অনলাইন জুয়ার দৌরাত্ম্য এবং শেষ পরিণতি
Share on:
কদিন আগে বাড়িতে ফেরার জন্য অটোভ্যানের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম নিমগাছী বাজারে এক পান-সিগারেট দোকানের পাশে।
ইতোমধ্যে দামি প্যান্ট শার্ট পরা চৌদ্দ কি পনেরো বছরের একটি ছেলে আমাকে পাশ কাটিয়ে সেই দোকানির নিকট থেকে এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট নিয়ে সেখান থেকে একটা সিগারেট বের করে আগুন জ্বালিয়ে এমন ভঙ্গিমায় সিগারেট টানতে টানতে সামনের দিকে চল্ল যেন ওয়েস্টান গল্পের হিরো। তার চতুর্দিকে কে বা কারা আছে তাদেরকে গুনবার সময় তার হাতে একদমি নেই।
এ সময় আমার পরিচিত এক বয়স্ক ব্যক্তি আমার কাঁধে হাত রেখে বলছিল বাবাজি তুমিতো সাংবাদিক মাসে কত টাকা বেতন পাও, হয়তো যা পাও তা দিয়ে তোমার সংসার চালানই দুষ্কর।
অথচ এই ছেলেটা মাসে লাখ টাকার উপড়ে ইনকাম করে। আমি এই মুরুব্বির কথা শুনে বল্লাম, মাশাল্লাহ ছেলেটার লক্ষ টাকা ইনকাম এটাতো অনেক ভালো। পাশের আরেক ব্যক্তি আমাকে উদ্দেশ করে বল্লেন, ভাই এক্ষেত্রে মাশাল্লাহ বলা চলে না। তখন সেই মুরুব্বি একটু ঘৃণা ভরা কণ্ঠে বল্লেন, সে অনলাইন জুয়ার এজেন্ট।
বর্তমান সময় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্ব ব্যাপী ব্যাপক উন্যতি হয়েছে। আমাদের দেশ এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের দেশের শহর থেকে শুরু করে গ্রামের প্রায় প্রতিটা মানুষের হাতে স্মার্টফোন। ব্যবহার করা হয় ইন্টারনেট। অধিকাংশ মানুষ ব্যবহার করে ইউটিউব, ফেসবুক, ইমু, হোওয়াস্টঅ্যাপ সহ ইন্টারনেট ভিত্তিক নানারকম প্লাটফর্ম। একস্থান হতে দূরবর্তী স্বজনদের সঙ্গে নিমেষেই যোগাযোগ করতে পারছে। স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে ঘরে বসে অনলাইন ক্লাসের সুবিধা। আর বিনোদনের কথা বলে তো শেষ করাই দায়। এতো সব সুবিধার মাঝে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের চলা হয়ে উঠেছে আরো সহজ। এসবি সম্ভব হয়েছে মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের বদৌলতে।
মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট ব্যবহারে সবাই যে উপকৃত হচ্ছে ঠিক তেমনটা না। এর কুফলে অধিকাংশ যুবক যুবতি ও শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। আমাদের দেশে ইতিমধ্যে মোবাইল ফোন কিনে না দেওয়া বা অপারগতার কারণে অনেক ছেলে মেয়েদের আত্মহত্যার খবর যেমন শুনেছি ঠিক তেমনি মোবাইলের জন্য বাবা-মাকে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। আমাদের দেশে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারে সুফলতার চেয়ে কুফলতার দিকেই বেশি এগুচ্ছে এক শ্রেণীর মানুষ।
সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইন জুয়া মারাত্মকভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কিশোর যুবক থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। জুয়া বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ সকলের হাতে মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট। জুয়া খেলাটা প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। ধারণা করা হয় যিশু খৃস্টের জন্মের ৩০০০ বছর আগে তখনকার রাজা বাদশারা ছয়পাশ বিশিষ্ট গুটি সদৃশ্য বস্তু বা পাশা দিয়ে বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে বাজি ভিত্তিক জুয়া খেলতেন। এখনকার জুয়া আর নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা এলাকার মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। অনলাইন জুয়া দুনিয়াব্যাপী বিস্তার করেছে। এক স্থানে বসে বিশ্বের যেকোন প্রান্তের ব্যক্তির সঙ্গে অনলাইনে জুয়া খেলা সম্ভব। অনলাইন জুয়ায় বিশেষ করে স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বেকার যুবক ও তরুণ - তরুণীরাই বেশি আসক্ত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ও বেকার তরুণ-তরুণীরা জুয়ার অর্থ জোগান দিতে বাবার পকেট কাটা, ঘরের দামি জিনিসপত্র চুরি এবং ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হচ্ছে, যা পরিবারের সুখ শান্তি বিনষ্ট করে অশনি বার্তা হয়ে আসছে। ফলশ্রুতিতে দিন দিন পরিবারে বয়ে আনছে অশান্তি, কলহ এবং বিচ্ছেদের ঘটনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে তরুণ ও শিক্ষার্থীরা মাদকের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
