মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: সোমবার ১৯, অগাস্ট ২০২৪

অন্তর্বর্তীকালীন নাকি বিপ্লবী সরকার?

Share on:

দীর্ঘ পনেরো বছর যাবৎ জগদ্দল পাথরের ন্যায় জনগণের কাঁধে চেপে বসে থাকা নিকৃষ্ট স্বৈরাচার অবশেষে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেছে।


সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী দিনদুপুরে এই পলায়নের ফলে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বারের স্বাধীনতা যাকে হয়ত আমরা আগামী দিনের ইতিহাসে প্রকৃত স্বাধীনতা হিসেবে পরিগণিত হতে দেখবো। স্বৈরাচারের পলায়ন ঘোষিত হবার সাথে সাথে ঢাকাসহ সারাদেশে কোটি কোটি মানুষ স্বাধীনতা উদ্যাপনে মেতে ওঠেন। রৌদ্রকরোজ্জ্বল দুপুর গড়ানোর আগেই রাস্তায় নেমেই অগণিত মানুষ ভিক্টোরি চিহ্ন প্রদর্শন করেন। উল্লাসে নেচে ওঠে সমগ্র দেশ। সূচনা হয় নতুন দিনের আর সেটাই আমাদের এখনকার বিশেষ আলোচ্য।

গত ৫ আগস্ট সূচিত নতুন দিনে কোটি কোটি জনতা ভি দেখানোর পাশাপাশি মুখে মুখে উচ্চারণ করেছে ‘দেশ স্বাধীন হয়েছে’, ‘স্বাধীনতা এনেছি’, ‘আমরা স্বাধীন’ ইত্যাদি কথাবার্তা ও স্লোগান। পতিত স্বৈরাচারের নামে কটুক্তি বা খিস্তি খেউড়ও হয়েছে বটে, তবে তার চেয়ে শতগুণ বেশি উচ্চারিত হয়েছে সদ্যলব্ধ স্বাধীনতার উচ্ছ্বাসপূর্ণ অভিব্যক্তি। ছাত্র-জনতার চোখে মুখে প্রতিফলিত হয়েছে যুদ্ধ জয়ের অপার আনন্দ ও বিজয়ের উল্লাস। এই আনন্দ-উল্লাসের দীপ্ত ছবি প্রতিবিম্বিত হয়েছে রাজপথ, ফুটপাথ ছাপিয়ে আশপাশের দেয়াল, পিলার পাচিলের গাত্রজুড়ে। নতুন প্রজন্মের বিপ্লবীরা সেখানে লিখে দিয়েছে ‘আমরা স্বাধীনতা এনেছি, আমরা স্বাধীনতা রক্ষা করবো।’ এই চেতনার অভিব্যক্তি আমরা দেখেছি নতুন সরকারেও।

নতুন সরকারের প্রধান হয়েছেন দারিদ্র্য বিমোচনের বিশ্বনন্দিত কুশলী কারিগর বাংরাদেশের অহংকার শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থশাস্ত্রবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস। সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে তার সাথে যুক্ত হয়েছেন ২১ বিশিষ্টজন। আর এদের মধ্যে দু’জন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক। এই প্রথম কোনো দু’জন তরুণ ছাত্রাবস্থায় একটি সরকারের কর্মকর্তা হলেন। এদের একজনের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ব্যক্ত হলো যে, তারা ছাত্রদের দাবির পক্ষে সরকারের ভেতরে ক্রীয়াশীল থেকেই দায়িত্ব সম্পন্ন করবেন না, বেসরকারিভাবে রাস্তায়ও তারা ক্রিয়াশীল থাকবেন। কারণ তারা একটি মিশন নিয়ে এসেছেন সেটি বাস্তবায়নই তাদের আসল লক্ষ্য। প্রশ্ন হলো এই যে, সরকার, তাদের কর্মকর্তাগণ এবং তাদের অভিষ্ট লক্ষ্য কী? এসব বিষয়ে আমাদের ধারণা কতটুকু স্পষ্ট?

লক্ষ্য করবার বিষয় হলো আমরা এ সরকারকে বলছি অন্তর্বর্তী সরকার, ড. ইউনুসসহ সকল কর্মকর্তাকে বলছি উপদেষ্টা এবং তাদের দায়িত্ব দেখিয়ে দিচ্ছি যে, তিনমাসের মধ্যে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে ব্যস। ভেবে দেখবার বিষয় নতুন সরকার সম্পর্কে আমাদের এই ধারণা, বোধ ও প্রত্যাশা কী যথার্থ? বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার।

