মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: মঙ্গলবার ২০, অগাস্ট ২০২৪

অর্থনীতি এখনো সংকটে, নতুন গভর্নরের যত প্রত্যাশা

Share on:

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৩তম গভর্নর হয়েছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক এই কর্মকর্তার নিয়োগকে স্বাগত জানাই। তিনি অর্থনীতিরই মানুষ।


তারপরও তাঁর জন্য কাজটি সহজ হবে না। সুশাসনের অভাবে আর্থিক খাতে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা ঠিক করা কঠিন হবে। তবে আর্থিক খাতের সামগ্রিক চিত্রটি তিনি জানেন। সুতরাং কোথায় কখন কী করতে হবে, সেটি তাঁর অজানা নয়।

অর্থনীতি এখনো গভীর সংকটে। দুই বছর ধরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত কমেছে। ডলার-সংকটে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। দুই বছর ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষের জীবনযাত্রাকে অসহনীয় করে রেখেছে। খেলাপি ঋণ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। কয়েকটি ব্যাংককে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে বিশেষ ব্যবস্থায়। এসবই ঠিক করা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ।

কেন রউফ তালুকদারের মতো গভর্নর চাই না

সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার অর্থসচিব হয়েছিলেন ২০১৮ সালের জুলাই মাসে। আর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে অর্থমন্ত্রী হন আ হ ম মুস্তফা কামাল। ২০০০ সালে করোনা শুরু হলে যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন অর্থমন্ত্রী। তবে কিছুদিনের মধ্যেই অর্থনীতির প্রধান নীতিনির্ধারক হয়ে পড়েন অর্থসচিব। এতে আ হ ম মুস্তফা কামাল হয়ে যান অনুপস্থিত অর্থমন্ত্রী। পরে ২০২২ সালের জুলাই মাসে গভর্নরের দায়িত্ব পান আব্দুর রউফ তালুকদার। গভর্নর হয়েও অর্থনীতির সব সিদ্ধান্ত তিনিই নিতেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ও চালাতেন তিনি। সব সিদ্ধান্তই নিয়েছেন এককভাবে, সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। যদিও অর্থনীতির সংকট মেটাতে পারেননি তিনি।

■ আগের গভর্নর সব সিদ্ধান্তই নিয়েছেন এককভাবে, সরাসরি শেখ হাসিনার নির্দেশে।

■ পাচারকারী ও ঋণখেলাপিরা শাস্তি পাচ্ছেন, এই বার্তা দেওয়াটা খুবই জরুরি।

■ ব্যাংক খাতে পরিবারতন্ত্র ভেঙে দেওয়া হবে নতুন গভর্নরের আরেকটি কাজ।

■ ব্যাংক খাতের আরেকটি দুষ্টক্ষত হচ্ছে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস।

আব্দুর রউফ তালুকদারের আগের ১১ জন গভর্নর সবাই দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে ছিলেন না। অনেকেই শক্ত হাতে দায়িত্ব পালন করেছেন, কেউ কেউ আমলাতন্ত্র ধ্যানধারণার বাইরে যেতে পারেননি, কেউবা জনপ্রিয়তার মোহে আটকে ছিলেন। তবে তাঁদের কেউই বিশেষ কোনো ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর প্রতিনিধি ছিলেন না। কিন্তু আব্দুর রউফ তালুকদার ছিলেন নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। তাদের মধ্যে অন্যতম নাম এস আলম গ্রুপ।

তার ন্যায়-অন্যায় সব ধরনের চাহিদা পূরণ ছিল সাবেক গভর্নরের অন্যতম কাজ। অন্যায়ভাবে নানা সুবিধা দিয়েছেন দেশের খেলাপি ঋণ তৈরির অন্যতম কারিগর সালমান এফ রহমানকে। এ তালিকায় আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের আরেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিস শরাফাতের নামটিও আসে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অতিঘনিষ্ঠ এসব ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কেবল গভর্নর নয়, কোন ব্যাংকে কে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হবেন, তা-ও ঠিক করে দিতেন। আগে এসব ব্যবসায়ীর নানা অপকর্মের সঙ্গী ছিলেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর সুর চৌধুরী ও সাবেক নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম। ‘এস আলমের লোক’—এ রকম কিছু কর্মকর্তা এখনো আছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। সুতরাং ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে নিজের ঘরেও হাত দিতে হবে নতুন গভর্নরকে।

দৃশ্যমান শাস্তি দিন

এখনো বেশ কিছু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছে এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দক্ষ বলে সেসব ব্যাংক ভালোভাবে চলছে। এর ফলে পুরো ব্যাংকিং খাতে ধস নামেনি। তবে সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতের অবস্থা নাজুক।

