মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: মঙ্গলবার ৬, অগাস্ট ২০২৪

অসহযোগ আন্দোলন ও সরকারের পদত্যাগ

Share on:

প্রস্তুতি ছিল জামায়াত-শিবির বেআইনী ঘোষণার উপর বিশ্লেষণধর্মী একটি নিবন্ধ লিখার। পাঠকরা নিশ্চয়ই জানেন যে সরকার গত পয়লা আগস্ট তাদের তৈরি ২০০৯ সালের সন্ত্রাস বিরোধী আইনের ১৮(১) ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা শিক্ষা প্রশিক্ষণ ও উন্নত চরিত্রের প্রতীক ইসলামী ছাত্রশিবিরকে বেআইনী ঘোষণা করেছে।


সরকারের ধারণা চলমান গণআন্দোলন সংগঠন ও পরিচলনায় জামায়াত ও শিবির মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। তাদের বেআইনী ঘোষণা করা হলে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়বে এবং তাদের ক্ষমতার মসনদ নিষ্কন্টক হয়ে যাবে।

বেআইনি ঘোষণার সরকারি সিদ্ধান্ত জামায়াত-শিবিরের মধ্যে কোনও অনুকূল বা প্রতিকূল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে বলে মনে হয় না। তারা তাদের দ্বীনি দাওয়াতি ও তরবিয়াতি কাজ অব্যাহত রাখার ও চরিত্রবান মানুষ তৈরির কর্মসূচীকে বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালনকে কোনও জালেম সরকারের নিয়ন্ত্রণের বিষয় মনে করে না বলে মনে হয়। এই অবস্থায় জামায়াত নিষিদ্ধের উপর লেখার পূর্ব পরিকল্পনা স্থগিত করে করে চলমান আন্দোলন ও সরকারের করণীয় সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করা সমীচীন বলে মনে করছি। সরকারের অবিমৃষ্যকারিতায় শিক্ষার্থীদের কোটা ও বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন এখন সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত রোববার থেকে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছে। এতে গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ অভূতপূর্ব। গ্রামেগঞ্জে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের একটি অংশ সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে আন্দোলনকারীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আরেকটি অংশ হিংস্রতা ও বর্বরতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে আন্দোলনকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারা পুলিশকে সাথে নিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র দা, কুড়াল, কিরিছ, ছেনি প্রভৃতি নিয়ে গণহত্যা শুরু করেছে। কোথাও কোথাও সরকারি স্থাপনা থানায় আগুন লাগানো এবং পুলিশ সদস্যদের হত্যা করে তার দায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর চাপানোর অপচেষ্টাও চালাচ্ছে। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, পত্র-পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া পরিবেশিত প্রতিবেদন ও তথ্যচিত্রের কোথাও আন্দোলনকারীদের বাঁশের কঞ্চির আগায় লাগানোর প্লেকার্ড ও জাতীয় পতাকা ছাড়া আর কোন দেশীয় বা আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতে দেখা যায়নি। আগেই বলেছি গতকাল অর্থাৎ রোববার থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছে। অসহযোগের প্রথম দিনে সারাদেশ রণক্ষেত্র। রাজধানীসহ সারা দেশে সংঘর্ষ গুলি ও হামলায় এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ১০৪ জন নিহত হয়েছে। এ সংখ্যা আরো ৫ থেকে ১০ গুন বৃদ্ধি পাবার সম্ভবনা রয়েছে। সরকার ইতোমধ্যে নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য পুনরায় ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ইমো, ভাইবারসহ সামাজিক মাধ্যমে সব অ্যাপগুলোই বন্ধ। তারা বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে মানুষের মধ্যে আতংকের সৃষ্টি করে আন্দোলন থেকে বিরত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তাদের প্রচারিত গুজবের মধ্যে একটি গুজব হচ্ছে শেখ হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যশোর ও খুলনায় বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও ভারতীয় দুর্ধর্ষ ব্ল্যাক ক্যাট বাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ইত্যাদি, আন্দোলনকারীদের এই গুজব আরো উজ্জীবিত করেছে বলে মনে হয়, খ্যাতনামা মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস তাদের সর্বশেষ রিপোর্টে বলেছেন যে, সরকারি দমনপীড়নের মুখে বাংলাদেশে নতুন করে বিক্ষোভ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।

এই বিক্ষোভ ও আন্দোলন স্মরণাতীত কালের বৃহত্তম বিক্ষোভ। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক দলগুলো যে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি, সেই জাতি এখন ঐক্যবদ্ধ, স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষের বিভাজনের ধ্বংসাত্মক নীতি তাদের আটকাতে পারেনি। তারা সত্যিকারের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু’দিন আগেও আন্দোলনকারী ছাত্রদের সাথে আলোচনার জন্য গণভবনের দরজা খোলা বলে ঘোষণা দিয়ে তাদের সকল দাবি মেনে নেয়ার আশ^াস দিয়েছিলেন কিন্তু তার এই প্রতিশ্রুতি ও ঘোষণার ব্যত্যয় ঘটিয়ে তিনি নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার জন্য তার দলীয় গুণ্ডা ও সরকারের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছেন। অবস্থার দৈনন্দিন অবনতি ঘটছে। সারাদেশ এখন যে অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে তাতে অভিজ্ঞমহল একটি গণঅভ্যুত্থান ও সরকারের নির্মম পতনের আভাস লক্ষ্য করছেন। এই লক্ষণটি প্রধানমন্ত্রী, তার মন্ত্রিসভা, সরকারি দলের নেতানেত্রী কারু জন্যই মঙ্গলকর বলে মনে হয় না।

