অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে যত চ্যালেঞ্জ
Share on:
বাংলাদেশ রাহুমুক্ত হয়েছে। নোবেলবিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস একে বলেছেন ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’। সরকার পরিবর্তনের নিয়মতান্ত্রিক প্রথা ও প্রক্রিয়া পরিত্যক্ত হওয়ার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে শেখ হাসিনাকে গণবিপ্লবে বিদায় নিতে হলো।
সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্দিষ্ট সময়ান্তে জনগণের সম্মতি গ্রহণ অনিবার্য বিষয়। কিন্তু ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা বিগত ১৬ বছরে একটি নির্বাচনও সঠিকভাবে করেননি। ২০১৪ সালের নির্বাচনটি ভোটারবিহীন হিসেবে খ্যাতি পায়। ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়। ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতারণা করা হয়। নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংসের সাথে সাথে মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। বিরোধী দলগুলো নির্মূলের লক্ষ্যে হত্যা, গুম, হামলা ও মামলার পথ বেছে নেয়া হয়। মানুষের স্বাধীনতা শূন্যের কোঠায় নিপতিত হয়। দুর্নীতি গোটা জাতিকে গ্রাস করে।
বাংলাদেশের যাবতীয় সম্পদকে পৈতৃক মনে করে ক্ষমতাসীন দল বেপরোয়া লুটপাটে লিপ্ত হয়। ব্যাংকগুলো ফতুর হয়ে যায়। লাখো কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায়। দেশের বৈদেশিক রিজার্ভ আতঙ্কজনক অবস্থায় উপনীত হয়। আমদানি-রফতানি সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পৌঁছে। দ্রব্যমূল্য এত বৃদ্ধি পায় যে, মানুষের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে। দেশের আইন-শৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি ঘটে। পুলিশ বাহিনী নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। আমলাতন্ত্র দলতন্ত্রে পরিণত হয়। দেশের বুদ্ধিজীবীরা নগ্নভাবে বুদ্ধি বিক্রির প্রতিযোগিতায় নামে। শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী- সর্বত্র সুবিধাবাদ ও নিকৃষ্ট ক্ষমতামোহ পরিলক্ষিত হয়। দেশের শিক্ষাঙ্গন সন্ত্রাসের চারণভূমিতে পরিণত হয়। শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে প্রতিবেশী আধিপত্যবাদের সুকৌশল নিয়ন্ত্রণ লক্ষ করা যায়।
দেশের সামগ্রিক শোচনীয় অবস্থায় নাগরিক সাধারণ বিশেষত ছাত্র-যুবসমাজ ক্ষোভ দুঃখ ও ক্রোধ লালন করছিল। এ ধরনের অবস্থা আগ্নেয়গিরির মতো। যেকোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। বিগত ১৬ বছরে একটু আধটু বিস্ফোরণ যে ঘটেনি তা নয়। জনগণের আঁড়িয়াল বিল আন্দোলন, ধর্মীয় আবেগে আঘাত হানার প্রতিবাদ, স্থানীয়ভাবে জাতীয় ইস্যুর প্রতিবাদ, শিক্ষা বিষয়ে বিজাতীয় প্রভাব প্রতিরোধ- এমনি হাজারো আন্দোলন হয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় নিরন্তর আন্দোলন করেছে। সরকার রাজনৈতিকভাবে এসব ইস্যু ও আন্দোলন মোকাবেলা না করে নির্মম শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তার মোকাবেলা করেছে। দেশের ছাত্রসমাজও তাদের শিক্ষা সমস্যার বাইরে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন ও কোটাবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছে।