এক. প্রথম কথা হলো এই সরকার একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিনা? এ সরকার সংবিধান স্বীকৃত অন্তর্বর্তীকালীন কর্তৃপক্ষ নয়। তাই এর কোনো মেয়াদও সুনির্দিষ্টি নয়। এর সৃষ্টি হয়েছে গণআকাক্সক্ষার নিরীখে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এরা বিপ্লব করে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে অবৈধ সরকার উৎখাত করে তার গদি দখল করেছে। তাই এর প্রকৃত নাম হলো ‘বিপ্লবী সরকার’ এবং তার কাজ হলো যে লক্ষ্যে তারা বিপ্লব করেছেন তা বাস্তবায়ন করা। তারা যদি এখন তাদের লক্ষ্য পুননির্ধারণ করেন সেটা অন্য কথা কিন্তু বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জনই হবে তাদের আসল কাজ।

দুই. বিপ্লবী সরকারের প্রধান ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা এবং তার পরিষদের অন্যদের উপদেষ্টা পদবীতে আখ্যায়িত করা কতটুকু সঙ্গত? এক্ষেত্রে পূর্ববর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত একটি ভুল নজির অনুসরণ করা হচ্ছে। যা এই সরকারের ক্ষেত্রে আরো বড় ভুল। এই সরকারের প্রধান রাষ্ট্রের সরকার প্রধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবেন। এই পদের ব্যক্তির পদবী প্রধানমন্ত্রী। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গুরু দায়িত্ব পালন করবেন, কিছুতেই কোনো উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করবেন না। একইভাবে সরকারের অন্য কর্মকর্তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পরিচালনার গুরু দায়িত্ব পালন করবেন, কাউকে উপদেশ বিতরণ করে বেড়াবেন না। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের পদবী মন্ত্রী হওয়া উচিৎ। মোদ্দা কথা বিপ্লবী সরকারের প্রধানকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যদের মাননীয় মন্ত্রী আখ্যায়িত করা কর্তব্য। কিছুতেই উপদেষ্টা আখ্যায়িত করা ঠিক বা যৌক্তিক হবে না।

সরকারের প্রধান যদি উপদেষ্টাই হন তাহলে সরকার চালাবে কে? অন্যরাও যদি উপদেষ্টা হন তাহলে মন্ত্রণালয়গুলো কারা চালাবেন? তাই এই সরকারের প্রধানকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যদের স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী বলে আখ্যায়িত করাই সমীচিন।

তিন. এই সরকারের দায়িত্ব ও কার্যকালের মেয়াদ কী হবে তা নিয়ে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী মনে করা হচ্ছে-একটি অবাধ নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান করাই এদের মূল দায়িত্ব আর এটি করতে হবে তাদেরকে তিন মাসের মধ্যে। এই ধারণা থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ইতোমধ্যেই এই সরকারকে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করে বিজয়ীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানাতে শুরু করেছেন। কিন্তু তারা কি এটা ভেবে দেখেছেন যে, এটা তো কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নয় এবং এরকম কোনো শর্ত দিয়ে এই সরকার তারা কেউই গঠন করে দেননি। এরা তো এক রক্তক্ষয়ী গণবিপ্লবের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে। ঐ বিপ্লবের তো একটা লক্ষ্য আছে। তারা তো সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য এসেছেন; একটি নির্বাচন দিয়ে কাউকে সরকারে বসিয়ে দিতে তো তারা আসেনি। তারা তা করতে বাধ্যও নয়।

এই বিপ্লবী সরকার কোন প্রেক্ষাপটে জন্ম নিয়েছে তা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে চলবে না। সাম্রাজ্যবাদের পদলেহি কুখ্যাত স্বৈরসরকার দেশটাকে পুরোদস্তুর মগের মুল্লুকে পরিণত করেছিল। শাসন ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, অর্থ ব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থা, জননিরাপত্তা ব্যবস্থা, ইত্যাকার সব কিছু ধ্বংস করে দিয়ে স্বৈরাচারী খুনি হাসিনা দেশটাকে বাপের জমিদারি স্টেটে পরিণত করেছিলেন। আমাদের শত যুগের সকল অর্জন তুড়ি মেরে ফেলে দিয়ে, সম্পদ বলতে আমাদের যা কিছু ছিল বিক্রি করে দিয়েই খ্যান্ত হননি, ’৭১ এর যে স্বাধীনতার জন্য তিনি ও তার দল সকল কৃতিত্ব দাবি করতেন সেই স্বাধীনতাকেও তিনি নিজের মসনদের বিনিময়ে বিক্রি করে দেশটাকে প্রতিবেশী দেশের অঘোষিত প্রদেশে পরিণত করেছিলেন। আমাদের ছাত্র-জনতা এই ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশকে বের করে এনেছেন মাত্র। দেশ পুনর্গঠনের দায়িত্বও তারা নিয়েছেন-এটা আমাদের সৌভাগ্য। এই বিপ্লবী সরকার দেশ পুনর্গঠনের জাতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে এখন সরকারে ও রাজপথে একসাথে কাজ করছেন। তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে তারা চলে গেলে এসব করবে কারা? সুতরাং এ সরকারকে সরিয়ে দ্রুত গদি লাভের আশায় কোনো কিছুই করা কারোরই উচিৎ হবে না এখন।

দৈনিক সংগ্রাম