অধিকার আদায়ের লড়াই মানেই কি রাজনৈতিক ইস্যু?
Share on:
কোটা সংস্কার অরাজনৈতিক, সেখান থেকে এক দফার ডাক দিয়ে রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে—এমন একটি প্রচার রয়েছে আমাদের চারপাশে। আদতে অধিকার আদায়ের লড়াই যে অরাজনৈতিক নয়, সেটা নিয়ে ভুল বোঝার কিছু নেই; যদি না বোঝানো হয় ‘ভুল বোঝানো হয়েছে’। এখানে ‘বোঝানো’র বিষয়টা ঠাট্টা নয়।
বরং এর মধ্য দিয়ে সমাজে বিদ্যমান গড়পড়তা চিন্তা ও রাজনৈতিক বোঝাপড়ার অজ্ঞতা নিয়ে ইশারা দেয়া হয়।
শুরুতে এটুকু বলি যে যেভাবে সমাজে আমরা থাকি, সমাজ সম্পর্কে যেকোনো বোঝাপড়াই রাজনৈতিক। যেখানে মানুষ হিসেবে নিজের কর্তাসত্তাকে বোঝা, চিহ্নিত করা, ব্যক্তি মানুষ হিসেবে ইতিহাসে নোকতা হয়ে থাকা এবং সামাজিক বা সংঘবদ্ধ পরিসরে ভাবনা ও কর্ম ভাগাভাগি; একজন মানুষের এসবের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। এখানে তার কর্তব্য, করণ ও দায়িত্ব রাজনৈতিক জীব আকারে।
একদম শুরু হিসেবে বলতে চাইলে, জীব হিসেবে মানুষ হলো সাপেক্ষ একটি সত্তা, যার চরিত্র কখনো নিরঙ্কুশ নয়। পরিবেশ, পরিস্থিতি, বংশগতি বা আরো যা কিছু; তার সবকিছুই অন্য কারো বা কিছু দ্বারা প্রভাবিত বা সে একা একা বাঁচতে পারে না এবং যে নিজেও ঘটনার প্রভাবক হয়ে ওঠে। তাই সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের আবির্ভাব অপরিহার্য এবং অগ্রসর সমাজ তার কিছু অধিকার ‘জন্মসূত্রেই’ স্বীকার করে থাকে। এর মধ্যে মানুষে মানুষে সমতার ধারণা উল্লেখযোগ্য। এ কথাটা যত সহজে ‘জন্মসূত্রে’ বলা সম্ভব, তা কিন্তু ততটা সহজে আমরা পাইনি। বরং দীর্ঘ সংগ্রাম ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে মানুষ এ অধিকারগুলো সহজাত হিসেবে এবং ধর্ম-বর্ণ-দেশ-কাল নির্বিশেষে অর্জন করেছে। যেমনটা দুনিয়ার জল-হাওয়া-আলোর ওপর আমাদের অধিকার। কিন্তু দেখুন, প্রাকৃতিক ও সামাজিক অধিকারের বড়সড় পার্থক্য থাকলেও এগুলো বরাবরই লড়াই-সমঝোতার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। যেমন অভিন্ন নদীগুলোর ওপর আমাদের প্রাকৃতিক অধিকার এখন আর রাজনীতি পদক্ষেপ ছাড়া অর্জন সম্ভব নয়।
হয়তো ভূমিকা আকারে কথাগুলো বড় হতে পারে। বড়ই হোক। মূল যে বিষয়টা; রাজনীতি ও অধিকারকে একসঙ্গে ভাবতে না পারার বা ভাবতে না দেয়ার প্রক্রিয়াটা মানুষ হিসেবে সামাজিক দায়িত্ব ও নিজের কর্তাসত্তাকে খর্ব করে দিচ্ছে। যে মানুষ অধিকার সচেতন নয়, সে মুক্ত নয় এবং মুক্ত মানুষই অধিকার পেতে পারে। একই সঙ্গে অধিকার একটি রাজনৈতিক ধারণা, যা সামাজিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করে।
আমরা শুরু থেকে দেখে আসছি, বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে অরাজনৈতিক হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা আছে। এর পেছনে অন্যতম একটি কারণ, খোদ রাজনীতিকে বাংলাদেশে নেতিবাচক ধারা হিসেবে দেখার প্রবণতা আছে। যেখানে জল আর তেলকে একই মাপকাঠিতে মেপে দেখার চেষ্টা আছে। এর ফলে অনড় একটি রাজনৈতিক অবস্থা আমাদের ঘাড়ে চেপে আছে। এ প্রবণতার কারণে অধিকারভিত্তিক কোনো সমাজকে প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা কল্পনা করতেও ভয় পাই। এখানে ভয় হলো অরাজনৈতিক বিষয়, যা আমাদের অধিকার সর্বস্ব মানুষ হওয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। যেন রাজনীতি, অধিকার বোধ ও মুক্ত মানুষের ধারণা সুবিধাপ্রাপ্ত ভদ্র (শাসক বা শাসক দল) পল্লীতে থাকে। যেখানে সব মানুষই সমান, তবে কিছু মানুষ আরো বেশি সমান।
