আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্থান পাচ্ছে ডেইরি বিষয়ে বাংলাদেশি গবেষকের বই
Share on:
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশি গবেষকদের উচ্চশিক্ষায় গবেষণাধর্মী বইয়ের সংখ্যা কম বললেই চলে। বিশেষায়িত উচ্চশিক্ষায় সেটি আরও কম। তবে দুগ্ধ শিল্প নিয়ে এ কে এম হুমায়ুন কবিরের একটি বই প্রকাশ পেয়েছে।
হুমায়ুন কবির চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তার বইটির নাম ‘মিল্ক অ্যান্ড ডেইরি ফুডস: নিউট্রিশন, প্রসেসিং অ্যান্ড হেলদি এজিং’ (সিআরসি প্রেস/টেইলর অ্যান্ড ফ্রান্সিস গ্রুপ, যুক্তরাষ্ট্র)।
বইটি ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের অনেক গবেষকের নজরে এসেছে। বাংলাদেশে সম্ভবত তিনিই একমাত্র লেখক, যিনি এই প্রকাশনায় ডেইরি ও ফুড সায়েন্স বিষয়ে সম্পূর্ণ বই এককভাবে প্রকাশ করেছেন। বইটিতে বিশেষভাবে দুধ ও ডেইরি খাদ্যসমূহের পরিচয়, প্রকার, পুষ্টিকর তথ্য, উৎপাদন প্রক্রিয়া ও দুগ্ধজাত পণ্যের গুণমান বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
বইটি সব পাঠকের সুবিধার্থে যুগোপযোগী তথ্য সহজবোধ্যভাবে সাজানো হয়েছে। বইটিতে পুষ্টিগত তথ্য, বৈশ্বিক উৎপাদন এবং ভোগপ্রবণতা, উৎপাদনপ্রক্রিয়া, ভৌত রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা অত্যন্ত বিস্তারিত এবং তথ্যবহুল। এতে বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্যের স্বাস্থ্য উপকারিতা নিয়েও গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া দই, চিজ, ক্রিম, মাখন, ঘি, গুঁড়া দুধ, কনডেন্সড মিল্ক, আইসক্রিম এবং ঐতিহ্যবাহী দুগ্ধজাত খাবারগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
আমার জানামতে, ইতিপূর্বে খুব কমসংখ্যক বইয়ে দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারের স্বাস্থ্য উপকারিতা এবং দুধের উপাদানগুলোর ইমিউনমডেলেশন নিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে, যা বইটিতে খুবই বিস্তারিত এবং গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বইটির বিষয়বস্তুগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বৈজ্ঞানিকভাবে সমর্থিত হওয়ায় এটি নিশ্চয়ই দুগ্ধশিল্পের জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ হবে।
‘মিল্ক অ্যান্ড ডেইরি ফুডস: নিউট্রিশন, প্রসেসিং অ্যান্ড হেলদি এজিং’ বইয়ের ইউনিক বৈশিষ্ট্যসমূহ: এক. লো-ফ্যাট ডেইরি পণ্য খাওয়ার সঙ্গে কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি বাড়ার যে কোনো সংযোগ নেই, তা সর্বশেষ গবেষণা ফলাফলের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এটিই প্রথম বই, যা দুগ্ধজাত খাবারের ব্যবহারকে উৎসাহিত করার জন্য স্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দুগ্ধবিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সঙ্গে একটি সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে।
দুই. ভ্যালু অ্যাডেড পণ্যের প্রক্রিয়াকরণ কৌশলগুলো সহজভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
তিন. বিভিন্ন ধরনের দুগ্ধজাত খাবার, তাদের উৎপাদন, পুষ্টিগুণ এবং স্বাস্থ্য উপকারিতার বিষয়ে সহজভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
চার. দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী দুগ্ধজাত খাবারসহ বিভিন্ন দুগ্ধজাত খাবারের মান নিয়ন্ত্রণ এবং কেমোথেরাপিউটিক মান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
