আন্দোলনের ‘ফসল’ যেন মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে চলে না যায়
Share on:
আপাত ‘অরাজনৈতিক’ কোটা সংস্কার আন্দোলনের চারাটি যে মহিরুহ হয়ে উঠবে, তা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, সরকার এবং দেশবাসীও সম্ভবত ধারণা করতে পারেনি। বস্তুত অহিংস আন্দোলন দমনে সরকার পূর্ববর্তী কৌশল প্রয়োগ করার ফলেই আন্দোলন ক্ষিপ্র ও তীব্র হয়ে ওঠে। আন্দোলনকে কার্যত সরকারই তুঙ্গে তোলে; নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে।
সাধারণ মানুষ এমনিতেই সরকারের ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডে ছিল ক্ষুব্ধ। আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি তাদের ভয়ের সংস্কৃতি থেকে মুক্তি দেয়। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণে আন্দোলনের চারাটি দ্রুতই মহিরুহ হয়ে ওঠে।
শেখ হাসিনা সরকার দিশেহারা হয়ে ক্ষমতাচ্যুতির আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী দিয়ে আন্দোলন দমন করতে চেয়েছিল। যদিও সেনাবাহিনী ও বিজিবি পুলিশের মতো সহিংসতার পথ অবলম্বন করেনি; প্রায় নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করেছিল। নিজ জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে সম্মত হয়নি সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর অবিতর্কিত অবস্থানের কারণে তখন স্লোগান পর্যন্ত উঠেছিল– ‘এই মুহূর্তে দরকার, সেনাবাহিনীর সরকার’। এটা স্পষ্ট, আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন নাও ঘটতে পারত, যদি সেনাবাহিনী সরকারের আজ্ঞাবহতার পরিচয় দিত। সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপেই শেখ হাসিনা দেশত্যাগে বাধ্য হন। অধিক রক্তপাত এড়াতে সেনাবাহিনীর সামনে এ ছাড়া বিকল্পও ছিল না।
যা হোক, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে; দেড় মাস পার হলো। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টা পদমর্যাদায় আসীন করেছে। এমনকি আন্দোলনকারী দু’জন সমন্বয়কারী মন্ত্রী পদমর্যাদায় উপদেষ্টা হয়েছেন। ছয়জনের বাকি চারজনও নানাভাবে সরকারে ভূমিকা রেখে চলেছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, আন্দোলনের মাঠ থেকে সরকারে গিয়ে সমন্বয়কের ভূমিকা তাদের ভাবমূর্তি ও ভবিষ্যতের জন্য কতটা ইতিবাচক হচ্ছে? নাকি বিতর্কিত হওয়ার পথ প্রশস্ত করেছে। যেমন আনসার বাহিনীর সচিবালয়ে অবস্থান ও ঘেরাও কর্মসূচিতে অপ্রীতিকর ঘটনা দেখার দায়িত্ব ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। তার বদলে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের লাঠিয়াল বাহিনীর মতো আনসারদের ‘মোকাবিলা’ করার বিষয় সবাই সুনজরে দেখেনি। বরং অতীতের পরম্পরা বলেই মনে হয়েছে। প্রশাসনে তদবির, বদলি, পদায়নসহ এখতিয়ারবহির্ভূত নানা কাজে আন্দোলনকারীদের অংশ নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এতে আন্দোলনকারীদের মধ্যেই বিভক্তি ও অসন্তোষের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ক্রিকেট বোর্ডের সভায় দেশবরেণ্য সাবেক ক্রিকেটার, কোচ, ম্যানেজারদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে দেখা গেছে, তিনি তাঁর আসনে বসে আছেন আর বরেণ্য মধ্যবয়সী সাবেক ক্রিকেটাররা ‘স্যার’ সম্বোধন করে দাঁড়িয়ে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন। ভিডিওটি টিভিতে প্রচারের পর দেশবাসী সেটি সুনজরে দেখেনি।
দেশের ভয়াবহ বন্যায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর গভীর আস্থায় দেশবাসী অকাতরে অঢেল নগদ অর্থ, জামা-কাপড়, খাদ্যসামগ্রী টিএসসিতে লাইন ধরে জমা দিয়েছে। অতীতে কখনও যেটা দেখা যায়নি। ত্রাণের অর্থ ত্রাণকার্যে ব্যয় হবে, এটিই স্বাভাবিক। অথচ জানা যায় ব্যাংকে ত্রাণের অর্থ জমা রাখার সংবাদ। এমনকি টিএসসিতে প্রচুর ত্রাণসামগ্রী এখনও স্তূপীকৃত। ত্রাণের টাকা তোলা নিয়ে নানা কথাও প্রচার হয়েছে। একজন সমন্বয়ক তো স্বীকার করেছেন, তাদের নাম ভাঙিয়ে কতিপয় এ ধরনের জঘন্য কাজ করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারে যদিও স্বনামধন্য কয়েকজন অর্থনীতিবিদ রয়েছেন; ব্যাংক খাতের অস্থিরতা এখনও কমেনি। আমানতকারীরা নিজেদের জমাকৃত অর্থ চাহিদা অনুযায়ী উত্তোলন করতে পারছেন না ব্যাংকে অর্থ না থাকার কারণে। বন্যা-পরবর্তী মানুষের দুর্দশা মোচনেও সরকারের ভূমিকা জোরালো দেখা যায়নি। বড় কথা, শিক্ষাঙ্গনে বিরাজনীতিকীকরণের ছায়া দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের চেষ্টায় ব্রিটিশ, পাকিস্তানি এবং বাংলাদেশের শাসক শ্রেণি বহু চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। বিরাজনীতিকীকরণের নতুন চেষ্টাও ধোপে টিকবে না। বিপরীতে তাদের বিতর্কিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মব ট্রায়ালের নামে যা ঘটছে, সেগুলো প্রকৃতই নৃশংস অপরাধ। ‘বিচার’ শব্দটি ব্যবহার করে নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলোকে ন্যায্যতা দেওয়ার পাশাপাশি তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা সামান্যতম বলার অবকাশ নেই। ঘটনা ঘটছে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন, তেমনি সমাজের নানা স্তরে। অনতিবিলম্বে এসব ঘৃণিত ঘটনা বন্ধের পাশাপাশি দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
একটি চরম ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের পর আমরা সামাজিক বৈষম্য নিরসনের প্রত্যাশী ছিলাম। আশা ছিল বিদ্যমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রের। সংস্কারের কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রেখে সংস্কারে সমষ্টিগত মানুষের ভাগ্য-বদল আশা করা যাবে না। দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের স্বপ্ন তবে কি অধরাই থেকে যাবে; আলোর মুখ দেখবে না! অতীতের ধারাবাহিকতায় ক্ষমতারই হাত বদল হবে শুধু; ব্যবস্থার নয়?
স্বীকার করতে হবে, কোটা সংস্কার আন্দোলন পরবর্তীকালে বৈষম্যবিরোধী নামকরণে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সাধারণ মানুষ তো বটেই, বামপন্থি অনেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সে আহ্বানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের অনেকে হতাশ ও নিরাশ। আন্দোলনের ফসল যদি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে চলে যায়, তার ফল ভালো হবে না। কাজেই, সাধু সরকার, সাবধান!