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা এক বড় ধরনের কোটাবিরোধী আন্দোলনে নামে। সরকার প্রথমে তাদের দাবি অগ্রাহ্য করলেও শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের তীব্রতায় তা মেনে নেয়। এই কোটাবিরোধী আন্দোলনটা ছিল ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ অন্যান্য মোট ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা সাধারণ ছাত্রদের মেধা উন্নয়নের বিপরীতে ছিল। ভালো ফল করেও মেধাবী ছাত্ররা যথাযথ চাকরি পাচ্ছিল না। ছাত্ররা কোটাব্যবস্থার সংস্কার চাচ্ছিল, বিলোপ নয়। কিন্তু দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী শেখ হাসিনা গোসসা করে সব কোটা বাতিল করে দেন। আসলে ক্ষমতাসীন সরকারের ক্ষমতার হাতিয়ার ছাত্রলীগ কোটাব্যবস্থা বিলোপের বিপক্ষে যায়। কোটাব্যবস্থা তথা মুক্তিযোদ্ধা কোটার নামে ক্ষমতাসীন দল পাবলিক সার্ভিস কমিশন-পিএসসি তথা চাকরিদাতা কর্তৃপক্ষের কাছে তালিকা পাঠাত। মুক্তিযোদ্ধার নামে সেই সব চাকরি পেতো আওয়ামী লীগের পোষা গুণ্ডাবাহিনী।
২০১৮ সালের কোটাব্যবস্থা বিলোপের পর শাসক দলের ঘরোয়া সিদ্ধান্ত মোতাবেক কোটাব্যবস্থার পুনর্বহাল চেয়ে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের নামে ছাত্রলীগ নেতারা হাইকোর্টে মামলা করে। সব জানা কথা, নিম্ন আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালত- সব ছিল তাদের দখলে। ভয়ে মুখ খুলত না কেউ। এভাবে সত্য মিথ্যা হয়ে যেত আর মিথ্যা সত্যে পরিণত হতো। তাই কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের রায় দেন হাইকোর্ট। সন্তুষ্ট হয় শাসকগোষ্ঠী আর অসন্তুষ্ট হয় শিক্ষার্থীগোষ্ঠী। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
২০১৮ সালের আন্দোলনের অনুসরণে ছাত্ররা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জানায়। সঙ্গত কারণে তারা সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। প্রথম দিকে স্বয়ং শেখ হাসিনা অনমনীয় মনোভাব প্রকাশ করেন। লক্ষণীয় যে, আওয়ামী লীগ সরকার কখনো কোন আবেদন-নিবেদনে সাড়া দেয়নি। আন্দোলন, বিক্ষোভ ও ভাঙচুর না হওয়া পর্যন্ত তাদের কানে পানি যায় না। এবারের কোটা আন্দোলনের ঘটনাক্রম লক্ষ করলে বোঝা যাবে, তারা এ ক্ষেত্রে দ্বিচারিতার নীতি অবলম্বন করে। মিথ্যাচারের মাধ্যমে বিভ্রান্ত করার ও পাশবিকতা তথা রক্তক্ষরণের মাধ্যমে কোটা আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। সবাই এখন বলছেন, স্বাভাবিক আন্দোলনটিকে অস্বাভাবিকতার দিকে ঠেলে দিয়ে তারা তাদের পতন অনিবার্য করে তোলে।
ইতিহাসে আমরা রক্তপাতকারী নির্মম শাসকদের নাম শুনেছি। চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, আল মানছুর, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, হিটলার, মুসোলিনি ও ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খান। তাদের সবাই ছিলেন রক্তপাতকারী। শেখ হাসিনা গত এক মাসে যে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন তাতে ওইসব নির্মম দুরাচারদের সাথে তার নামও কালো অধ্যায়ে বর্ণিত হবে ইতিহাসের পাতায়।
সেই রক্তনদী পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ছাত্র-জনতার বিজয় অর্জিত হয়েছে। পতন হয়েছে শেখ হাসিনার স্বৈর শাসনের। দায়িত্ব গ্রহণ করে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের কথা বলেছেন। সেনাপ্রধান দৃঢ়তার সথে বলেছেন, আমি দায়িত্ব নিচ্ছি। সেনাবাহিনীর উপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান তিনি। ইতোমধ্যে নোবেলজয়ী স্বনামধন্য ব্যক্তি ড. প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে জাতীয় সংসদের বিলুপ্তি ঘটেছে।
সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি চিরস্থায়ী ক্ষমতালোভী শেখ হাসিনা বাতিল করেছেন। তাই সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো বিধান এখন নেই। বিচারকরা এ ধরনের অবস্থায় ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটির’ কথা বলেন। কোনো দেশে সামরিক বিপ্লব বা গণবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে অনিবার্য প্রয়োজনের তত্ত্ব দেয়া হয়। বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা নিঃসন্দেহে একটি বিপ্লব। গণবিপ্লব। সুতরাং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ন্যায্যতা রয়েছে।
এ সরকারের সামনে রয়েছে হিমালয়সম দায়-দায়িত্ব। গত সাড়ে ১৫ বছরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবহারিক পর্যায়ের যে সর্বনাশ করেছে তা তিন মাসে কেন, তিন বছরেও মেরামত সম্ভব নয়। রাজনৈতিক মহলে পরবর্তী সরকারের যে দায়িত্ব ও কর্তব্যের বয়ান প্রকাশিত হচ্ছে, তা বিশ্লেষণে মহাকাব্য রচিত হবে। আশার কথা এই যে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কারের এক বিস্তারিত কর্মসূচি পেশ করে রেখেছে। সম্ভবত একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তারা ক্ষমতায় আসবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেহেতু তিন মাসের সেহেতু এটি চাপালে তাদের ঘাড় মটকে যাবে। অর্থাৎ যে দল ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদের জন্য থাকবে রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের এক বিস্তীর্ণ ময়দান। তবে কিছু নীতিগত বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তারা ভবিষ্যৎ সংস্কারের একটি সারমর্ম তৈরি করতে পারে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। তাদের পথটি খুব জটিল। জটিল এ জন্য যে, বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি সমঝোতার সমঝোতাভিত্তিতে জাতীয় রাজনৈতিক সমঝোতা অর্জন এক রকম অসম্ভব। আমাদের দেশে রাজনীতিতে নীতি-নৈতিকতা ও সত্য-মিথ্যার বালাই নেই। রাজনীতিকরা প্রায়ই তারা ষড়যন্ত্রের কথা বলেন। মুখে মুখে তারা বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। আসলে বাস্তবে তারা করেন উল্টোটি। প্রায়শ দেখা যায়, ব্যক্তির জন্য দলের স্বার্থ বিসর্জিত হয় এবং দলের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ পরিত্যক্ত হয়।
যাই হোক, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চ্যালেঞ্জ দুই ধরনের। প্রথমত, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিধান বড় দায়িত্ব। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে ব্রতী হতে হবে। আন্দোলনকারীদের মধ্যে কিছু অতি-উৎসাহী রয়েছে। এদের দমিয়ে রাখতে হবে। পুলিশি ব্যবস্থা একরকম ভেঙে পড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশের দলীয়করণ করেছিল। এটি সত্য যে, গণবিপ্লবের সময় অতি-উৎসাহী পুলিশেরা কিছু অন্যায় করেছে। আপাতত পুলিশকে মাফ করে দিতে হবে। পরে সংস্কার করে পুলিশ ব্যবস্থা নবায়ন করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় দায়িত্ব অর্থব্যবস্থার পুনরুদ্ধার। অর্থনীতিবিদদের পরামর্শে তা করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সব চেয়ে জটিল-কুটিল দায়িত্ব হচ্ছে পররাষ্ট্রনীতির পর্যালোচনা। পতিত সরকার পররাষ্ট্রনীতিকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছে। ব্যক্তি ও দলীয় বলয়ের হীন স্বার্থ থেকে পুনরুদ্ধার করতে হবে পররাষ্ট্রনীতিকে। রক্ষা করতে হবে জাতীয় স্বার্থ। পলাতক শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তা নিয়ে ভারতের পার্লামেন্টে যে মিথ্যা বয়ান বিবৃত হয়েছে তা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য বিব্রতকর। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। সুতরাং সাধু সাবধান।