এ আলোচনায় হয়তো খুব বেশি সূক্ষ্ম নয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে খেয়াল করুন। এটা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। নাগরিকদের মধ্যে সমতা অর্জনের আন্দোলন। অর্থাৎ বৈষম্য বিলোপের দাবির মধ্যে এর রাজনৈতিকতা স্পষ্ট। কারণ রাজনৈতিক লড়াই ছাড়া কোথাও বৈষম্য দূর হয়নি। কাগজে-কলমে বা মাঠে-ঘাটে। আবার ‘বৈষম্যের’ যে ধারা তা মূলত দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখাই একটি প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পাওয়া আমাদের জন্য গৌরবের বিষয়। বাংলাদেশের মানুষ যে তার রাজনৈতিক কর্তাসত্তাকে চিহ্নিত করতে পেরেছে এবং মানুষে মানুষে বৈষম্য বিলোপ করতে চেয়েছে; সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে, যা সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ফলাফল। কোটা সংস্কারের আন্দোলন বৈষম্যবিরোধী সেই সংগ্রামের ধারা। কিন্তু স্বাধীনতার সে ফল যুগ যুগ ধরে নির্দিষ্ট শ্রেণী-বর্গের মাঝে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়ার প্রতিটি দিক হলো কোটা বৈষম্য। একে কার্যকর রাখতে জনগণের ওপর বিভেদ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাবা যায়, একটি দেশ স্বাধীন হওয়ার অর্ধ শতক পরও বিভাজনটা স্পষ্ট।
ভোট ছাড়া সরকার গঠনের যে ধারা তাকে তুষ্ট করাই কোটা রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য। এখন স্রেফ অধিকারের কথাটুকু বাদ (যা আসলে সম্ভব না) দিলেও বলতে হবে রাজনৈতিক হাতিয়ারের বিপক্ষে লড়াই কতটা অরাজনৈতিক হতে পারে? এ অধিকার বোধ যে সহজাত কীভাবে বুঝবেন? তার একটি উদাহরণ হলো, কোটা সংস্কার আন্দোলনে লড়ে যাওয়া তরুণদের বড় একটি অংশ হয়তো কখনো সরকারি চাকরির চিন্তাও করেন না। কিন্তু তাদের জন্য এ লড়াই ন্যায্যতা ও অন্যদের অধিকার রক্ষায় শামিল হওয়ার।
বাংলাদেশ কেন হয়তো দুনিয়ার আরো অনেক অনেক জায়গায় রাষ্ট্র সত্যি সত্যি বলপ্রয়োগের বিষয়। যার জন্য আইন আছে, আদালত আছে, প্রশাসন আছে, নির্বাহী বিভাগ আছে, সামাজিক চক্ষু-লজ্জা আছে, আরো কত কী আছে। কিন্তু অধিকার না দেয়ার জিম্মি দশাও আছে। এখন অধিকারের সর্বজনীন ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠা ছাড়া আপনি কীভাবে এগোবেন। কীভাবে মুক্ত মানুষ হিসেবে নিজেকে জাহির করবেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের চূড়ান্ত বা সর্বশেষ এক দফা আমরা একদম শেষ মুহূর্তে দেখছি। এটাকে স্রেফ রাজনৈতিক বলে চোখ রাঙানোর কিছু নেই। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ভয় মানে অধিকার হারানো, রাজনৈতিক কর্তাসত্তা হওয়ার সুযোগ হারানো।
কোটা সংস্কার বা চাকরির দাবির মধ্যে অনেক দাবিই উহ্য ছিল। বাংলাদেশে সরকারি চাকরি বিষয়টা আসলে কী? সেটা শেষ পর্যন্ত কীভাবে মেলে। মূলত শতভাগ কোটাই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক শ্রেণী বা বর্গের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে। আপনাকে এমন এমন যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয় যেখানে নির্দিষ্ট দলের কর্মী বা সমর্থক খুবই গুরুত্বপূর্ণ বা প্রাথমিক যোগ্যতা অথবা সে দলে হিজরত করাও একটা যোগ্যতা। তারপর অন্য লেনদেনও থাকতে পারে, যেটা হরহামেশা আমরা দেখতেও পাই। এখন যারা সংস্কারের প্রশ্নটা তোলে তারা মূলত পুরো প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধেই প্রশ্ন তোলে বা আঙুল তোলে। অর্থাৎ বাংলাদেশে সরকার, রাজনীতি বলতে যা ফ্যাংশন করে তার বিরুদ্ধে আঙুল তোলা। ফলে অধিকার আদায়ের হিস্যা মানুষের মর্যাদার লড়াইও বটে। যে কারণে আমরা দেখছি গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে মানুষ লড়ছে। সে লড়াই শুধু তার পাওয়া-না পাওয়া প্রশ্ন নয়, বরং তার মতো হাজার হাজার বা লাখ লাখ তরুণের জন্য লড়াই। এ লড়াই ন্যায্যতার। আর ন্যায্যতার প্রশ্ন হলো গণমানুষের সাপেক্ষে। ফলে অধিকারসংক্রান্ত কোনো লড়াই হুট করে রাজনৈতিক হয়ে পড়ে না। বরং অধিকারের যেকোনো ধারণা বা অর্জন; তা রাজনৈতিক। যাকে কখনো কখনো নির্দিষ্ট কালপর্বে এসে আমরা আরো স্পষ্টভাবে শনাক্ত করতে পারি। রক্ত দিয়ে শনাক্ত করতে পারি। আবার কখনো কখনো শনাক্ত করতে না পারার ব্যর্থতায় ভুগি। ফলে যুগের পর যুগ মর্যাদাহীন জীবন পার করতে হয় বোধ হয়।