বেশ কিছু ব্যাংক বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। ব্যাংক দখলের এক অসুস্থ প্রতিযোগিতাও শিখিয়েছে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার। একের পর ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। তাতে কেউ শাস্তিও পাননি। বেসিক ব্যাংকের কেলেঙ্কারির হোতা শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে গ্রেপ্তার করে অর্থ আদায় করতে পারলে সেটি হবে এই সরকারের অন্যতম বড় কৃতিত্ব।

আর যাঁরা নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে পাচার করেছেন, অন্যত্র ব্যয় করেছেন, তাঁদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করাটাও হবে বড় কাজ। দেশে অনেক ভালো উদ্যোক্তা আছেন। তাঁরা ঋণ নেন, নিয়মিত পরিশোধ করেন। আরেক ধরনের উদ্যোক্তা আছেন, তাঁদের কাজ মূলত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করা। তাঁদের কারণেই বেড়েছে খেলাপি ঋণ, যার পরিমাণ এখন ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা।

তবে আহসান এইচ মনসুর আগে নিজেই বলেছেন, প্রকৃত খেলাপির পরিমাণ আরও অনেক বেশি, যা নানাভাবে আড়াল করে রাখা হয়েছে। এখন তাঁর কাছে প্রত্যাশা, তিনি প্রকৃত খেলাপি ঋণের একটি হিসাব ও ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করবেন। একই সঙ্গে প্রভাবশালী ঋণখেলাপিদের নানাভাবে সুবিধা দেওয়ার যে নীতি আওয়ামী লীগ করেছিল, তা-ও সব বাতিল বা সংশোধন করার উদ্যোগ নেবেন।

টাকা পাচারকারীদের ধরতে ও খেলাপি ঋণ কমাতে সরকার যে আন্তরিক, সেই বার্তাটাও দিতে হবে গভর্নরকে, সরকারকে। এ জন্য ঋণখেলাপিদের দৃশ্যমান শাস্তি দিতে হবে। পাচারকারী ও ঋণখেলাপিরা শাস্তি পাচ্ছে, এই বার্তা দেওয়াটা খুবই জরুরি।

পরিবারতন্ত্র ভেঙে দিন

ব্যাংক খাতে পরিবারতন্ত্র ভেঙে দেওয়া হবে নতুন গভর্নরের আরেকটি কাজ। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যাংকমালিকদের খুশি রাখতেই একই পরিবারের তিনজনকে টানা ৯ বছর পরিচালক পদে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এ আইনের সংশোধন দরকার। ব্যাংক খাতের আরেকটি দুষ্টক্ষত হচ্ছে মালিকদের তৈরি করা সংগঠন, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস।

প্রভাবশালী কয়েকজন সংগঠনটির নেতৃত্ব দখল করে থাকেন। প্রকাশ্যে চাঁদা দেওয়ারও একটি ব্যবস্থা তাঁরা তৈরি করে রেখেছেন। সাধারণত কোনো দাবি আদায়ের আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ত্রাণ তহবিলের নামে অর্থ দেন, ছবি তোলেন। ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করা হয় এভাবে অর্থ দিতে। এই সংগঠনের সদস্য নিজেরাই আত্মসমালোচনা করলে গভর্নরের জন্য কাজটা সহজ হয়। তাহলে ভবিষ্যতে হোটেলে বসে সুদহার ঠিক করতে হবে না। কাজটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের, তারাই করুক।

অর্থনীতির কঠিন এক সময়ে ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) দায়িত্ব নিয়েছিলেন আইএমএফেরই সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ রঘুরাম রাজন। যোগ দেওয়ার ঠিক আগে তিনি ছিলেন সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা।

তিনি লিখেছিলেন, ‘নর্থ ব্লকে থাকাকালে এসব ঘোর খামখেয়ালিপনার মধ্যে থেকে যখন দেখলাম যে ভারতীয় মুদ্রাকে স্থিতিশীল করবার একের পর এক সব প্রচেষ্টাই মুখ থুবড়ে পড়ছে, তখন বুঝলাম যে এবার সম্পূর্ণরূপে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় এসে গিয়েছে।

এই বার্তাটিই আমি দিতে চাইলাম যে ভারতে রিজার্ভ ব্যাংকের মতো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা সংসদ অচল থাকলেও সংস্কারপ্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে এবং বিনিয়োগকারীরা যেন ভারতকে খরচের খাতায় ঠেলে না দেন।’

আহসান এইচ মনসুর ব্যাংক খাত ঠিক করতে সম্পূর্ণরূপে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, এটাই সবার প্রত্যাশা। এ জন্য দ্রুততার সঙ্গে একটি ব্যাংক কমিশন বা টাস্কফোর্স গঠন করলে তাঁর জন্য কাজটা অনেক সহজ হবে।

প্রথম আলো