সরকারের আশংকা তারা ক্ষমতাচ্যুত হলে তাদের গত ১৫/১৬ বছরের অর্জন ও কুকীর্তির জবাব তাদের দিতে হবে। বিডিআর হত্যাযজ্ঞ, হেফাজতের নেতাকর্মীদের হত্যা ও গুম, প্রায় ২৫ লক্ষাধিক কোটি টাকার পুঁজি পাচার ব্যাংকসমূহ লুণ্ঠন, বিরোধীদলের হাজার হাজার নেতাকর্মী হত্যা ও ৬০ লক্ষাধিক লোকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে দৈহিক ও আর্থিক হয়রানি, বাড়িঘর, দোকানপাট ও তাদের সম্পত্তি দখল, নির্বাচনের নামে প্রহসন প্রভৃতি মোটা দাগের এই জুলুমগুলোর জবাবদিহিতাকে তারা ভয় পাচ্ছেন। এর পরিণাম সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল এবং ক্ষমতা ছাড়তে তারা নারাজ। তথাপিও আমার মনে হয় ক্ষমতা ছাড়া ও জাতির কাছে ক্ষমা ভিক্ষার সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। অবশ্য তীব্র গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। অর্ন্তবর্তীকালীন নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নতুন সরকার একটি নির্ধারিত মেয়াদ ৯০ দিন হোক বা ১২০ দিন, এর মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। একটা কথা বলা দরকার। আওয়ামী লীগের এই সরকারের পচন অনেক আগেই শুরু হয়েছে। তার দুঃশাসন অপশাসন ও দুর্নীতির বিষয়ে দেশের উচ্চ আদালতের সাবেক ও বর্তমান অনেক বিচারকই উল্লেখ করেছেন। প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান আওয়ামী লীগ সরকারকে বাজীকরের সরকার বলে আখ্যায়িত করেছেন। ষোড়শ সংশোধনী রায়ের পর্যবেক্ষণে আরেকজন প্রধান বিচারপতি নিম্নোক্ত নয়টি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।

১। সমাজে এখন ভাল মানুষের স্থান নেই, আমরা এখন এমন পঙ্গু সমাজে বসবাস করছি যেখানে আর ভাল মানুষ ভাল স্বপ্ন দেখেন না।

২। দেশে ব্যক্তিতন্ত্র ও আমিত্বের চাষ হচ্ছে। দুনিয়াতে কোন একজন ব্যক্তি দ্বারা কোন দেশ বা জাতি তৈরি হয়না। আমাদের দেশে তা করতে দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করা হচ্ছে।

৩। স্বপ্নের সোনার বাংলা চাইলে আমিত্বের আসক্তি এবং আত্মঘাতী উচ্চাভিলাষ থেকে মুক্ত থাকতে হবে।

৪। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও দাম্ভিকতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে, সুশাসন অভিধানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। রাষ্ট্র ও সমাজকে রক্ষা করা এবং অপকর্মে বাধা দেয়ার মতো কোনও নজরদারি প্রতিষ্ঠান বা ওয়াচডগ (ডধঃপযফড়ম) নাই।

৫। মেধা নয়, পেশীশক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমেই এখন সরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। রাজনীতি এখন মুক্ত নয়, এটি এখন বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। এই বাণিজ্যে এখন মূলধন ও কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই।

৬। গণতন্ত্র আমাদের কাছে এখন শ্লোগান। আমাদের পূর্ব পুরুষরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চেয়েছিলেন। আমরা তা করতে পারিনি, তার পরিবর্তে ক্ষমতাধর দৈত্যের জন্ম দিচ্ছি। চাঁদাবাজ, মাস্তান, ডাকাত ব্যভিচারী দুর্বৃত্তরা এখন সমাজপতি, সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে।

৭। সামরিক শাসকরা ক্ষমতার দখলদার, তারা দেশের মঙ্গল করতে পারেননি। দেশকে তারা দুবার ব্যানানা রিপাবলিকে পরিণত করেছিলেন।

৮। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও নির্বাচন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি। ফলে কমিশন খেলার পুতুলে পরিণত হয়েছে, সংসদ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ভোটারবিহীন নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে যারা সংসদে যাচ্ছেন তারা জনগণকে সত্যিকার অর্থে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছেন না।

৯। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দিলে তা হবে আত্মঘাতী।

সরকারের পদত্যাগের জন্য এগুলো যথেষ্ট বলে আমার ধারণা। নতুন সরকার আদালতের এসব পর্যবেক্ষণ বিবেচনায় নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে দেশের আত্মসচেতন মানুষ আশা করে।

দৈনিক সংগ্রাম