অনলাইন জুয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষকে বিভিন্নভাবে আকৃষ্ট করে থাকে। তারা মৌখিক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের চমকপ্রদ প্রচার প্রচারণা চালিয়ে আসছে। কেউ বলছে অনলাইন জুয়াতে ১০ হাজার টাকা ইনভেস্ট করলে ৬ মাস পরে ১ লাখ টাকা লাভ পাবেন। এছাড়াও তারা ১০ গুন থেকে ২০ গুন লাভের অফারও দিয়ে থাকে। চিন্তাবিদরা অনলাইন জুয়াকে উল্টা পিরামিডের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অনলাইন জুয়ায় আসক্তরা শুরুর দিকে কিছু টাকা পেয়ে থাকলেও শেষের দিকে প্রতারক চক্র সবকিছু হরিলুট করে উধাও হয়ে যায় আর বিনিয়োগকারীকে সব হারিয়ে পথে বসতে হয়। অসাধু ব্যক্তিরা সহজ সরল মানুষকে বিশ্বাস করানোর জন্য মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার ইউ এবং টিকদের ব্যবহার করে থাকে এবং এলাকাভিত্তিক এজেন্ট নিয়োগ দেয়। তারা নানান ফন্দিতে মানুষকে ফাঁদে ফেলে। এই ফাঁদে পা দিয়ে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলো জমিজমা সহায়-সম্পদ এমনকি গবাদিপশু বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। অনেকেই নিঃস্ব হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।
রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তর থেকে ৩৩১ এর অধিক জুয়ার সাইট বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, দিন যত যাচ্ছে অসাধু ব্যক্তিরা মানুষকে বোকা বানানোর জন্য নতুন নতুন ফন্দি সৃষ্টি করছে। তৈরী করছে নানান ধরনের অনলাইন জুয়ার অ্যাপস যেমন, টেলিগ্রাম, ক্যাসিনো, ক্রিকেট, ওয়ান বক্স, টু এক্স বিট, লুডু, ফুটবল, লাইভ বাজি প্রভৃতি। এসকল অ্যাপস সহজেই গুগোল প্লে-স্টোরে পাওয়া যায়। যার ফলে শহর থেকে গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকার লোকজন তাদের ফাঁদে পা বাড়াচ্ছে। অনলাইন জুয়াতে অর্থ আদান প্রদানের জন্য ডলার ব্যবহার করা হয়। যার ফলে এদেশ হতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রত্যেক বছর অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার অধিক অর্থ লেনদেন হচ্ছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে।
অনলাইন জুয়া অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে সংঘটিত হওয়ায় বর্তমান আইন দ্বারা কার্যকর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া বেশ কঠিন। যারফলে দিন দিন অনলাইন জুয়ার প্রকোপ বেড়েই চলেছে। বর্তমান সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি ৪৯ লাখ। যাদের সিংহ ভাগ কোন না কোনভাবে অনলাইন জুয়ার সঙ্গে পরিচিত।
অনলাইন জুয়া বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তার মাঝে উল্লেখ্য বিষয়গুলো নিম্নরূপ-অনলাইন জুয়ার প্রচারকারী টিকটকার এবং ইউটিউবারদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
আইনের সংশোধন ও কার্যকারিতা বাড়াতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসাধুদের তৎপরতা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। অনলাইন জুয়ার কুফলতা সম্পর্কে প্রচার প্রচারণা বাড়াতে হবে। সন্তান ও পরিবারের লোকজন কী ধরনের অ্যাপস ব্যবহার করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এলাকায় জুয়ার কোন এজেন্ট থাকলে ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে জানাতে হবে। স্কুল কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে নানা ধরনের কর্মশালা চালাতে হবে। মা-বাবাকে সচেতন করতে কু-প্রভাব সম্পর্কে ভয়েজ বার্তা পাঠাতে হবে। সরকারের অর্থায়নে ফেসবুক ইউটিউবে অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে হবে। প্রতিটা এলাকায় পর্যাপ্ত খেলার মাঠ তৈরী এবং খেলাধুলার প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। অনলাইন জুয়ার ছোবলে এদেশের মানুষ ধ্বংস হোক এটা আমাদের কারো কাম্য নয়। নিজে সচেতন হতে হবে এবং অপরকে সচেতন করতে হবে ।