ইরানের সামরিক সক্ষমতা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। তাদের সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠেছে ইরান সেনাবাহিনী বা আরতেশ, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর বা আইআরজিসি এবং আইন প্রয়োগকারী ইউনিটগুলোর সমন্বয়ে। ইরান তাদের মিসাইল কর্মসূচিতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে, যা প্রতিরক্ষার প্রধান মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করছে। ১৩ জুন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইরানি মিসাইলের আঘাতে ইসরাইলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইরানি মিসাইলের বড় সাফল্য হচ্ছে ইসরাইলের সামরিক দম্ভ ও কেউ স্পর্শ করতে পারবে না, এই ধারণা ভেঙে দিয়েছে।
ইরানের সামরিক বাহিনীতে সেনা আছে প্রায় ৫ লাখ ২৩ হাজার। আইআরজিসির সেনা রয়েছে প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার। তারা মিসাইল উন্নয়ন আর দেশের বাইরে অভিযানের বিষয়টি দেখাশোনা করে। অন্যদিকে, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান ইউনিটের সমন্বয়ে কনভেনশনাল সুরক্ষার দিকটি দেখাশোনা করে আরতেশ। বাসিজ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী মিলিশিয়া বাহিনী রয়েছে ইরানের, যারা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষায় সাহায্য করে। এই বাহিনী বহু মিলিয়ন মিলিশিয়া যোদ্ধা সমাগম করতে পারে। ২০২৪ সালে ইরানের সামরিক বাজেট ছিল ১০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ইরান সেই ১৯৮০-৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় থেকে অস্ত্রের ব্যাপারে স্বনির্ভর হওয়ার দিকে মনোযোগ দিয়েছে।
ইরানের বিমান শক্তি অনেকটা সেকেলে। বিমান বাহিনীর ঘাটতি পূরণে দেশটি নজর দিয়েছে মিসাইল শক্তির দিকে। নৌবাহিনীর রয়েছে কিছু ছোট সাবমেরিন, টহল বোট এবং ফ্রিগেট জাহাজ। এই বাহিনী পারস্য উপসাগর ও হরমুজ প্রণালির সুরক্ষার জন্য কাজ করছে। ইরানের স্থল বাহিনী নিজস্বভাবে তৈরি ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যান ব্যবহার করে। ইরানের সামরিক কৌশলে অসম যুদ্ধ, প্রক্সি শক্তি এবং মিসাইলের মাধ্যমে প্রতিরক্ষার উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে।
পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের মিসাইলের মজুত সবচেয়ে বেশি। তাদের কাছে তিন হাজারের বেশি ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল রয়েছে। এর মধ্যে স্বল্পপাল্লার রকেট থেকে নিয়ে মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল সবই আছে। ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইরাকের হামলা ঠেকানোর জন্য মিসাইল কর্মসূচি শুরু করেছিল ইরান। শাহাব-১ ও শাহাব-২ এর মতো শুরুর দিকের মিসাইলগুলো তৈরি করা হয়েছিল সোভিয়েত স্কাড মিসাইলের অনুকরণে। ইরান পরে উত্তর কোরিয়া ও চীনের সহায়তা নিয়ে দূরপাল্লার সিস্টেম তৈরি করেছে।
ইরানের মজুতে নানা ধরনের মিসাইল রয়েছে। প্রধান অস্ত্রগুলোর একটি হলো শাহাব-৩ মিসাইল। তরল জ্বালানি চালিত এই এমআরবিএমগুলো ১৩০০ কিলোমিটার দূরত্বে আঘাত হানতে পারে। উত্তর কোরিয়ার নোডোং মিসাইলের আদলে এগুলো ডিজাইন করা হয়েছে। কনভেনশনাল ওয়্যারহেডের পাশাপাশি এগুলোর পারমাণবিক ওয়্যারহেড বহনের সক্ষমতাও রয়েছে। ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে এগুলো ইরানের মিসাইল বহরে যুক্ত করা হয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মিসাইল হলো ঘাদর-১। শাহাব-৩ ডিজাইনেরই আরেকটি ভ্যারিয়েন্ট এটা। এটা দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে আঘাত হানতে পারে। এই মিসাইলের নিখুঁত আঘাত হানার সক্ষমতার আরো উন্নতি করা হয়েছে। এগুলো এখন ইসরাইলে এবং ইউরোপেরও কিছু কিছু জায়গায় পৌঁছাতে পারে।
তরল জ্বালানি চালিত আরেকটি এমআরবিএমের নাম হলো খোররামশাহর। এগুলোও দুই হাজার কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে পারে। একাধিক ওয়্যারহেড বহন করতে পারে এই মিসাইল। উত্তর কোরিয়ার মুসুদান মিসাইলের অনুকরণে এগুলো ডিজাইন করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নতুন ভার্সন খোররামশাহর-৪ মিসাইলগুলো দেড় হাজার কেজি ওজনের ওয়্যারহেড বহনে সক্ষম।
