রোবোটিকসের মতো আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তির চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবনকে একই সূত্রে বাঁধতে হবে। একই সঙ্গে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্ভাবননির্ভর কার্যক্রমে গুরুত্ব দেওয়া সময়ের দাবি—এই দায়িত্ববোধ থেকেই দেশের অন্যতম তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান স্পেকট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম প্রাইভেট লিমিটেড বাংলাদেশে ২০১৯ সাল থেকে রোবোটিকস প্রযুক্তিতে সক্ষমতা অর্জনে গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ শুরু করে। ফলে স্পেকট্রাম যুগান্তকারী রোবোটিকস সিস্টেম ‘যন্ত্র সৈনিক’ উদ্ভাবনের মাধ্যমে প্রযুক্তি খাতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
যন্ত্র সৈনিক একটি বোমা নিষ্ক্রিয়করণ রোবট, যা যুদ্ধক্ষেত্রে নিরাপত্তা প্রদানে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। বিপজ্জনক ও প্রাণঘাতী মিশনে ব্যবহারের উপযোগী এই রোবট সৈনিকদের জীবনের ঝুঁকি কমিয়ে আনবে। জীবন ও সম্পদ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবে।
যন্ত্র সৈনিক রোবট তৈরির এই যাত্রার সূচনা হয় ২০১৯ সালের শেষ দিকে। সেই সময় স্পেকট্রামের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা চীনের রোবটশিল্প প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের পাশাপাশি বিভিন্ন রোবট নির্মাণ কারখানা পরিদর্শন করেন। তাঁরা জানতে পারেন, জাপানের প্রযুক্তিকে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিকভাবে প্রয়োগ করে শিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছে চীন। এসব তথ্যলব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা তাদের মধ্যে নতুন কিছু উদ্ভাবনের উৎসাহ সৃষ্টি করে। স্পেকট্রামের প্রযুক্তিবিদদের মনোজগতে জেগে ওঠে দেশের জন্য নতুন কিছু করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা; তাঁরা তখন নিজেরাই নিজেদের প্রশ্ন করেন, আমরা কি এমন কিছু তৈরি করতে পারব? কীভাবে তৈরি করব? কার জন্য তৈরি করব? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তাঁরা মনোনিবেশ করেন রোবোটিকসের জগতে।
লক্ষ্যে অটুট থাকলে সেটি অর্জনের সুযোগও আসে, আর এ ক্ষেত্রেও সেই সুযোগ এল। বাংলাদেশের নিরাপত্তা–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান উন্নত দেশ থেকে এক্সপ্লোসিভ অর্ডন্যান্স ডিসপোজাল (ইওডি) রোবট আমদানি করে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি পরীক্ষার বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ইন্সপেক্টরেট অব ইলেকট্রিক্যাল ইকুইপমেন্ট অ্যান্ড ইনস্ট্রুমেন্টস (আইইএন্ডআই) এসব রোবট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। স্থানীয় মেধা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এ ধরনের রোবট তৈরি করা যায় কি না, সে বিষয়ে আইইঅ্যান্ডআই অনুসন্ধান করছিল।
তারা জানতে পারে, স্পেকট্রাম এ বিষয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। ফলে এ দুটি প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কাজ শুরু করে। তারা যৌথভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে কার্যকর প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি ও বিদ্যমান অবকাঠামো ব্যবসা করে উচ্চ প্রযুক্তির রোবট তৈরির সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ নিয়ে গবেষণা করবে। অবশেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য একটি রোবট তৈরি করা হবে, যা স্পেকট্রাম ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যৌথভাবে অর্থায়ন করবে এবং এটি জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে ব্যবহৃত হবে।
দেশের আইটি সেক্টরে ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে স্পেকট্রাম স্বল্পতম সময়ে স্থানীয় প্রতিভাবান ও উদ্যমীদের নিয়ে একটি দল গঠন করে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করতে সক্ষম হয়। শুরু হয় বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর জন্য রোবট তৈরির কার্যক্রম। স্পেকট্রামের উদ্যমী দলটির কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ে ২০২১ সালে একাধিক পরিমার্জনার পর রোবট তৈরির এ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত রূপ নেয় এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরীক্ষার মাধ্যমে এর সক্ষমতা যাচাই করা হয়। উন্নত দেশ থেকে আমদানি করা রোবটের সঙ্গে তুলনামূলক পরীক্ষা করে দেখা যায়, এটি অনেক ক্ষেত্রেই উৎকৃষ্ট পারফর্ম করছে। গুণগত মান নিশ্চিত করার পর এটি জাতিসংঘের কঙ্গো মিশনে পাঠানো হয়।
