অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখার প্রস্তাবনা
Share on:
শিক্ষার্থী-জনতার ‘অভ্যুত্থান’ শেষ হয়েও হলো না শেষ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়ে দেশ থেকে পলায়ন করার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এক নতুন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। এবার আবার দেশ গড়ার পালা। কিন্তু দেশ গড়ার পথে সবচেয়ে বড় যে উপাদানটি বর্তমান বাংলাদেশে অনুপস্থিত, তা হলো গণতন্ত্র।
যে গণতন্ত্র অনেক বছর ধরেই অনুপস্থিত, তা ফিরিয়ে আনাই হবে অভ্যুত্থানের ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতির অন্যতম বড় অর্জন। কিন্তু অভ্যুত্থান ও গণতান্ত্রিক অবস্থার মধ্যবর্তী সময়ে দেশকে নেতৃত্ব দেবেন কারা– এ প্রশ্ন এখন সবার মনে।
অনেকে বলছেন, শিক্ষার্থী-জনতা যারা কিনা এ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়েছেন, তাদের মতামতের ভিত্তিতেই ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ গঠন করা উচিত। আসলেই তা হওয়া উচিত কিনা বা গণতান্ত্রিক পর্যায়ে যাওয়ার জন্য এটি নিজেই কোনো গণতান্ত্রিক উপায় কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। একই সঙ্গে এটিও আমাদের ভাবতে হবে, এ মুহূর্তে কোনো গণতান্ত্রিক বিকল্পও কি আমাদের হাতে আছে? তবে ছাত্র-নাগরিকদের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটা কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের ফলে যে গণশক্তি অর্জিত হয়েছে, তাই মূলত ‘বিপ্লবী’ ছাত্র-জনতার হাতে কিংবা তাদের সমর্থনপুষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের গণভিত্তি। বিদ্যমান শাসন কাঠামোর বিরুদ্ধেই গণঅভ্যুত্থান হয়েছে বিধায় এই শাসন কাঠামোর মধ্য থেকে নতুন সরকারের আইনগত ও সাংবিধানিক ভিত্তি খোঁজা অর্থহীন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইনগত ও নৈতিক ভিত্তি নিয়ে বিতর্ক অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী আপৎকালীন সমাধানের জন্য সম্ভবত খুব জরুরি নয়। বরং অন্যসব জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে যা একই সঙ্গে জরুরি এবং দরকারি প্রশ্ন তা হলো, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা কেমন হবে। এ ধরনের সরকার গঠনের পূর্বে মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে অবশ্যই চলমান সংসদকে বিলুপ্ত ঘোষণা করতে হবে।
সেনা সমর্থিত সরকার হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে হয়তো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তাই প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে এমন একজনই আদর্শ হবেন, যার কেবল শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও প্রশাসনিক দক্ষতাই থাকবে না; বরং বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষমতাও থাকবে। প্রধান উপদেষ্টাকে অবশ্যই ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও জটিল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নেভিগেট করার জন্য প্রয়োজনীয় ধীশক্তির অধিকারী হতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সহায়তা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থা ও বিদেশি সরকারের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর সক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ হবে। তাঁকে অবশ্যই স্বচ্ছতা, সুশাসন এবং আইনের শাসনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে, যার ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।
এ ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে এমন ব্যক্তিদের থাকতে হবে, যারা শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের সাফল্যে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। যারা সক্রিয়ভাবে শিক্ষার্থী-জনতার গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন এবং কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিরোধ করেছেন, তাদের অন্তর্ভুক্তি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা এবং নৈতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করবে; যা পরিষদের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং কার্যকারিতাকে আরও বাড়াতে পারে। মোদ্দা কথা, যেহেতু এই গণআন্দোলনের অন্যতম রাজনৈতিক লক্ষ্য স্বৈরতন্ত্র এবং ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার বিলোপ সাধন, সেহেতু যারা ফ্যাসিবাদী কর্তৃত্ববাদী শাসনের সহযোগী নন, তাদের মধ্য থেকেই উপদেষ্টা নির্বাচন করতে হবে।