শাহাব-৩ মিসাইলের আরেকটি ভ্যারিয়েন্ট হলো এমাদ মিসাইল। এগুলো দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে আঘাত হানতে পারে। ইচ্ছেমত ওড়ার সুযোগ থাকায় এগুলোর নিখুঁত টার্গেটে আঘাত হানার সক্ষমতা অনেক বেশি। জমাট জ্বালানি চালিত এমআরবিএম সেজ্জিল দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে আঘাত হানতে পারে। জ্বালানি জমাট হওয়ায় এগুলো দ্রুত নিক্ষেপ করা যায় এবং এগুলোকে চিহ্নিত করাটাও কঠিন।
জমাট জ্বালানি চালিত আরেকটি এমআরবিএমের নাম হলো খেইবার শেকান। এগুলো ১৪৫০ কিলোমিটার দূরত্বে আঘাত হানতে পারে। ২০২২ সালে এটা বহরে যুক্ত করা হয়েছে। এগুলোর নিখুঁত টার্গেটে আঘাত হানার সক্ষমতা অনেক বেশি।
২০২৩ সালে হাইপারসনিক মিসাইল তৈরি করে ইরান। এটার নাম হলো ফাত্তাহ। এগুলো মাক ফাইভ পর্যন্ত গতিতে উড়তে পারে এবং সুরক্ষা সিস্টেমকে এড়িয়ে আঘাত হানতে পারে। এগুলো ১৪০০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে আঘাত হানতে সক্ষম। জমাট জ্বালানি চালিত স্বল্পপাল্লার আরেকটি ব্যালিস্টিক মিসাইলের নাম হলো ফাতেহ-১১০। এগুলো ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটারের মধ্যে আঘাত হানতে পারে। ইরানের প্রক্সি গোষ্ঠীগুলো এই মিসাইল প্রচুর ব্যবহার করে।
ইরানের কাছে সাউমারের মতো ক্রুজ মিসাইলও রয়েছে। এটা ১৬৫০ কিলোমিটারের মধ্যে আঘাত হানতে পারে। এছাড়া রয়েছে খালিদ ফারজ জাহাজবিধ্বংসী মিসাইল। এই মিসাইল ইরানকে নৌ জাহাজ ও স্থল টার্গেটে আঘাত হানার সক্ষমতা দিয়েছে।
ইরানের মিসাইল প্রযুক্তি খুব বেশি পুরোনো নয়। এখন তারা এগুলোর নিখুঁত আঘাত হানা আর ইচ্ছেমতো ওড়ার সক্ষমতার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। বেশ কিছু মিসাইল স্থানান্তরযোগ্য লঞ্চার থেকে ছোড়া যায়। ফলে এগুলোকে টার্গেট করা কঠিন। মিসাইলের মজুতকে রক্ষার জন্য ইরান ভূগর্ভস্থ মিসাইল শহর বানিয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় মিডিয়ায় বিভিন্ন সময় এ ধরনের কিছু ছবি দেখানো হয়েছিল।
ইরানের মহাকাশ কর্মসূচির অধীনে তাদের মিসাইল উন্নয়নের কাজ চালানো হয়। সিমোরগের মতো স্পেস লঞ্চ ভেহিকলে যে প্রযুক্তি কাজে লাগে, ব্যালিস্টিক মিসাইলে সেই একই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। সিমোরগ ৪ হাজার থেকে ৬ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে। ফলে ইরানের ভবিষ্যৎ মিসাইলের সম্ভাবনা নিয়ে তার প্রতিপক্ষের অনেকেই উদ্বিগ্ন। এখন পর্যন্ত মিসাইলের জন্য দুই হাজার মাইলের বেশি দূরত্বের সীমা অতিক্রম করেনি ইরান।
ইসরাইলের হামলার জবাবে ইরান এখন পর্যন্ত কয়েকশ’ ব্যালিস্টিক মিসাইল ছুড়েছে। এই হামলায় এমাদ, গাদর, খেইবার শেকান এবং ফাত্তাহ মিসাইল ব্যবহার করা হয়েছে। কিছু মিসাইল তেল আবিব ও হাইফাতে আঘাত হেনেছে।
মিসাইল কর্মসূচিতে ইরানের কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। তাদেরকে মিসাইল তৈরির জন্য বিদেশি সরঞ্জামের উপর নির্ভর করতে হয়। যেমন চীন থেকে তাদের সোডিয়াম পারক্লোরাইট কিনতে হয়। নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কিনতে পারে না। শাবাব-৩ ধরনের মিসাইলগুলো তরল জ্বালানি চালিত। নিক্ষেপের আগে এগুলোতে জ্বালানি ভর্তি করতে হয়। ফলে এগুলোর কিছু ঝুঁকি থাকে। জমাট জ্বালানির মিসাইলগুলো বেশি কার্যকর। কিন্তু এগুলো তৈরি করা কঠিন। মিসাইল বাহিনীর চেয়ে ইরানের বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনী তুলনামূলক দুর্বল। ফলে তাদের কনভেনশনাল যুদ্ধের সক্ষমতায় কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে।
ইরানের মিসাইল তাদের প্রতিরক্ষা কৌশলের প্রধান অনুষঙ্গ। তাদের বিমান বাহিনীর দুর্বলতাকে এই মিসাইল দিয়ে পূরণ করা হয়েছে। এগুলো তাদের ইসরাইল, সৌদি আরব এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সক্ষমতা দিয়েছে। ইরান যুদ্ধের ক্ষেত্রে ‘ডিটারেন্স বাই পানিশমেন্ট’ নীতি অনুসরণ করে। অর্থাৎ হামলার শিকার হলে তারা কঠোর জবাব দেবে। মিসাইল ইরানকে রাজনৈতিক শক্তিও দিয়েছে। এই মিসাইল ইরানকে শক্তি প্রদর্শন ও মিত্রদেরকে সহায়তা করার সক্ষমতা দিয়েছে।
ইরানের সামরিক সক্ষমতা অনেকটাই নির্ধারিত হয়েছে তাদের মিসাইল কর্মসূচি দ্বারা। তিন হাজারের বেশি মিসাইলের মজুতের কারণে তাদের একটা শক্তিশালী প্রতিরোধ শক্তি তৈরি হয়েছে। যদিও কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, এই সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে।