অর্থনীতির ক্ষত সারাতে সংঘর্ষ নয়, শান্তি প্রয়োজন
Share on:
টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গণ-আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। এ ঘটনায় দেশজুড়ে ছাত্র-জনতার ভেতরে ছিল বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। লাখ লাখ মানুষ রাজপথে আনন্দ মিছিল করেছে।
কিন্তু এ চিত্রপটের বিপরীতে আছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চিত্র। বণিক বার্তার প্রতিবেদন জানাচ্ছে, শেখ হাসিনা পদত্যাগের আগে ও পরে সারাদিনব্যাপী পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) বিভিন্ন থানাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালানো হয়েছে। এ সময় আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালালে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। গুলি, হামলা, অগ্নিসংযোগ ও গণপিটুনিতে রাজধানীসহ ১৪ জেলায় অন্তত ১২০ জন নিহত হন। আহত হয়েছেন কয়েক সহস্রাধিক। আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, এসব সংঘাত-সংঘর্ষের সঙ্গে তাদের কেউ জড়িত নন, দুর্বৃত্তরা এর জন্য দায়ী। দ্রুত তাদের আইনের আওতায় আনারও আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সীমিত পরিসরে। সময় ও ঘটনার পরিক্রমায় এ আন্দোলন গতি সঞ্চার করতে থাকে এবং একপর্যায়ে ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের রূপ নেয়। একটাই দাবি ছিল আন্দোলনকারীদের, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ। এ দাবি পূরণ হয়েছে। এরই মধ্যে গতকাল সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেছেন রাষ্ট্রপতি। গঠন হতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
সরকার গঠন প্রসঙ্গে বক্তব্য প্রদানকালে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ভাংচুর, হত্যা, সংঘর্ষ ও মারামারি থেকে জনগণকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। কিন্তু বাস্তবতা হলো সংঘর্ষ-সহিংসতা থামেনি। পরিস্থিতি এখনো অরাজক অবস্থায় রয়েছে। এখানে প্রশ্নের উদ্রেক হয় দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে। যেখানে সেনাপ্রধান তার বক্তব্যে সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আস্থা রাখার কথাও উল্লেখ করে বলেছিলেন যে তারা সব দায়দায়িত্ব নেবেন দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার।
১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ছয়জন নিহত হলে এ আন্দোলন বেগবান হয়। এর পর থেকে সংঘাত-সংঘর্ষ ও নিহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। দেশের এ সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির সবচেয়ে বিরূপ প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। ১৮-২৩ জুলাই পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবা তৎকালীন সরকার পুরোপুরি বন্ধ রাখায় ডিজিটাল খাতভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও আর্থিক সেবা অচল হয়ে পড়ে। অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। কারফিউ চলাকালীন পণ্যবাহী যান চলাচল বন্ধ ছিল। যে কারণে বাজারে বিভিন্ন পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। যার প্রভাবে বাড়তে শুরু করে নিত্যপণ্যের দাম। চট্টগ্রাম বন্দরে রফতানি বাণিজ্যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। খালাস করা যায়নি আমদানি পণ্যও। এখনো দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার কারণে বাংলাদেশ রেলওয়ের পণ্যবাহী কনটেইনার ট্রেন বন্ধ থাকায় বিপাকে আছে চট্টগ্রাম বন্দর। সেখানে দুই হাজারের অধিক কনটেইনার আটকা পড়ে আছে। দ্রুত কনটেইনার ট্রেন চালু করা না হলে ধারণক্ষমতা ও পরিচালন ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়বে বলে আশঙ্কা করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
আবার ঘোষণার মাধ্যমে প্রায় সব কারখানা সিলগালা করা হয়েছিল চলমান পরিস্থিতিতে। এতে উৎপাদন ও সরবরাহে ভাটা পড়ে। জ্বালানি সরবরাহেও বিঘ্ন ঘটে; আতঙ্কে বন্ধ হয়ে যায় অসংখ্য পেট্রল পাম্প। ব্যাংক বন্ধ থাকায় সারা দেশে নগদ টাকার সংকট প্রকট রূপ ধারণ করে। আর আয়ের অভাবে নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে নেমে এসেছিল বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়।
এক কথায় পুরো দেশের অর্থনীতিতে প্রায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়জুড়ে। বর্তমানে সেই আন্দোলন শেষ হলেও দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা হয়নি। এমনিতেও দেশের অর্থনীতির ক্ষত অনেক বড়। এ অবস্থায় সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর না হলে তা অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনবে না। উল্টো ক্ষত আরো বাড়িয়ে তুলবে।
দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকসমূহ রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, রফতানি বাণিজ্য, কর্মসংস্থান প্রভৃতি নিম্নমুখী গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে। ব্যাংক খাতের অবস্থা সবচেয়ে বেশি শোচনীয়— তারল্য সংকট, লাগামহীন খেলাপি ঋণ, মন্দ ঋণ, ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের অনাস্থা। বাজার ব্যবস্থাপনায় নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরজুড়ে সারা দেশে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। বিশৃঙ্খল অবস্থা দেশের জাতীয় পরিসংখ্যানেও। প্রকৃত তথ্য নিয়ে বরাবরই পাওয়া যাচ্ছে বড় ধরনের ব্যবধান। সব ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতি। এত সব চ্যালেঞ্জের মধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে তৈরি হওয়া অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।
দেশ এক বিরাট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করা সরকারকে গণ-আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে হয়েছে। যদিও গত তিনবারের নির্বাচন ছিল ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। দেশ দীর্ঘ সময় ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। এখন নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সময় এসেছে। এ সময়ে বিচক্ষণতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি। যেসব কারণে সর্বশেষ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে জনগণ, নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেকে সেসব থেকে মুক্ত রাখবে—সেটাই প্রত্যাশা।
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে স্থিতিশীলতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। শিগগিরই রাজনৈতিক মীমাংসার মাধ্যমে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করা প্রয়োজন। দেশের প্রত্যেক নাগরিক জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমঅধিকার পাওয়ার হকদার এবং এটি সাংবিধানিকও বটে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে প্রয়োজনীয় সব সংস্কারের পথেই অগ্রসর হতে হবে। নয়তো বর্তমানে অর্থনীতি যেসব কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা দীর্ঘমেয়াদে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। নীতিনির্ধারকদের অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় দেশে বিরাজমান অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করা উচিত, যাতে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন আছে।