বাংলাদেশে প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী ও আইটি শিল্প খাতের সহযোগিতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এই উদ্যোগ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতায় স্পেকট্রাম উন্নত সংস্করণের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ রোবট—যন্ত্র সৈনিক ভি ১.০ তৈরি করেছে। বর্তমানে এ রোবট আফ্রিকায় বাংলাদেশের শান্তি রক্ষা মিশনগুলোয় নিয়োজিত, যা আমাদের দেশের প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। উপরন্তু, অন্যান্য দেশও এ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রকাশ করছে। ইতিমধ্যে পেরুর সেনাবাহিনী এ রোবট ব্যবসা করছে।
যন্ত্র সৈনিক রোবট শুধু একটি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নয়; এটি বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনার বহিঃপ্রকাশও বটে। এখন বিষয়টি স্পষ্ট যে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত। কারণ, বিশ্বের অন্যান্য দেশ আমাদের এই প্রযুক্তি আগ্রহসহ গ্রহণ করেছে এবং ব্যবহার করছে। অন্য দেশের সঙ্গে যন্ত্র সৈনিক বিনিময় করে বাংলাদেশ শুধু প্রতিরক্ষাক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে না, বরং আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ককে শক্তিশালী করে বৈশ্বিক প্রতিরক্ষাপ্রযুক্তিতে নিজেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করছে।
রোবোটিকসে এ সফলতাকে আরও সুসংগঠিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এবং এর কার্যক্রমগুলোকে স্থায়ী ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে স্পেকট্রাম। এরই ধারাবাহিকতায় উচ্চ প্রযুক্তির গবেষণা ও উন্নয়নের (আরঅ্যান্ডডি) জন্য ‘সাইবারনেটিকস হাইটেক সলিউশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে।
স্পেকট্রামের রোবট তৈরির প্রকল্পের শুরু থেকেই যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ও আইবিএর প্রাক্তন শিক্ষার্থী রাশেদ নোমান চৌধুরী (বোয়িং ও জেনারেল মোটরসে ১৭ বছরের কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন), ৩০ বছরের মার্কেটিং এক্সপার্ট ঢাকা ইউনিভার্সিটির এমবিএ আমিনুল কাদের খালিলি, বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ার ও আইবিএ থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী রায়হান উর রশীদ (আইইইই বাংলাদেশের সংগঠক) এবং বুয়েট থেকে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারী তরুণ গবেষক ফাইয়াজ আহমেদ তন্ময়। বর্তমানে ২৫ জনের বেশি গবেষক এ প্রকল্পে কাজ করে যাচ্ছেন। পুরো এই উদ্যোগের পেছনে ছিল স্পেকট্রামের দূরদর্শী নেতৃত্ব, যারা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সস্তা শ্রমনির্ভর অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেখানে পোশাকশিল্প ও প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্সই প্রধান আয়ের উৎস। কিন্তু প্রকৃত উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশকে বৈশ্বিক প্রযুক্তি খাতের ভ্যালু চেইনে প্রবেশ করতে হবে। টেকসই উচ্চ প্রযুক্তির উৎপাদনের পরিবেশ গড়ে তুলতে হলে আরও বেশি উদ্যোগ প্রয়োজন।
উচ্চ প্রযুক্তি খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা নিশ্চিত করতে একটি শক্তিশালী উৎপাদনশীল প্রজন্ম প্রয়োজন এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত সহায়ক শিল্প খাত গড়ে তুলতে হবে। আমাদের স্বপ্ন ও লক্ষ্য হলো ‘চিপ থেকে সিলিকন, এআই থেকে মেশিন ডিজাইন’ পর্যন্ত সমগ্র প্রযুক্তি উৎপাদনপ্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্প ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা। যন্ত্র সৈনিক তৈরির মাধ্যমে স্পেকট্রাম সেই স্বপ্নের পথে এগিয়ে গেছে এক ধাপ এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
ফোরকান বিন কাশেম ব্যবস্থাপনা পরিচালক
স্পেকট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম প্রাইভেট লিমিটেড