অর্থনীতির জৌলুসগুলো হারিয়ে যাচ্ছে
Share on:
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পোশাক খাতে তেমন কোনো সুখবর নেই। পোশাক খাতে যা আছে সেটা আগের মতোই। এটি রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য হতাশাব্যঞ্জক বলে আখ্যা দিয়েছে রপ্তানিমুখী তিন সংগঠন-বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ। কারণ, তৈরি পোশাক খাতের কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেওয়া প্রস্তাবগুলো বাজেট প্রস্তাবে প্রতিফলিত হয়নি।
তবে শুধু পোশাক খাত নয়, দেশের পুরো রপ্তানি ব্যবস্থার জন্যই একটি অশনিসংকেত উঁকি দিচ্ছে। সেটা হচ্ছে, চলতি বছরের মে মাসে ১৫ শতাংশ রপ্তানি কমেছে। এটা অবশ্যই চিন্তার বিষয়। এভাবে দেশের রপ্তানি কমতে থাকলে রিজার্ভ নিয়ে একটা শঙ্কা তৈরি হবেই। কারণ, বৈদেশিক মুদ্রায় রিজার্ভ আসার একটি প্রধান উৎস হচ্ছে রপ্তানি, আরেকটি রেমিট্যান্স। আর তৃতীয় উৎস হচ্ছে ফরেন ইনভেস্টমেন্ট বা বৈদেশিক বিনিয়োগ। বলতে গেলে দেশে বর্তমানে কোনো বৈদেশিক বিনিয়োগ হচ্ছে না।
এর সঙ্গে যদি রপ্তানিও নিচের দিকে নেমে যায়, তাহলে আমাদের রিজার্ভে তো টান পড়বেই। আমাদের রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে কিনা আমার জানা নেই। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, রপ্তানি ৬০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পৌঁছাবে। তবে বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রপ্তানির এ স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।
আমাদের রিজার্ভ কমছে, আশানুরূপ রপ্তানি করা যাচ্ছে না, দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ হচ্ছে না, রেমিট্যান্স প্রবাহেও ঘাটতি দেখা দিচ্ছে-এ সবকিছুই হয়েছে কিছু ভুল পদক্ষেপের কারণে। আর এ ভুলগুলো এখন হয়নি। এ ভুলগুলো হচ্ছে গত ৫-৭ বছর আগে থেকেই। যখন বৈদেশিক মুদ্রায় বড় বড় ঋণ নেওয়া হয়েছে, তখন চিন্তা করা উচিত ছিল ৫-৭ বছর পর আমরা এ ঋণ সুদ-আসলে পরিশোধ করতে পারব কিনা।
ভাবা উচিত ছিল, আমাদের রেমিট্যান্স ও রপ্তানি কি যথেষ্ট হবে এ ঋণ পরিশোধে? অথবা এ ঋণ পরিশোধে আমাদের রিজার্ভ কি যথেষ্ট হবে? না, এ বিষয়গুলো নিয়ে কেউ চিন্তা করেননি। কারণ সেসময় আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল, সবাই আমাদের সেধে সেধে ঋণ দিয়েছে। আগামীতে এভাবে কি আর ঋণ পাব? আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা যদি এভাবে অবনতির দিকে নামতে থাকে, তাহলে তো কেউ আর আমাদের ঋণ দেবে না।
আইএমএফকে ডেকে আনাটাও আমাদের উচিত হয়নি। কারণ আইএমএফকে ডেকে আনা মানে খাল কেটে কুমির আনা। অভিজ্ঞতার আলোকে দেখেছি, এই আইএমএফ প্রতিটি জায়গায় একই রকম প্রেসক্রিপশন দেয়। যারা এদের ফাঁদে পড়েছে, তারা কেউই তাদের অর্থনীতিতে ঋণের ঝামেলা থেকে মুক্তি পায়নি। ঋণের মধ্যে থেকে আবার ঋণের মধ্যেই তারা ডুবে গেছে।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে-Poor people borrow in poverty than dying poverty. আরেকটি কথা আছে-A person is poor because he is poor. A country is poor because it is poor. সুতরাং কাপড় অনুযায়ী আমাদের জামা সেলাই করা উচিত। মানে আয় অনুযায়ী ব্যয় করা উচিত। কিন্তু আমরা এ প্রবাদ বাক্য থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছি। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। এটাই হচ্ছে আমাদের দুঃখের কারণ।
আমি সেদিন চ্যানেল আইয়ের তৃতীয় মাত্রায় বলেছি, আমরা আমাদের ভালো অর্থনৈতিক দিনগুলো পেছনে ফেলে এসেছি। টানেলের শেষে এখন আর আলো দেখা যাচ্ছে না। এ আলো হয়তো দেখা যেত, যদি একটা অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটা নির্বাচিত সরকার থাকত। তাহলে বাইরের লোকদের আমাদের প্রতি আস্থা বাড়ত। দেশে বিনিয়োগ আসত।
সেটা তো আর হয়নি। সুতরাং ভালো কিছু প্রত্যাশা করা এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন মানুষও স্বার্থপর হয়ে গেছে। কে কিভাবে নিজেকে বাঁচাবে, নিজের আখের গোছাবে এ ধান্দায় সবাই ব্যস্ত। মানুষের মধ্য থেকে দেশপ্রেম উঠে গেছে। দেশ এগোবে কিভাবে! ব্যাংকের টাকা বলতে গেলে হরিলুট হচ্ছে। যে যেভাবে পারছে, নামে-বেনামে ঋণের মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা কবজা করছে। এ টাকা অনেকে বিদেশে পাচারও করছে। এসব যেন দেখেও দেখার কেউ নেই। জনতা ব্যাংকের ক্লাসিফায়েড লোন একটা প্রাইভেট কমার্শিয়াল ব্যাংকের টোটাল ডিপোজিটের সমান। অতীতে বড় বড় শিল্পপতিরা এ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন।
আরেকটি কথা না বললেই নয়। তিন বছর আগে থেকেই নাকি মূল্যস্ফীতি রোধ করা বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি কতটা নিয়ন্ত্রণ হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। বিদেশিদের দেখে দেখে যখন থেকে বাজারে সুদের হার বৃদ্ধি করে মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হয়েছে, তখন থেকেই মূল্যস্ফীতি না কমে বরং আরও বেড়েছে। সুতরাং সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে সুদের হার বৃদ্ধির বিরুদ্ধের লোক।
অনেকেই বলছেন-এ অনেকের মধ্যে আমাদের অর্থনীতিবিদরাও আছেন-বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়বে। মানে রেমিট্যান্স আসা বৃদ্ধি পাবে। সেটি হয়েছে কি? না, হয়নি। বরং আগে যেটা ছিল, তা থেকে আরও নিচে নেমে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার তৈরিতে ম্যানেজ ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আল্লাহ মালিক কাজমী নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর ছিলেন, তার সময়ে এটা চালু ছিল।
কতগুলো প্রধান বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে ডলারের যে তারতম্যের হার, সেটা হিসাব করে ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট নির্ধারণ করা হতো। তখন এটাকে একটা রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট বলা হতো। সেটির ভিত্তিতে আমরা ফরেন এক্সচেঞ্জ রেট ঠিক করতাম। মানে মুদ্রা বিনিময় হার ঠিক করতাম। সেসময় এ মুদ্রা বিনিময় হার ছিল ৮৫-৮৭ টাকার মধ্যে। দেশের অর্থনীতির জন্য এ রেটটি ছিল একটা আদর্শ রেট। এ বিনিময় হারকে যখনই বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তখনই বিশাল অঙ্কের অর্থ পাচার হয়েছে।
বর্তমানে এ রেট ১১৭ টাকা। আগে বিদেশ থেকে যে জিনিস ৮৫ টাকায় কিনতাম এখন সেটা ১১৭ টাকায় কিনতে হচ্ছে। সুতরাং, এখন যা কিছুই বিদেশ থেকে আনি না কেন, সেটা উচ্চমূল্যেই আমাদের আনতে হবে। সুতরাং মূল্যস্ফীতি তো বাড়বেই। আর এর কিছুদিন পরই বাড়ানো হয় জ্বালানির দাম। এতে মূল্যস্ফীতি কি কমবে? অর্থমন্ত্রী মহোদয় কি এর জবাব দিতে পারবেন?
সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর কথাটা আমি শুনিনি, শুনেছি অন্য একজনের কথা। তিনি মূল্যস্ফীতির মোটামুটি একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, একটি দেশের অর্থনীতি একটা উচ্চ প্রবৃদ্ধিতে গেলে মূল্যস্ফীতি হয়। এটা অর্থনীতির জন্য একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তার এ কথা অবশ্যই যৌক্তিক। কারণ ইকোনমি সায়েন্সে এটা লেখা আছে। আমার মনে হয়, তিনি হয়তো কোনো একটা পর্যায়ে অর্থনীতি পড়েছেন। কিন্তু তিনি এটা জানেন না যে, অর্থনীতিতে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি থেকে এটা পাঁচে নেমে এলে কেন মূল্যস্ফীতি হবে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থাকলে ওটার বাই প্রোডাক্ট হিসাবে মূল্যস্ফীতি হবেই। প্রশ্নটি হচ্ছে, অর্থনীতির উচ্চ প্রবৃদ্ধি থেকে আমরা অনেক নিচে চলে এসেছি। এখন মূল্যস্ফীতি কমে না কেন? ইতোমধ্যে ইউরোপে সুদের হার কমানো শুরু হয়েছে। অথচ আমাদের দেশে সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। কিছুদিন আগেও সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। এখন প্রশ্ন হলো, এ বাড়তি সুদে ঋণ নিয়ে দেশে কি বিনিয়োগ হবে? সোজা কথায় বলতে গেলে, ১৫ শতাংশ ঋণ নিয়ে কেউ এখানে ইন্ডাস্ট্রি বানাবে না।
আরেকটি বিষয় না বললেই নয়। সেটা হচ্ছে, সরকার সাড়ে ১২ শতাংশ সুদ দিয়ে বন্ড বিক্রি করছে। সরকার নিজেই তো উচ্চ সুদের ঋণের সবচেয়ে বড় গ্রাহক। তাহলে ঋণের সুদহার কিভাবে কমবে? ওই সংবাদ সম্মেলনে সরকারের পক্ষ থেকে বলা উচিত ছিল, আমরা সরকারি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করছি। তাহলে তাদের ক্রেডিট দেওয়া যেত। কিন্তু ইচ্ছামতো ঘাটতি বাজেট বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর বিষয়টি কতটা বাস্তবভিত্তিক, তা বলাই বাহুল্য। অবশ্য তারা বলেছেন, আমরা স্বল্প আয়ের লোকদের কম দামে পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা নিচ্ছি।
মানে ওএমএসের অনেকগুলো ট্রাক আবার রাস্তায় নামানো হবে। আর এই ওপেন মার্কেট সেলের মানে হলো, গরিব মানুষদের ওএমএসের ট্রাকের পেছনে আবার লাইনে দাঁড় করানো। এটা একটা উন্নয়নশীল দেশের জন্য খুব একটা শুভ লক্ষণ নয়। বিষয়টি যদি এমনই হয়, তাহলে আমরা যে মধ্যশ্রেণি বা উঠতি ইকোনমিতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছি, সেটা তো পেছনে পড়ে যাবে।
সরকার ডিজিটাল সিস্টেম বাড়াচ্ছে আবার মোবাইল ফোনে টকটাইম ও ইন্টারনেট দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাহলে ডিজিটাল সিস্টেমে গতি আসবে কিভাবে? তারা তাদের রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য এ কাজগুলো করে থাকে। অর্থনীতি যদি স্লো-ডাউন হয়, তাহলে রাজস্ব সংগ্রহ তো বৃদ্ধি পাওয়ার কথা নয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হলে রাজস্ব সংগ্রহ অনেক সহজ হয়। কারণ এতে করে ভ্যাট আর করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স বাড়ে। কিন্তু প্রবৃদ্ধি যদি ৫ শতাংশে নেমে আসে, তাহলে তো আর সেটা সম্ভব নয়।
অবশ্য অর্থমন্ত্রী ৬-এর অধিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। আমি মনে করি সেটা হবে না। কারণ এর জন্য যে বিনিয়োগ দরকার, সেটা কোনো জায়গা থেকে আসছে না। সরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে গত ১০ বছরে অনেক চেষ্টা করা হয়েছে অর্থনীতিকে চাঙা রাখার। সে যুগও শেষ হয়ে যাবে। কারণ সরকারি বিনিয়োগের মধ্যে ৭০ শতাংশই ছিল বিদেশি ঋণ। এখন তো আর সেই বিদেশি ঋণ পাব বলে মনে হয় না। কারণ সেই সক্ষমতা আমরা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলেছি। তাহলে তো অর্থনীতির জৌলুসগুলো হারিয়ে যাবে নিশ্চিতভাবেই।
আবু আহমেদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