মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: বুধবার ২৫, সেপ্টেম্বর ২০২৪

‘অশান্ত পাহাড়’ আর কতদিন ‘পাহারা’ দিতে হবে?

Share on:

খুবই মর্মাহত, ব্যথিত। এই পাহাড়কে আমি চিনি না। একটি বাইক চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে দীঘিনালা হয়ে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি পর্যন্ত দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল। অথচ আমি উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালে দুর্বৃত্তের হাতে খুন হওয়া দুই বাঙালি ছেলের লাশ নিজ হাতে দাফন করে এলাকাকে শান্তিপূর্ণ রাখতে পেরেছিলাম।


বিভক্ত সমাজকে উস্কানি দিয়ে আরও হিংসাত্মক করা আর কতদিন চলবে? পাহাড়ে যা হচ্ছে, তা ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান চেতনার সঙ্গে যায় না।

জাতীয়ভাবে এখন বাম প্রগতিশীলরা সক্রিয় নয়। তাদের একটা অংশ বিগত সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে পাহাড়ের অধিকার আন্দোলনকে পেছন দিকে নিয়ে যায়। আজকে খোদ আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয় আক্রান্ত হলো। মসজিদের পর বৌদ্ধবিহার আক্রান্ত হলো। জাতিগত দাঙ্গা রূপ পাল্টে ধর্মীয় দাঙ্গায় পরিণত হচ্ছে। এখন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা কার পক্ষে কথা বলবেন?

অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংঘটিত মিছিলে কে বা কারা ঢিল বা গুলি ছুড়ল, এর জবাবে দোকানপাট ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে অন্যপক্ষ নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিল। এটা কেমনতর ক্ষমতা প্রদর্শন? প্রতিবেশীর সঙ্গে এই বীভৎস আচরণ কতদিন চলতে থাকলে ওরা বুঝতে পারবে, এটা এক জঘন্য কাজ? গুজবের কারণে রাতের বেলায় পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে পড়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধে আর কতদিন পাহারা দিতে হবে?

অন্ধকার রাতে গোলাগুলিতে নিরীহ লোকের প্রাণ গেল। এর মাধ্যমে অবরোধ বা ব্লকেডে পাহাড়কে অচল করার সুযোগ দিয়ে কার লাভ হলো? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাননীয় উপদেষ্টারা অশান্তি বাদ দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর বার্তা দিয়ে এলেন। সবাই মিলে একসঙ্গে থাকতে বললেন। হয়তো কিছুদিন শান্ত থাকবে। এর পর কী হবে?

দু’দিন পর এই নিপীড়িত পাহাড়ি বা বাঙালি জনতা হাটবাজারে এসে একে অন্যের পণ্য কেনাবেচা করবে; লেনদেন ও ভাব বিনিময় হবে। বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করে বাণিজ্য আর নানা কাজে সম্পৃক্ত হতে হবে।

প্রতিদিনের এই বাঁচার লড়াইয়ে একেক জনগোষ্ঠীর একেক অভিজ্ঞতা। জীবন এখানে বহু রঙের নয়, একরোখা; জীবিকা এখানে অনেক বৈষম্যে ভরা। যেমন থানচিতে এবার খাদ্য সংকট শুরু হয়েছে। বন্যায় আক্রান্ত খাগড়াছড়ির পাহাড়ে সমতল থেকে অনেক ত্রাণসামগ্রী এলো। সহযোগিতার সেতুবন্ধনে মিলনের সুর বেজে উঠতেই ভাঙনের মেঘ জমে উঠল। পাহাড়ি তারুণ্য হঠাৎ দুঃস্বপ্ন দেখল। বন্যা যেন আগুন ও রক্তের আগাম বার্তা দিয়ে গেল। ছাত্র-জনতার স্বপ্নকে অবাস্তব করে দিল। একটি হতাশার কালো ছায়ায় যেন পাহাড়ের আকাশ ঢেকে গেল। পাহাড়ের গাছ বিক্রি করে শহুরে বাঙালি বণিক বা ব্যবসায়ী গাড়ি বিক্রির দোকান দিয়েছে। কিন্তু পাহাড়ি গাছ মালিকের জীবনে কোনো পরিবর্তন হয় না। এ অঞ্চলে রেমিট্যান্স নেই। কারণ প্রবাসীর সংখ্যা কম। বড় কোনো শিল্পকারখানাও গড়ে ওঠেনি। ফলে ব্যবসায়ীরাও চাঁদাবাজির কারণে অনেক হয়রানির শিকার। অর্থাৎ কোনো পক্ষই এখানে বেশি লাভবান না। সাজেক, শুভলং, রেমাক্রি, বগা লেকের পর্যটন কি আগের মতো আনন্দের হাতছানি দেবে? পাহাড়ের সৌন্দর্যের মাঝে ছড়িয়ে আছে কত কান্নার ঝরনাধারা! পর্যটকদের অবাধ বিচরণ আশা করি। কিন্তু বাস্তবতা আমাদের বারবার বিভ্রান্ত করে। দুঃখে দিশেহারা হই। সমতলের অনুসন্ধিৎসু পর্যটক কি পাহাড়ের এই কান্না বুঝতে চাইবে?