পরিষদে সমানভাবে বিভিন্ন পেশা, ধর্ম, নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, লিঙ্গ, বয়স এবং বিভিন্ন শ্রেণির সদস্যদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। পরিষদে কোনো বিশেষ পেশার একাধিক ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করে ওই পেশাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত হবে না। উদাহরণস্বরূপ, এটিতে প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে একাধিক ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত নয়। কারণ, এতে জনগণের কাছে একটি পক্ষপাতমূলক বার্তা পরিবাহিত হবে। অধিকন্তু এটি একটি বৈচিত্র্যময় এবং প্রতিনিধিত্বকারী উপদেষ্টা পরিষদ নিশ্চিত করে না বলে তা বাংলাদেশি সমাজের বহুমুখী প্রকৃতির যথাযথ প্রতিফলন নয়। এই পরিষদের সদস্যরা যদি প্রধান উপদেষ্টার জন্য দরকারি বৈশিষ্ট্যগুলোর সব ক’টির অধিকারী নাও হন, অন্তত যেন বেশির ভাগের অধিকারী হন, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের একটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং বৈচিত্র্যময় উপদেষ্টা পরিষদ নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সব সিদ্ধান্ত সমাজের সব অংশের সর্বোত্তম স্বার্থে নেওয়া হয়। এই জটিল ক্রান্তিকালীন ঐক্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে এটি অত্যন্ত জরুরি পদক্ষেপ।
অভ্যুত্থান সফল করার প্রধান কুশীলব হলো শিক্ষার্থী তথা তরুণরা। তাই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর প্রধান সমন্বয়কদের মধ্য থেকে অন্তত একজনকে উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করা খুবই জরুরি। কেউ যুক্তি দিতে পারেন যে, তারা এ ধরনের ভূমিকার জন্য বয়সের দিক থেকে অপরিপক্ব। এই দৃষ্টিকোণটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে এমন তরুণ নেতাদের ঐতিহাসিক এবং বৈশ্বিক উদাহরণ উপেক্ষা করে।
ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষা উভয়েরই প্রতিফলন করে।
বর্তমান নিবন্ধ শেষ করার আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বের রূপরেখা নিয়ে কিছু আলোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার জন্য জাতিসংঘের অধীনে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু একটি তদন্ত কমিটি এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা, যেন গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা যায়। আইনের শাসন ও জবাবদিহির প্রতি বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করার জন্য এই পদক্ষেপ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া সাম্প্রতিক আন্দোলনের সময় এবং গত ১৫ বছরে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কারণে যেসব পরিবার প্রিয়জন হারিয়েছে, তাদের ক্ষতিপূরণের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে হবে। নিপীড়ন ও ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্যে করা বানোয়াট সব মিথ্যা মামলা খারিজ করাও জরুরি। এর ফলে নিরপরাধ ছাত্র ও জনসাধারণের ওপর থেকে বোঝা লাঘব হবে।
আমরা মনে করি, গত ১০ বছরে যে ফ্যাসিবাদী শাসন কাঠামো বাংলাদেশে জারি ছিল, তা মূলত সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র অথবা সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ। ফলে বিদ্যমান সংবিধানের আমূল পরিবর্তন ছাড়া একটি উদার গণতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণ করা অসম্ভব। সে লক্ষ্যে সাংবিধানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সাংবিধানিক পরিষদ গঠনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা। এই পরিষদকে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের জন্য সংবিধান সংশোধনের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। মূল সংস্কারের মধ্যে ক্ষমতার বিষম বণ্টন রোধ করতে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুই মেয়াদে সীমিত করে এবং সংসদ সদস্যদের তাদের দলের নির্দেশনার বাইরে গিয়ে সংসদে স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা নিশ্চিত করে এমন ধারা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। আবার সংবিধানে এমন কোনো ধারা প্রবর্তন করা যায় কিনা, যা রাজনৈতিক দলগুলোকে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চায় বাধ্য করবে, সে বিষয়টিও সাংবিধানিক পরিষদকে খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ যে দল নিজের মধ্যেই গণতন্ত্রের চর্চা করে না, তা স্বভাবতই দেশের সামগ্রিক গণতন্ত্রচর্চাকে বাধাগ্রস্ত করবে।
উপরন্তু যে কোনো বৈষম্যমূলক ধারা রদ করে বৈচিত্র্য এবং অন্তর্ভুক্তির বৈশ্বিক মান প্রতিফলনের জন্য সংবিধান এমনভাবে সংশোধন করা উচিত, যাতে সব নাগরিকের অধিকার ও স্বাধীনতা সুরক্ষিত থাকে। এই সংস্কারসমূহ বাংলাদেশের আইনি ও রাজনৈতিক কাঠামোকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে সাহায্য করে একটি ন্যায়সংগত সমাজ গড়ে তুলবে। তাই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে উন্নত করতে এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতির অবক্ষয় রোধ করতে এই পদক্ষেপগুলো ন্যূনতম, কিন্তু অপরিহার্য।
এই সাংবিধানিক পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়নের পর সাংবিধানিক পরিষদকে একটি সম্পূর্ণ প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর নিশ্চিত করতে ১২ মাসের মধ্যে একটি সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই পদক্ষেপগুলো শুধু জাতির মুখোমুখি হওয়া তাৎক্ষণিক সমস্যাবলির সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের জন্য আরও গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের ভিত্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ।