মাইলস্টোন কলেজের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের এক নারকীয় অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। যারা শারীরিকভাবে আহত হয়নি, তারাও মানসিক সমস্যার শিকার হতে পারে। অনেক শিশুই পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা সংক্ষেপে পিটিএসডিতে ভুগতে পারে। শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে এখনই নজর দিতে হবে।
পৃথিবীর বহু দেশে স্কুলকেন্দ্রিক বিভিন্ন স্পর্শকাতর ঘটনার পর শিশুদের ট্রমা থেকে বের করে আনতে নানা উদ্যোগ নেওয়ার দৃষ্টান্ত আছে।
২০১২ সালে অ্যাডাম ল্যানজা নামের এক যুবক যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট রাজ্যের একটি প্রাইমারি স্কুলে হঠাৎ করে ঢুকে পড়ে। এরপর নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে ২০ শিক্ষার্থীকে। এ ঘটনার পর শিশুদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়ে যায়। রাজ্য সরকার খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ট্রমা রেসপন্স টিম গঠন করে। এই টিম বেঁচে যাওয়া শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য ২৪ ঘণ্টার কাউন্সিলিং সেবা চালু করে। এর আওতায় নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করা হয়। স্কুল খুললে প্রতিটি ক্লাসরুমে একজন সার্টিফায়েড সাইকোলজিস্ট সপ্তাহে তিন দিন উপস্থিত থেকে তাদের স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতেন। স্কুলের সব শিক্ষককে বাধ্যতামূলক ট্রমা ইনফর্মড কেয়ার নামে একটি কোর্সে বাধ্যতামূলকভাবে যুক্ত করা হয়। এ কোর্সের মাধ্যমে তারা শিখত কোন কোন আচরণের মাধ্যমে শিশুর ট্রমা তারা চিহ্নিত করতে পারবে। নিরাপত্তার জন্য স্কুলের আর্কিটেকচার বদল করা হয়।
২০১৪ সালে পাকিস্তানের পেশোয়ার আর্মি পাবলিক স্কুলে তালেবান সদস্যরা ১৩২ জন শিক্ষার্থীসহ ১৪৯ জনকে হত্যা করে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় তাদের মনোবিজ্ঞান বিভাগের নেতৃত্বে ওয়ার চাইল্ড রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট চালু করে। হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি প্রতিদিন এক ঘণ্টা টেলিথেরাপিও দেওয়া হতো। একই সঙ্গে আর্ট থেরাপিস্টরাও তাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা শুরু করে। পরে সরকারের পক্ষ থেকে চাইল্ড সাইকোসোশ্যাল সাপোর্ট ডেস্ক স্থাপন করা হয়। হিলিং গার্ডেন নামে একটি বাগান গড়ে তোলা হয় পেশোয়ারের একটি স্কুলে। যেখানে শিশুরা গাছ লাগিয়ে, খেলাধুলা করে ক্রমেই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
২০২৩ সালে চীনের গুয়াংডং প্রদেশের একটি কিন্ডারগার্টেনে এক ব্যক্তি ছুরিতাঘাত করে চারজন শিক্ষার্থীসহ ছয়জনকে হত্যা করে। এ ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকার ক্রাইসিস কমান্ড সেন্টার স্থাপন করে। যেখানে শিক্ষার্থীদের তিনভাবে থেরাপি দেওয়া শুরু হয়। একই সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে এ ঘটনার স্পর্শকাতর ছবি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সরিয়ে নেয়। সোশ্যাল মিডিয়াগুলোয় ট্রমা সেনসেটিভ কনটেন্ট ফিচার চালু করা হয়। এই উদ্যোগের পরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে বেশ সময় লেগেছিল।
তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের এসব ঘটনার আলোকে মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। সব থেকে ভালো হয় যদি এই স্কুল আঙিনায় একাডেমিক কার্যক্রম অন্তত কিছুদিনের জন্য বন্ধ রেখে প্রয়োজনে অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম চালানো যায়। কারণ যতবার শিক্ষার্থীরা এই স্কুলের মাঠ, স্কুলের ভবনগুলো দেখবে, ততবার তাদের মানসপটে সেই বীভৎস স্মৃতি ভেসে উঠবে। শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক করা তখন বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে। এর সঙ্গে সঙ্গে যে উদ্যোগগুলো নেওয়া যেতে পারে তা হলো—প্রথমেই একটি ট্রমা রেসপন্স টিম গঠন করা। এই টিমে থাকবে প্রশিক্ষিত চাইল্ড সাইকোলজিস্ট, এডুকেশন সাইকোলজিস্ট, স্কুল কাউন্সিলর ও এ বিষয় নিয়ে কাজ করা অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা। তাদের কাজ হবে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের মানসিক আঘাতগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজন অনুযায়ী দলভিত্তিক অথবা ব্যক্তিগত সেশনের আয়োজন করা। পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের আলোকে এই ট্রিটমেন্টের পরিকল্পনা গ্রহণ এবং এর বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে দিতে হবে।
ক্লাস কার্যক্রম প্রাথমিকভাবে সীমিতভাবে শুরু হতে পারে। প্রথম কয়েক সপ্তাহ হিলিং ফেস পরিচালিত হতে পারে। এ সময় লেখাপড়ায় জোর না দিয়ে যে কাজগুলো করতে তারা ভীষণ পছন্দ করে, সে কাজগুলো করা যেতে পারে। যেমন—মিউজিক, আর্ট, অভিনয়, খেলাধুলা, প্রকৃতির সঙ্গে থাকা ইত্যাদি। এসব কাজের ব্যস্ততায় শিক্ষার্থীরা তাদের ভেতরের আবেগকে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে শিখবে এবং সহপাঠীদের সঙ্গে পুনরায় আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে। এর মাধ্যমে শিশুদের ভয় ও উত্তেজনা ক্রমেই কমে যাবে।
শিক্ষক ও অভিভাবকদের জন্য ট্রমা সচেতনতাবিষয়ক কিছু কর্মশালা বাস্তবায়ন করা জরুরি। শিশুদের বাহ্যিক আচরণ, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে শিক্ষকরা বোঝার চেষ্টা করবেন শিক্ষার্থীরা এখনো ট্রমার মধ্যে আছে কি না। থাকলে তাদের সঙ্গে কেমন আচরণ প্রয়োজন, সেই বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। তাহলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের নিরাপদ মনে করবে। ট্রমা কমিয়ে আনা বিষয়েও অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে এ ধরনের ভিডিও, ছবি এবং আলোচনা যেন না করা হয়, সে বিষয়েও কোনো সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এভাবে স্কুল এবং বাড়ি উভয় জায়গা থেকেই যদি শিশুদের স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা চালানো হয়, তাহলেই এটি কার্যকর হতে পারে।
এ সময় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ভীষণ জরুরি। স্কুলের ডেকোরেশনেও বেশ কিছু পরিবর্তন আনা যেতে পারে। এ জাতীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বুঝবে, তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ। একই সঙ্গে অভিভাবক ও শিক্ষকদের বারবার নিশ্চিত করবে যে আতঙ্কিত হওয়ার এখন আর কিছু নেই। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে স্কুল নিরাপদ—তাদের এই মানসিকতা গড়ে তুলতে সহযোগিতা করতে হবে। মিডিয়ায় ট্রমা সেনসেটিভ কনটেন্ট ফিল্টার নীতি গড়ে তুলতে হবে। কারণ এর অভাবে শুধু স্কুলের শিক্ষার্থীরাই না, অন্য শিশুরাও এসব বীভৎস ছবি ও ভিডিও দেখে ট্রমাটাইজড হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়েও গণসচেতনতা গড়ে তোলা ভীষণ জরুরি।
লেখক : শিক্ষার্থী, এডুকেশনাল সাইকোলজি অ্যান্ড গাইডেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়