এখানে নানা ভাগে বিভক্ত আঞ্চলিক দলগুলোর সশস্ত্র গোষ্ঠীকে নিরস্ত্র করতে রাষ্ট্র কি আরেকবার চুক্তিতে আবদ্ধ হবে? এ জন্য কি হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রয়োজন? নাকি অবিশ্বাসের দেয়াল ভেঙেই নতুন স্বপ্ন দেখা সম্ভব? সাবেক সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না করে মূলত জটিল রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে চলে গেল। এ জন্য বর্তমান প্রজন্মকে ভুগতে হবে। এ সংকট মোকাবিলা করতে জাতীয় রাজনৈতিক শক্তিগুলো কীভাবে এগিয়ে আসবে? সরকার কি আঞ্চলিকভাবে গড়ে ওঠা পাহাড়ি আর বাঙালি সংগঠনগুলোকে আলোচনার টেবিলে বসাতে উদ্যোগী হবে? তারা সবাই একে অন্যকে চেনে-জানে। আন্তরিকতা থাকলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভাবলে একে অন্যকে অবাঞ্ছিত করার সুযোগ নেই। একটি দায়িত্বশীল নেতৃত্বের এই রক্তাক্ত অধ্যায়কে অতিক্রম করে আলোকিত পাহাড়ের স্বপ্ন দেখানো অসাধ্য কিছু নয়।

আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর সব রকম বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার কাজে নিবেদিত হচ্ছে। এ সংস্কার কার্যক্রমে পাহাড়ও সম্পৃক্ত হোক। পার্বত্য জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদসহ সব প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত প্রতিনিধিকে দায়িত্ব দিতে উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। এই নির্বাচন শান্তি প্রতিষ্ঠার উপায় হয়ে উঠুক। অন্তর্বর্তীকালীন জেলা পরিষদে যোগ্য ও দুর্নীতিমুক্ত ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে জনগণের আস্থাভাজন শক্তি আসার সুযোগ দিক।

পাহাড়ি ছাত্ররা গণঅভ্যুত্থানকে সমর্থন করে নিজেদের অধিকারের কথা বলছে। নব্বইয়ের পরে এই প্রথম ছাত্ররা বৃহত্তর ঐক্যজোট গড়ে তুলতে পারল। এই ছাত্র ঐক্যকে বিতর্কিত না করে সরকারের কাজে লাগানো উচিত। কোনো উস্কানিতে পা দিয়ে দুই জনগোষ্ঠীকে আর কতকাল বিভক্ত রাখা হবে? জাতীয়ভাবে যদি তাদের দাবিদাওয়ার গুরুত্ব বোঝা যায় তাহলে ভবিষ্যতের পাহাড় বাংলাদেশের চেতনাকে ধারণ করবে। একটি সহনশীল ও গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব গড়ে উঠুক। ছাত্র সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ সাহসী কণ্ঠে বলে গেলেন পাহাড়ের বৈচিত্র্য ধরে রাখতে। সম্প্রীতির কথা তিনিও বলে গেছেন।

তাই বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়ে ভীত না হয়ে নিজস্ব অধিকারকে মুক্তভাবে উপভোগ করার সুযোগ দিন। রাষ্ট্র তাতে লাভবান হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অপেক্ষা করছে নতুন বাংলাদেশের চেতনাকে গ্রহণ করে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে।

দৈনিক সমকাল