পাঁচ. দই, চিজ, ক্রিম, মাখন, ঘি, গুঁড়া দুধ, কনডেন্সড মিল্ক, আইসক্রিম এবং প্রচলিত দুগ্ধজাত খাবারসহ বিভিন্ন দুগ্ধজাত খাবারের পুষ্টিগুণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বার্ধক্যে সুস্বাস্থ্যে (হেলদি এজিং) এসব খাবারের বৈজ্ঞানিক দিক থেকে পর্যালোচনা করা হয়েছে।
ছয়. জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে ডেইরি সেক্টরের ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে।
সাত. শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে বেশির ভাগ মূল বিষয় সচিত্র (২০২টি চিত্র ও ৮৬টি টেবিল) দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
আট. শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে প্রতিটি অধ্যায়ে লানিং অবজেকটিভের পাশাপাশি বাবল বক্স অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নয়. বইটি ডেইরি সম্পর্কিত ৩৪৫টি বৈজ্ঞানিক রেফারেন্স–সংবলিত আপ–টু–ডেট (অধিকাংশ রেফারেন্স ২০২০ সালের পরবর্তী সময়ের গবেষণা থেকে সংগৃহীত) তথ্য প্রদান করবে।
৩২৩ পৃষ্ঠাসমৃদ্ধ এ বই ১২টি অধ্যায়ে বিভক্ত। বইটি ই-বুক ও কাগজে মুদ্রিত হয়েছে। বইটির মূল্য ২০০ ইউএস ডলার (প্রায় ২৪ হাজার টাকার মতো)। দুধের পুষ্টি উপাদান, বিভিন্ন ধরনের দুধ (বিশেষত A1 এবং A2 মিল্ক), দুগ্ধজাত খাবার, স্বাস্থ্যকর বার্ধক্য এবং দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবারের স্বাস্থ্য উপকারিতা সবই বইটির প্রথম অধ্যায়ে তুলে ধরা হয়েছে। দুধ প্রক্রিয়াকরণের সময় ব্যবহৃত হিট ট্রিটমেন্ট দুধের সংরক্ষণকাল এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। বায়োঅ্যাকটিভ পেপটাইড গঠনের কারণে সংরক্ষণের সময় দুগ্ধজাত পণ্যের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেতে পারে।
ফলস্বরূপ, একটি দক্ষ প্রক্রিয়াকরণ এবং সংরক্ষণব্যবস্থা দুধের গুণমানকে উন্নত করতে পারে, যা দ্বিতীয় অধ্যায়ে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। অধ্যায় ৩ থেকে ১০ম পর্যন্ত বিভিন্ন ভ্যালু অ্যাডেড ডেইরি প্রোডাক্ট (দই, চিজ, ক্রিম, মাখন, ঘি, গুঁড়া দুধ, কনডেন্সড মিল্ক, আইসক্রিম) পুষ্টিমান, প্রক্রিয়াজাতকরণ, জৈব রাসায়নিক এবং মাইক্রোবায়োলজিক্যাল মান নিয়ন্ত্রণ এবং হেলদি এজিংসহ অন্যান্য বিষয় বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। স্বতন্ত্রভাবে অধ্যায় ১১–তে বিভিন্ন অঞ্চলের, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ঐতিহ্যবাহী বা দেশীয় দুগ্ধজাত খাবারের স্বাস্থ্য উপকারিতাসহ উৎপাদন পদ্ধতি আলোকপাত করা হয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী বা দেশীয় দুগ্ধজাত খাদ্য শত শত বছর ধরে এসব দেশে উৎপাদন ও বাজারজাত করা হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন (রসগোল্লা, চমচম, ক্ষীর, গোলাপজাম, কাঁচাগোল্লা, পেদা, বরফি, সন্দেশ, রসমালাই, বাটার মিল্ক, লাবান, লাচ্ছি)। অধ্যায় ১২ এই বইটির একটি অনন্য অংশ, যা ডেইরি খাত কীভাবে জাতিসংঘের (ইউএন) টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) অর্জনে অবদান রাখে, তা বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে। পরিশেষে, আমি আশা করি, এই বইটি সারা বিশ্বে সমাদৃত হবে। বিশেষত ডেইরি ও পুষ্টিবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী, গবেষক এবং পেশাজীবীদের শিক্ষা ও গবেষণায় আদর্শ রেফারেন্স বা টেক্সট বুক হিসেবে যেমন অবদান রাখবে, তেমনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে।