অর্থনীতি চাঙা করতে দুর্নীতি ও পুঁজি পাচার রোধ করতে হবে
Share on:
গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে একটি ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে গেড়ে বসা শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণ সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে দেশের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন সরকার উৎখাতের এক দফা সংগ্রামে পর্যবসিত হয়েছিল ১৭ জুলাই। দেশের বিভিন্ন স্থানে লাশ পড়তে শুরু করে। অন্যদিকে তুমুল গতি সঞ্চারিত হয় প্রতিরোধ সংগ্রামে। যার পরিণামে ছাত্রলীগ মার খেয়ে মাঠ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হয় ছাত্রলীগ। এই সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে বিএনপি-জামায়াত ও ছাত্রদল-শিবির কোটা সংস্কার আন্দোলনকে তাদের সরকার উৎখাতের এক দফার সহিংস ধ্বংসযজ্ঞে রূপান্তর করতে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধারণা করা হচ্ছে, ১৭ জুলাই থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানের ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাযজ্ঞে মৃতের সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে।
এ প্রেক্ষাপটে ৮ আগস্ট বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে। দেশের জনগণের কাছে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা তাদের সততা, কর্মনিষ্ঠা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসিত। তাই তাদের দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, এবার বাংলাদেশে সত্যি সত্যিই একটি ‘সফল সামাজিক বিপ্লব’ সম্পন্ন হবে। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর দু’জন সমন্বয়কও উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আরও উল্লেখযোগ্য, ৫ থেকে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগে যখন দেশে লুটপাট, ধ্বংসযজ্ঞ, অরাজকতা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর ওপর জামায়াত-বিএনপির পরিকল্পিত প্রতিশোধ ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছিল, তখন ছাত্ররা ওগুলোতে অংশগ্রহণ তো করেইনি, বরং সংগঠিতভাবে ওগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। এমনকি পুলিশ বাহিনী যখন দেশের প্রায় সর্বত্র মনোবল হারিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছে তখন ছাত্রছাত্রীরা সংগঠিত হয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য বিভাগীয় নগরীতে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করেছে, থানা ও আবাসিক এলাকাগুলোতে পাহারা বসিয়েছে, সারাদেশে ভাঙচুরের ধ্বংসস্তূপ অপসারণ শুরু করেছে, পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করেছে এবং বিএনপি-ছাত্রদলের চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা শুরু করেছে। সাধারণ মানুষ ছাত্রছাত্রীদের এই অভূতপূর্ব কার্যকলাপ দেখে অভিভূত হয়ে তাদের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছে। অধ্যাপক ইউনূস দেশে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে কাজে নেমে পড়েছেন।
আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, এই দায়িত্ব সফলভাবে সম্পন্ন করার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত দুর্নীতি ও পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান। পুঁজি পাচারের মূল রয়ে গেছে দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণের লাগামহীন বিস্তারের মধ্যে। ঔপনিবেশিক আমলের পুঁজি পাচারকারীদের মতো বাংলাদেশের এই পুঁজি-লুটেরা ও পুঁজি পাচারকারীরা জাতির ‘এক নম্বর দুশমন’। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে পরাজয়ের পূর্বে তদানীন্তন বাংলা ছিল সারা ভারতবর্ষে সবচেয়ে সমৃদ্ধ কৃষি অর্থনীতি এবং কুটির শিল্পজাত পণ্য রপ্তানির বিশ্বখ্যাত অঞ্চল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেধড়ক পুঁজি লুণ্ঠন, পুঁজি পাচার এবং ঔপনিবেশিক লুটেরা শাসন-শোষণের শিকার হয়ে পরবর্তী ১০০ বছরে ঐ সমৃদ্ধ অর্থনীতি অবিশ্বাস্য বরবাদির অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছিল।
মার্কিন ইতিহাসবিদ ব্রুক অ্যাডামস জানাচ্ছেন, ১৭৫৭ সালের পর বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে কাঠের জাহাজে পুঁজি পাচার এত বিপুলভাবে বেড়ে গিয়েছিল যে, ওই জাহাজগুলোকে লন্ডন বন্দরে মাল খালাস করার জন্য প্রায় তিন মাস অপেক্ষা করতে হতো। এই লুণ্ঠন-পর্বকে ইতিহাসবিদরা ‘দি বেঙ্গল লুট’ নামে অভিহিত করে থাকেন। বলা হচ্ছে, ওই লুণ্ঠিত পুঁজি ইংল্যান্ডের ‘প্রথম শিল্পবিপ্লবে’ তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছিল।
১৮৫৮ সালে সরাসরি ব্রিটিশ শাসন চালু হওয়া সত্ত্বেও ঔপনিবেশিক লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচার থেকে মুক্তি মেলেনি বাংলার। উপরন্তু মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা নেমে এসেছিল ১৯৪৭ সালে, যখন পূর্ব বাংলা ব্রিটিশ প্রভুদের ভারত বিভাগের শিকার হয়ে আরেকবার অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পরের ২৪ বছর মেকি স্বাধীনতার আড়ালে আবারও চলেছিল বেধড়ক শোষণ, লুণ্ঠন, পুঁজি পাচার এবং সীমাহীন বঞ্চনা ও বৈষম্য। এই ২১৪ বছরের লুণ্ঠন, পুঁজি পাচার ও শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়ে রিক্ত-নিঃস্ব হওয়ার কারণেই ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশকে অভিহিত করা হয়েছিল ‘আন্তর্জাতিক তলাবিহীন ভিক্ষার ঝুলি’।
বর্তমানে এই ‘ঘৃণ্য জাতীয় দুশমন’ পুঁজি পাচারকারীরা প্রতিবছর গড়ে ১৫০০-১৬০০ কোটি ডলার পুঁজি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উদ্ঘাটিত হচ্ছে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পাকিস্তানি পুঁজি পাচারকারীদের ভাবশিষ্য এই নব্য পুঁজি পাচারকারীরা।
এ পর্যায়ে আমি স্মরণ করছি ২০০৭ সালে সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কার্যক্রম চালিয়েছিল তার সাফল্যকে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হাসান মসউদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ঐ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের একটি প্রবল ‘ঝাঁকুনি’ দিতে সক্ষম হয়েছিল বলে দুদকের পরবর্তী চেয়ারম্যান গোলাম রহমান মন্তব্য করেছিলেন। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হয়েই ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত দুদক অর্ডিন্যান্সটি সংসদে অনুসমর্থন (রেটিফাই) না করে দুদককে গোলাম রহমানের মতে, আবার ‘নখদন্তহীন ব্যাঘ্রে’ পরিণত করেছিলেন।
এক বুক হতাশা নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন জেনারেল হাসান মসউদ। আমার প্রস্তাব, ওই দুদক অর্ডিন্যান্সকে অবিলম্বে পুনঃপ্রবর্তন করা হোক। একই সঙ্গে প্রস্তাব করছি, দেশের সুপরিচিত দুর্নীতিবিরোধী আমলা মুনীর চৌধুরীকে দুদকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করা হোক। চট্টগ্রাম বন্দর, মিল্ক ভিটা, ডেসকো এবং দুদকের পরিচালক হিসেবে দুর্নীতি দমনে তাঁর সাহসী ভূমিকার জন্য তিনি জনগণের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। দুদকে মুনীর চৌধুরীর প্রশংসনীয় ভূমিকায় ভয় পেয়ে শেখ হাসিনা ওখান থেকে সরিয়ে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে তাঁকে বিজ্ঞান জাদুঘরের পরিচালক হিসেবে গত পাঁচ বছর ‘ডাম্প’ করে রেখেছেন।