করা হয় এবং এ সময়টি শেষ হয়ে যেতেই তাকে অবশ্যিই খতম করে দেয়া হয়। বরং এর মানে হচ্ছে, প্রত্যেক জাতিকে দুনিয়ায় কাজ করার যে সুযোগ দেয়া হয়, তার কর্মকাণ্ডের মধ্যে ভাল ও মন্দের আনুপাতিক হার কমপক্ষে কতটুকু বরদাশত করা যেতে পারে, এ অর্থে তার কাজ করার একটি নৈতিক সীমানা চিহ্নিত করা হয়। যতদিন একটি জাতির মন্দ গুণগুলো তার ভাল গুণাবলীর তুলনায় ঐ আনুপাতিক হারের সর্বশেষ সীমার মধ্যে অবস্থান করতে থাকে ততদিন তাকে তার সমস্ত অসৎকর্ম সত্ত্বেও অবকাশ দেয়া হয়। আর যখন তা ঐ সর্বশেষ সীমানা পার হয়ে যায় তখন এ ধরনের অসৎ বৃত্তিসম্পন্ন ও অসৎ কর্মশীল জাতিকে আর কোন বাড়তি অবকাশ দেয়া হয় না। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আল্লাহ তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদের অবকাশ দেবেন। প্রকৃত ব্যাপার হলো, আল্লাহর নির্ধারিত সময় যখন এসে যায় তখন তা থেকে বাঁচা যায় না। আহ! যদি তোমরা তা জানতে।” (সুরা নুহ : ৪)
কারো কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছার পর থেকে মূলত: আল্লাহর অবকাশ শুরু হয়। যারা ঈমান গ্রহণ করার পর নেক আমল করে তারা মূলত: অবকাশকে সঠিক কাজে ব্যয় করে। তারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে না, তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা। আর যারা নিজের সীমানা অতিক্রম করে এমন একটি সীমানায় পদার্পণ করে যেখানে প্রবেশ করার অধিকার তার নেই। অর্থাৎ যারা বন্দেগীর সীমানা পেরিয়ে আল্লাহর রাজ্যে স্বেচ্ছাচারী মনোভাব ও আচরণ গ্রহণ করে, যারা আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মধ্যে থেকেও নিজেদের অহংকার ও শ্রেষ্ঠত্বেও ডংকা বাজায় এবং যারা মানুষের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে তারা সবাই বিদ্রোহী গণ্য হয়। তাদের ওপরই নির্দিষ্ট অবকাশের সীমা অতিক্রমের পর পরই আল্লাহর গযবের মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আবর্তিত হয়। অর্থাৎ আল্লাহর গযবে নিপতিত হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “এমন এক সময় আসা বিচিত্র নয় যখন আজ যারা অস্বীকার করছে, তারা অনুশোচনা করে বলবে, হায়, যদি আমার আনুগত্যের শির নত করে দিতাম! ছেড়ে দাও এদেরকে, খানাপিনা করুক, আমোদ ফূর্তি করুক এবং মিথ্যা প্রত্যাশা এদেরকে ভুলিয়ে রাখুক। শিগগির এরা জানতে পারবে।” (সুরা হিজর : ২-৩)
আল্লাহ মহা ধৈর্যশীল। তিনি মানুষের নাফরমানিকে ক্রমাগত ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার কারণে মাফ করতে থাকেন। তিনি আমাদেরকে সংশোধিত হওয়ার সুযোগ দেন। যাতে তারা সঠিক পথে ফিরে আসে। তাই বলে আল্লাহর এই গুণের সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করার অবকাশ নেই। এরও একটি সীমারেখা আছে। যে কয়েকবার নাফরমানি হয়ে গেছে, পিছনে ঠেলে দিয়ে সংশোধিত সঠিক পথে চলে আসা দরকার। আমাদের কর্মনীতি ও কর্মপন্থা খুব তাড়াতাড়ি পরিবর্তন করে ফিরে আসা প্রয়োজন। আল্লাহর এই সাবুর নামকে বেশী অপব্যবহার করা ঠিক নয়।